সেই মিনুর বড় ছেলে ইয়াসিনের সন্ধান মিলেছে
যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামির পরিবর্তে প্রায় তিন বছর কারাগারে জেল খেটে মুক্তি পাওয়ার ১২ দিন পর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান মিনু আক্তার। সেই মিনুর নিখোঁজ বড় ছেলে ইয়াসিনের (১২) সন্ধান পাওয়া গেছে। মিনু আক্তারের মুক্তি পাওয়ার পর থেকেই ইয়াসিনকে অনেক খুঁজেও সন্ধান পায়নি পরিবার।
সোমবার (১২ জুলাই) চট্টগ্রামের বায়েজিদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. কামরুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, নারায়ণগঞ্জের একটি সরকারি পুনর্বাসন কেন্দ্রে রয়েছে ইয়াসিন। আজ আমরা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছি। এছাড়া সকালে বায়েজিদ থানার মাধ্যমে ইয়াসিনের সঙ্গে তার মামা রুবেলের ভিডিও কলে কথা হয়েছে। আবেগ-আপ্লুত ইয়াসিন তার মামা রুবেলকে চিনতে পেরেছে।
এর আগে ৬ জুলাই ইয়াসিনের মামা রুবেল ঢাকা পোস্টকে জানিয়েছিলেন, তার ভাগিনা ইয়াসিনের কোনো সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি জানিয়েছিলেন, বোন মিনু জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পরই ইয়াসিনের কথা জিজ্ঞেস করেছেন। কিন্তু ছেলের সন্ধান দিতে পারেননি তারা।
জানা গেছে, গত ৪ এপ্রিল বেলাল, ফয়সাল, ইয়াসিন এবং সাগর নামে চার ভাসমান পথশিশুকে আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারের নিচ থেকে আটক করে পাঁচলাইশ থানা পুলিশ। তাদের বিরুদ্ধে সাইকেলের টিউবের ছিদ্র ভরাট করতে ব্যবহার করা গাম খেয়ে নেশা করার অপরাধে মামলা করা হয়। পুলিশ পরদিন তাদের আদালতে সোপর্দ করলে আদালত গাজীপুরের পুবাইল সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রে এই চার শিশুকে পাঠানোর আদেশ দেন।
গাজীপুর আশ্রয়কেন্দ্রটি শুধুমাত্র নারীদের জন্য হওয়ায় সেখান থেকে চার শিশুকে ফেরত পাঠানো হয় চট্টগ্রাম কারাগারে। এরপর আদালত ১২ এপ্রিল তাদের নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠানোর আদেশ দেন। এরপর থেকে ইয়াসিন নারায়ণগঞ্জের আশ্রয়কেন্দ্রে আছেন।
গত ২৮ জুন সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার পর আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম মিনুর মরদেহ দাফন করে। বোনের মৃত্যু সম্পর্কে রুবেল ঢাকা পোস্টকে বলেছিলেন, পুলিশ বলছে বোনের মৃত্যু সড়ক দুর্ঘটনায় হয়েছে। এরপরও আমরা চাই, বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হোক। যাদের কারণে আমার বোন বিনা অপরাধে জেলে ছিলেন, তাদের বিচারের আওতায় আনা হোক।
এ বিষয়ে চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামি থানার ওসি মো. কামরুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেছিলেন, ২৮ জুন দিবাগত রাতে বায়েজিদ লিংক রোডে গাড়ির ধাক্কায় এক নারী মারা যান। তার পরিচয় পাওয়া যাচ্ছিল না। ফলে ২৯ জুন আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের মাধ্যমে তার দাফন করা হয়। ওই নারীর পরিচয় বের করতে আমরা কাজ করছিলাম। পুলিশের একটি টিম সীতাকুণ্ড এলাকায় কয়েকজনকে ওই নারীর ছবি দেখালে তারা মিনুর ভাইয়ের কথা বলেন। পরে মিনুর ভাই ছবিটি দেখে এটি তার বোনের মরদেহ বলে শনাক্ত করেন।
ওসি কামরুজ্জামান আরও বলেন, মিনু ওই দিন রাস্তায় দৌড়াদৌড়ি করার সময় তাকে কয়েকবার সড়ক থেকে সরিয়ে দিয়েছিল পুলিশের মোবাইল টিম। এছাড়া মিনুকে যে সময় গাড়ি ধাক্কা দেয় তখন কয়েকজন ঘটনাটি দেখেছেন। এ রকম দুজনের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। তারাই বলছেন, ঘটনাটি সড়ক দুর্ঘটনা।
তবে মিনুর আইনজীবী অ্যাডভোকেট গোলাম মাওলা মুরাদ ঢাকা পোস্টকে বলেছিলেন, মিনুর মৃত্যুর বিষয়টি তদন্ত করা উচিত। তার লাশটি আবার ময়নাতদন্ত করার জন্য আবেদন করছি। এছাড়া মৃত্যুর কারণ খুঁজে বের করতে আদালতে আবেদন করার চিন্তা করছি।
আসামি না হয়েও তিন বছর সাজা খেটে গত ১৬ জুন বিকেল ৪টার দিকে চট্টগ্রাম কারাগার থেকে মুক্তি পান নিরপরাধ মিনু। যাদের কারণে প্রায় তিন বছর জেলে থাকতে হয়েছে, কারাগার থেকে বের হয়ে তাদের বিচারও দাবি করেছিলেন মিনু আক্তার।
মোবাইল ফোন নিয়ে কথা-কাটাকাটির জেরে ২০০৬ সালের ৯ জুলাই চট্টগ্রাম নগরের রহমতগঞ্জ এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় পোশাককর্মী কোহিনুর বেগমকে হত্যা করা হয়। ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর এ মামলার রায়ে আসামি কুলসুমাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত। রায়ের দিন কুলসুমা আদালতে অনুপস্থিত থাকায় আদালত তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন।
প্রকৃত আসামি কুলসুমা আক্তার মামলার সাজা হওয়ার আগে ২০০৭ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত কারাগারে ছিলেন। সাজা ঘোষণা হওয়ার পর ২০১৮ সালের ১২ জুন কুলসুমা সেজে মিনু আক্তার কারাগারে আসেন। চলতি বছরের ২১ মার্চ চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের পক্ষ থেকে আদালতে একটি আবেদন করা হয়। এই আবেদনে বলা হয়, ২০১৮ সালে কারাগারে পাঠানো আসামির সঙ্গে প্রকৃত আসামির মিল নেই। এছাড়া কারা রেজিস্ট্রারে থাকা দুজনের ছবির মিল নেই।
এ আবেদনের শুনানি শেষে কারাগারে থাকা মিনুকে আদালতে হাজির করে তার জবানবন্দি নেওয়া হয়। তখন তিনি জানান, তার নাম মিনু, তিনি কুলসুমা নন।
আদালত কারাগারের রেজিস্ট্রারগুলো দেখে হাজতি আসামি কুলসুমা ও সাজাভোগকারী আসামির চেহারায় অমিল খুঁজে পান। তখন আদালত কারাগারের রেজিস্ট্রারসহ একটি নথি হাইকোর্ট বিভাগে আপিল নথির সঙ্গে সংযুক্তির জন্য পাঠিয়ে দেন। পরে হাইকোর্ট গত ৭ জুন নিরপরাধ মিনুকে মুক্তির নির্দেশ দেন। এরপর ১৬ জুন মুক্তি পান মিনু।
কেএম/এসএসএইচ