‘আগুন নিভে যাবে, তোমাদের বের হতে হবে না’
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সজীব গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজের সেজান জুস কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে এখন পর্যন্ত ৫২ শ্রমিকের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে ফায়ার সার্ভিস। অধিকাংশ মরদেহই ভবনটির দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ তলা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত কারখানাটির শ্রমিক ও নিখোঁজ শ্রমিকদের স্বজনদের অভিযোগ, আগুন লাগার শুরুর দিকে তিনতলা ও চারতলার কলাপসিবল গেট খুলে দিতে বললেও কর্তৃপক্ষ গেটগুলো খুলে দেয়নি। এ কারণেই এই দুই ফ্লোরের শ্রমিকরা বেশি মারা গেছেন।
উপস্থিত অনেক শ্রমিকের দাবি, এখনো বেশকিছু শ্রমিক নিখোঁজ রয়েছেন। তাদের অবস্থান কত তলায় তা অবশ্য তারা নিশ্চিত করতে পারেননি।
শুক্রবার (৯ জুলাই) সন্ধ্যা ৬টায় ঘটনাস্থলে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপকালে নিখোঁজ শ্রমিকের স্বজনরা জানান, যখন ভবনে আগুনের সূত্রপাত হয় তখন কর্তৃপক্ষ তিন ও চারতলার দুই সেকশনেরই কলাপসিবল গেট বন্ধ করে দেয়। এতে ভেতরে প্রায় ১০০ শ্রমিক আটকা পড়েন। ভেতর থেকে তারা কেউই বের হয়ে আসতে পারেননি। তাদের মধ্যে দুই একজন লাফিয়ে নিচে পড়ে জীবন রক্ষা করতে পারলেও গুরুতর আহত হয়েছেন।
স্বজনরা আরও অভিযোগ করেন, আগুন লাগার পর কারখানা কর্তৃপক্ষকে বার বার বলার পরেও তারা তিন ও চারতলার কলাপসিবল গেট খোলেনি। তারা যদি সময়মতো গেট খুলে দিত তাহলে এত শ্রমিকের প্রাণহানি হতো না। আগুন লাগার পরপরই তারা বেরিয়ে আসতে পারত।
ঘটনাস্থলে আসা আশপাশের মানুষের সাথে কথা বলে শ্রমিকদের এ দাবির সত্যতা পায় ঢাকা পোস্ট। বেশিরভাগ মানুষই জানান, আগুন প্রথম দিকে কম ছিল। ধীরে ধীরে বেড়েছে। কারখানার গেট খোলা থাকলে শ্রমিকরা বেরিয়ে আসতে পারতেন। অন্তত প্রাণহানি অনেক কম হতো বলে দাবি করেন তারা।
এ প্রসঙ্গে ফায়ার সার্ভিসও মোটামুটি একই মত দিয়েছে। তারা বলছে, কলাপসিবল গেট বন্ধ থাকাতে মৃত্যু বেশি হয়েছে।
কারখানার সামনে কথা হয় কিশোরগঞ্জের বাচ্চু মিয়ার সঙ্গে। তাঁর মেয়ে তাসলিমা আক্তার (১৮) আগুনের ঘটনায় এখনও নিখোঁজ রয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘আমার মেয়ে ও আমার স্ত্রী গত এক বছর ধরে কারখানাটিতে কাজ করে। গতকাল (বৃহস্পতিবার) সকাল ৮টার দিকে তারা কারখানাটিতে কাজে যায়। রাত ৮টায় তাদের শিফট শেষ হওয়ার কথা ছিল। আমার স্ত্রী কারখানার দোতলায় কাজ করত। আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে সে দোতলা থেকে লাফ দিয়ে নিচে নেমে আসে। সামান্য আহত হলেও সে প্রাণে বেঁচে যায়। সে আমাকে ফোন করে জানায়, আমাদের মেয়ে কারখানার চারতলায় কাজ করে, সে বেরোতে পারেনি। কারখানার লোকজনের কাছে আমার স্ত্রী শুনেছে, চারতলার গেট আটকা থাকায় ভেতরের কেউ বের হতে পারছে না।’
তিনি বলেন, খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে আসি। এখানে থাকা শ্রমিকরা আমাকে জানান, চারতলার শিফট ইনচার্জ গেট বন্ধ করে দেয় এবং ভেতরে থাকা শ্রমিকদের বলে, ‘নিচতলায় আগুন লেগেছে, আগুন নিভে যাবে; তোমাদের কোনো সমস্যা নেই। তোমাদের বের হতে হবে না।’
বাচ্চু মিয়া জানান, শিফট ইনচার্জের এমন কথায় ভেতরে থাকা সবাই নিশ্চিন্তে কাজ করতে শুরু করে আবার। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে যখন আগুন চারতলায় চলে যায়, তখন আর ভেতর থেকে কেউ বের হতে পারেনি।
রূপগঞ্জের বড়পা এলাকার বাসিন্দা মো. হুমায়ুন কবিরের শ্যালিকা মাহমুদা (১৪) কারখানার তিনতলায় কাজ করতেন। আগুন লাগার পর থেকে তিনিও নিখোঁজ আছেন।
হুমায়ুন কবির ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘তিনতলা থেকে বের হয়ে আসা এক নারী শ্রমিক আমাকে জানান, আগুন লাগার আগে তিনি (ওই নারী) কোনো মতে দৌড় দিয়ে বের হয়ে আসেন। তিনি আসার পরপরই তিনতলার দায়িত্বে থাকা নিরাপত্তাকর্মীরা গেট বন্ধ করে দেয়। ফলে ভেতরে ৫০ থেকে ৬০ জন শ্রমিক আটকা পড়ে। এদের মধ্যে আমার শ্যালিকাও রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘তারা যদি গেট বন্ধ করে না দিত তাহলে সবাই বের হয়ে আসতে পারত এবং জীবন বাঁচাতে পারত। কিন্তু সিকিউরিটি গার্ডরা নিজেরা গেট লাগিয়ে দিয়ে পালিয়ে গেছে। কাউকে বের হওয়ার সুযোগ দেয়নি।’
এদিকে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা কারখানার অনেক শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আটকে পড়া এবং নিহত শ্রমিকদের অধিকাংশই শিশু-কিশোর। যাদের বয়স ১৪ থেকে ১৬ বছরের মধ্যে।
এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক (অপারেশন্স) দেবাশীষ বর্ধন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘তিন ও চারতলা থেকে অধিকাংশ মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে দেখে মনে হচ্ছে শ্রমিকরা ভেতরে আটকা পড়েছিলেন। এছাড়া ভবনটিতে পর্যাপ্ত সিঁড়ি ছিল না। সে জন্য শ্রমিকরা চাইলেও দ্রুত নামতে পারেননি।’
এএসএস/এমএসি/পিএসডি/জেইউ/এসকেডি/জেএস