চুপিসারেই দোকান খোলা রাখা হচ্ছে
মোহাম্মদপুরের শের-এ-বাংলা সড়কের পাশে একটি সেলুনের শাটারের একটা অংশ খোলা ছিল। চুল কাটানো যাবে কি না- জিজ্ঞেস করতেই ভেতর থেকে উত্তর এল, ‘আরও একজন আছে, বসতে হবে।’ কিছুক্ষণ পর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসেন নরসুন্দর সঞ্জয় সরকার।
ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, লকডাউনের প্রথম কয়েকদিন সেলুন বন্ধ রেখেছিলাম। জমানো কিছু টাকা থেকে বাজার-সদাই করে খাওয়া-দাওয়া চলছে পরিবারের। আজ ৭ তারিখ, আর তিন দিনের মধ্যে ঘর ভাড়া দিতে হবে। কিন্তু এভাবে বসে থাকলে কয়েকদিন পর তো না খেয়ে চলতে হবে। তাই দুদিন হল চুপি চুপি দোকান চালাচ্ছি। কিছু কাস্টমার আসে। আসলে ভাই দরকারটা তো সবারই। টাকা ছাড়া ঢাকা শহরে একদিনও চলা যায় না।
তিনি জানান, তার পরিবারে চারজন সদস্য। পরিবার নিয়ে তিনি মোহাম্মদপুর কাঁটাসুরের পেছনের দিকে ভাড়ায় একটি ঘর নিয়ে থাকেন। ঢাকায় চলতে প্রত্যেক মাসে অন্তত ১২ থেকে ১৪ হাজার টাকা প্রয়োজন হয়। কিন্তু টাকাটা কোথায়? সেলুন কয়েকদিন ধরে বন্ধ।
করোনা নিয়ন্ত্রণে সরকারঘোষিত লকডাউনের মেয়াদ সাত দিন বাড়িয়ে ১৪ তারিখ পর্যন্ত করা হয়েছে। এ সময়ে ঘর থেকে বেরোতে মানা, দোকানপাট ও গণপরিবহন বন্ধ। লকডাউন বাস্তবায়নে কঠোর অবস্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এ পরিস্থিতি খেটে-খাওয়াসহ মধ্যমআয়ের মানুষকে বিপাকে ফেলেছে। তাই জীবিকার প্রয়োজনে নরসুন্দর সঞ্জয় সরকারের মতো অনেকে চুপিসারে হলেও কিছুটা উপার্জন করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে।
বুধবার (৭ জুলাই) রাজধানীর রায়েরবাজার, মোহাম্মদপুর এবং শ্যামলী এলাকার অলিগলি ঘুরে দেখা গেছে, সেলুন, টেইলার্স, স্টেশনারি, কাঠমিস্ত্রির দোকান, গ্লাসের দোকান, রঙের দোকান, সিরামিকসের দোকান, ছোটখাটো মুদি দোকান, কনফেকশনারিসহ অনেক দোকানই খোলা রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে।
দোকান খোলা রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে অভিনব কায়দায়। মূল শাটারগুলোর অর্ধেক খোলা রেখে বিক্রি চলছে। ক্রেতারা খোলা অংশে গিয়ে ডাক দিলেই ভেতর থেকে সাড়া মিলছে। পুলিশের টহল গাড়ি এলেই সঙ্গে সঙ্গে শাটারগুলো নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, মোহাম্মদপুরের টাউনহল মার্কেটের পাশের গলিগুলোতে বড় কয়েকটি দোকানের সামনেই টুল পেতে বসে আছেন দোকান কর্মীরা। কোনো দোকানের শাটার কিছুটা খোলা আবার অনেক দোকানের শাটার বন্ধ। ক্রেতারাও আসছেন, কথা বলছেন দোকানকর্মীর সঙ্গে। দামদরে মিললে বা প্রয়োজনীয় পণ্য থাকলে ক্রেতাকে নিয়ে দোকানে ঢুকে শাটার নামিয়ে দিচ্ছেন। কিছু সময় পরে প্রয়োজনীয় পণ্য নিয়ে আবার বেরিয়ে আসছেন ক্রেতা। ওই এলাকায় ৩০ মিনিট পর্যবেক্ষণ করে এমন চিত্র দেখা গেছে।
প্রধান সড়ক থেকে একটু ভেতরের গলিগুলোতে বেশিরভাগ দোকানই খোলা রাখতে দেখা গেছে। সেখানে লোকজনের আনাগোনাও রয়েছে বেশ। দোকানিরা বলেন, দিনে দু-একবার পুলিশ টহল দিতে আসে। পুলিশ আসার খবর পেলে পুরো এলাকা নির্জন হয়ে যায়। দোকানপাট বন্ধ করে দেওয়া হয়।
মোহাম্মদপুর এলাকার একটি টেইলার্সের কাটিং মাস্টার হিমেল বিশ্বাস ঢাকা পোস্টকে বলেন, সামনে ঈদ। মানুষজন জামা বানাতে আসছেন। দোকান বন্ধ দেখে ফোন করেন। সবাই দোকানে ভিড় করেন না। এসে মাপ আর কাপড় দিয়ে যান। আমরা দোকানে বসেই বানাই। সরকারের নিষেধাজ্ঞা আছে, তবুও কাজ করতে হয়। চলতে তো হবে।
টাউন হল এলাকার রঙের দোকানের মালিক জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, সাধারণ সময়ে প্রতিদিন প্রায় ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা বিক্রি হয়। দোকানে কর্মচারী আছে তিনজন। সামনে ঈদ। দোকান বন্ধ থাকলেও, দোকান ভাড়া, কর্মচারীর বেতন, পরিবারের খরচ সব মিলিয়ে অনেক টাকা প্রয়োজন। দোকান বন্ধ থাকলে ব্যাপক আর্থিক ক্ষতি হবে। শুনেছিলাম লকডাউন হবে সাত দিন। এখন আবার আরও সাত দিন বাড়িয়েছে। যদি এ মাসের পুরো সময় লকডাউন হয়, দোকান বন্ধ থাকে, তবে আর্থিক ক্ষতি কাটানো কষ্টকর হয়ে যাবে। তাই, চুপিসারে দোকান খোলা রাখতে হচ্ছে। যদিও কাস্টমার একবারেই কম, তবুও দু-এক জন আসেন মাঝে মধ্যে।
অ্যালুমিনিয়ামের দোকানের মালিক সালাম বলেন, যদিও এখন কাজ কম হচ্ছে। তবুও কর্মচারী দিয়ে দোকান খোলা রাখা হচ্ছে। সবকিছু বন্ধ থাকলেও মানুষের প্রয়োজন তো বন্ধ নেই। মাঝে মধ্যে দু-একজন আসেন। সরকার তো ‘বন্ধ’ বলেই খালাস। কিন্তু আমাদের দেখবে কে?
এমএইচএন/আরএইচ/জেএস