মেট্রোরেল প্রকল্পে ৭৩৪ জন করোনায় আক্রান্ত
ঢাকা মহানগর ও তার আশপাশে মেট্রো রেলপথ নির্মাণের জন্য কর্মরত দেশি-বিদেশি জনবলের মধ্যে এ পর্যন্ত ৭৩৪ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। আক্রান্তদের ৭৫ শতাংশই উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত নির্মাণাধীন এমআরটি লাইন-৬ প্রকল্পে যুক্ত।
মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়নে সমন্বয়কারী সংস্থা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) এর জুন মাসের প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
এ বিষয়ে বৃহস্পতিবার (১ জুলাই) ডিএমটিসিএল এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন ছিদ্দিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনা মোকাবিলায় আমরা সরকারি নির্দেশনা মেনে কার্যক্রম পরিচালনা করছি। এটা ঠিক যে, মেট্রোরেল প্রকল্পে নিয়োজিতদের মধ্যে করেনার সংক্রমণ আগের চেয়ে বেড়েছে।
তিনি বলেন, সংক্রমণ বেড়েছে ভাইরাসের নতুন ধরনের প্রভাবে। আমরা এখন পরিচয়পত্র দেখানো সাপেক্ষে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের প্রকল্প এলাকায় প্রবেশ করতে দিচ্ছি। বিধিনিষেধে তাদের চলাচলের জন্য পুলিশের কাছে তালিকা দেওয়া হয়েছে। এখানে সামাজিক দূরত্ব মেনে কাজ পরিচালনা করা হচ্ছে।
এম এন এন ছিদ্দিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রকল্পে যুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী-শ্রমিকদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। গাবতলী কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে ১০ শয্যার এবং উত্তরার পঞ্চবটি কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে ১৪ শয্যার হাসপাতাল রয়েছে।
তিনি বলেন, প্রকল্পের নির্মাণ কাজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের জনবলের নিরাপদ অবস্থানের জন্য নির্মাণস্থলের কাছে আবাসিক স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। ডিএমটিসিএল সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পে কর্মরত দেশি জনবলকে অনলাইন নিবন্ধনের মাধ্যমে টিকার প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হয়েছে। বিদেশি জনবলকে অনলাইন নিবন্ধনের মাধ্যমে ভ্যাকসিন দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।
গত এপ্রিল মাসের অগ্রগতি প্রতিবেদন থেকে জানা গিয়েছিল, তখন পর্যন্ত প্রকল্পের কাজে যুক্ত থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে ৬৬১ জন করোনায় আক্রান্ত ছিলেন। গত এপ্রিলেই করোনায় আক্রান্ত হন ২১৯ ব্যক্তি। সেসময় ডিএমটিসিএল কর্তৃপক্ষ মাঠ পর্যায়ের দুটি হাসপাতালের শয্যা বাড়ানোসহ দলবদ্ধ জনবল ২৫ থেকে নামিয়ে ১০ জন করেছিল। এখনও সেই ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করা হচ্ছে।
উত্তরা-কমলাপুর মেট্রোরেল প্রকল্পে প্রায় সাত হাজার বিদেশি কাজ করছেন। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পে যুক্ত ৩২১ ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত হন। গত বছর আক্রান্তের হার এ বছরের চেয়ে কম ছিল।
গত বছরের মার্চে দেশে করোনার সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় বিদেশি অর্থায়নের বিভিন্ন প্রকল্পে যুক্ত বিদেশিরা নিজ নিজ দেশে চলে যান। সংক্রমণ কমে এলে তারা বাংলাদেশে ফিরে আসেন। মেট্রোরেল প্রকল্পে যুক্ত জাপানি ও ইতালিয় বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি অন্যান্য কর্মীরাও গত বছর সংক্রমণ শুরুর পর নিজ নিজ দেশে চলে যান। পরে সংক্রমণ কমলে গত আগস্ট থেকে তারা বাংলাদেশে ফিরে কাজে যুক্ত হন। এ বছর গত মার্চের শেষ দিক থেকে করোনায় সংক্রমণ আবারও বেড়ে যেতে শুরু করে।
এগিয়ে চলছে এমআরটি লাইন-৬
ডিএমটিসিএল এর গত জুন মাসের অগ্রগতি প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, প্রকল্পের প্যাকেজ-১ এর অধীনে উত্তরার দিয়াবাড়িতে ভূমি উন্নয়ন কাজ চলছে। ২০১৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর এ অংশে কাজ শুরু হয়। তা নির্ধারিত সময়ের নয় মাস আগে ২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারি শেষ হয়েছে। এতে সরকারের ৭০ কোটি ৫৮ লক্ষ টাকা সাশ্রয় হয়েছে।
প্যাকেজ-২ এর অধীনে উত্তরার দিয়াবাড়ি এলাকার পুর্ত কাজ ২০১৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর শুরু হয়। ডিপোর ভেতরে নির্মাণের জন্য নির্ধারিত ৫২টি অবকাঠামোর ২৪টির নির্মাণ কাজ পরিপূর্ণভাবে শেষ হয়েছে। সব স্থাপনার চারপাশে একই ধরনের সিরামিক টাইলস দিয়ে স্থাপত্যশৈলীর কাজ চলছে। এর অগ্রগতি ৯৪ শতাংশ। এ অংশের সার্বিক বাস্তব অগ্রগতি ৯৫ শতাংশ।
প্যাকেজ-৩ ও ৪ এর অধীনে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট ও ৯টি স্টেশন নির্মাণ কাজ চলছে। উভয় প্যাকেজের কাজ ২০১৭ সালের ১ আগস্ট শুরু হয়। এর মধ্যে পরিষেবা স্থানান্তর, চেকবোরিং, টেস্ট পাইল, মূল পাইল, পাইল ক্যাপ, আই-গার্ডার, প্ৰিকাস্ট সেগমেন্ট কাস্টিং, পিয়ার হেড, ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট, পাঁচটি বড় স্প্যান নির্মাণ, সব রেলস্টেশনের নিচের ভিত্তি তৈরির কাজ শেষ হয়েছে।
উত্তরা উত্তর, উত্তরা সেন্টার, উত্তরা দক্ষিণ, পল্লবী ও মিরপুর-১০ রেলস্টেশনে কনকোর্স ছাদের কাজ শেষ হয়েছে। বর্তমানে মিরপুর-১১, কাজীপাড়া ও শেওড়াপাড়া এবং আগারগাঁওয়ে রেলস্টেশনগুলোর কনকোর্স ছাদ নির্মাণ কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এই দুই প্যাকেজের অধীনে সার্বিক কাজের অগ্রগতি হয়েছে ৮২ দশমিক ১৭ শতাংশ।
প্যাকেজ-৫ এর অধীনে আগারগাঁও থেকে কারওয়ান বাজার পর্যন্ত ৩ দশমিক ১৯৫ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট ও তিনটি স্টেশন নির্মাণ কাজ চলছে। এখানকার বাস্তব কাজ ২০১৮ সালের ১ শুরু করা হয়েছিল। বর্তমানে এ অংশে পরিষেবা স্থানান্তর, চেকবোরিং, ট্রায়াল ট্রেঞ্চ, টেস্ট পাইল, পিয়ার কলাম ও পিয়ার হেড নির্মাণসহ অন্যান্য কাজ শেষ হয়েছে। বিজয় সরণি, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজারে রেল স্টেশনের নির্মাণ কাজ চলছে। এ অংশে সার্বিক কাজ এগিয়েছে ৭০ দশমিক ৩ শতাংশ।
প্যাকেজ-৬ এর অধীন কারওয়ান বাজার থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ৪ দশমিক ৯২২ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট ও চারটি রেলস্টেশন নির্মাণ কাজ চলছে। ২০১৮ সালের ১ আগস্ট থেকে এখানে ভৌত কাজ শুরু করা হয়। বর্তমানে এ অংশে পরিসেবা স্থানান্তর, চেকবোরিং, ট্রায়াল ট্রেঞ্চ, টেস্ট পাইল, পিয়ার হেড ও পিয়ার কলামের কাজ শেষ হয়েছে। মোট ২৯৮টি পাইল ক্যাপের মধ্যে ২৭০টি বসানো হয়েছে। ১ হাজার ৭৬৪টি প্ৰিকাস্ট সেগমেন্টের মধ্যে ১৬০৭টি সেগমেন্ট কাস্টিং শেষ হয়েছে। বর্তমানে শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ সচিবালয় ও মতিঝিলে রেল স্টেশন নির্মাণ কাজ চলছে। এখানে ২ দশমিক ৪৩৮কিলোমিটার ভায়াডাক্ট দৃশ্যমান হয়েছে। এ অংশে কাজ এগিয়েছে ৭০ দশমিক ৪৬ শতাংশ।
প্যাকেজ ৭ এর অধীনে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড মেকানিক্যাল সিস্টেম এর কাজ চলছে। উত্তরা ডিপোয় রিসিভিং সাব-স্টেশনের পূর্ত কাজ শেষ করে বিদ্যুতায়নের কাজ শেষ করা হয়েছে। মতিঝিল রিসিভিং সাব-স্টেশন এর ভবন নির্মাণ কাজ চলছে।
প্যাকেজ-৮ এর অধীনে রেল কোচ ও ডিপোয় যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করা হচ্ছে। প্রথম মেট্রো ট্রেন সেট গত ২৩ এপ্রিল উত্তরার ডিপোয় পৌঁছে। প্রথম মেট্রোট্রেন সেট গ্রহণ করে পরিচালনার কাজ শেষ হয়েছে। বর্তমানে ডিপোতে তার পরীক্ষামূলক পরিচালনা চলছে। তারপর ভায়াডাক্টের ওপর মূল রেলপথে আগামী আগস্টে পরীক্ষামুলকভাবে ট্রেন পরিচালনা করার কথা রয়েছে।
ডিএমটিসিএল সূত্রে জানা গেছে, দ্বিতীয় মেট্রো ট্রেন সেট গত ৩ জুন উত্তরার ডিপোতে পৌঁছে। মেট্রোরেলের তৃতীয় ও চতুর্থ সেট গত ২২ জুন জাপানের কোবে সমুদ্রবন্দর থেকে জাহাজযোগে বাংলাদেশের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। উভয় ট্রেনসেট মোংলা বন্দরে এসে পৌঁছানোর কথা রয়েছে এ মাসের শেষ সপ্তাহে। এরপর এগুলো বার্জযোগে নদীপথে আগস্ট মাসের তৃতীয় সপ্তাহে ঢাকার উত্তরার ডিপোতে আনা হবে।
ঢাকা মহানগর ও তার আশপাশে ছয়টি মেট্রো রেলপথ নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে সরকার। মেট্রো রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কাজ এগিয়েছে উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত। গত ৩০ জুন পর্যন্ত এ প্রকল্পের কাজ হয়েছে ৬৭ দশমিক ৬৩ শতাংশ। এছাড়া এমআরটি লাইন-১ এর অধীনে বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর রেলস্টেশন পর্যন্ত একটি অংশ ও নতুন বাজার থেকে পিতলগঞ্জ পর্যন্ত দুটো অংশে রেলপথ হবে। এ প্রকল্পের ডিপো উন্নয়নের জন্য গত মাসে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। বাকি প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় রয়েছে।
পিএসডি/আরএইচ