ভ্যাকসিন সংগ্রহ সুনির্দিষ্ট ও সুনিশ্চিত বলা যায় না : জিএম কাদের
আমাদের দেশে ভ্যাকসিন সংগ্রহ এখন পর্যন্ত প্রকৃত অর্থে সুনির্দিষ্ট ও সুনিশ্চিত বলা যায় না বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় উপনেতা গোলাম মোহাম্মদ (জি এম) কাদের।
মঙ্গলবার (২৯ জুন) জাতীয় সংসদে প্রস্তাবিত ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি এ মন্তব্য করেন।
গোলাম মোহাম্মদ কাদের বলেন, ভ্যাকসিন দেওয়ার কাজ পুনরায় শুরু ও শেষ কীভাবে হবে কেউ জানে বলে মনে হয় না। অনেক দেশের মতো আমাদের দেশেও একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ভাকসিন তৈরিতে বেশ কিছু সাফল্য দেখিয়েছে বলে গণমাধ্যমের খবরে জানা যায়। কিন্তু সরকারি সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার অসহযোগিতার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। যাতে করে সে উদ্যোগটি মুখ থুবড়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে। এ বিষয়ে সরকারি হস্তক্ষেপ ও জরুরি সহায়তা দেওয়া গেলে হয়ত আমরা দেশীয় ভ্যাকসিন তৈরি করতে সক্ষম হব। উদ্যোগটি সমস্যা উত্তরণে ব্যাপকভাবে সহায়তা করতে পারে।
তিনি বলেন, গত ২৭ জুন রাতে মগবাজারের একটি ভবনে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটেছে। সে বিস্ফোরণে যারা মারা গেছেন তাদের রুহের মাগফেরাত কামনা করছি। যারা আহত হয়েছেন এবং চিকিৎসাধীন আছেন তাদের সুস্থতা কামনা করছি। চিকিৎসাধীনদের সুচিকিৎসা দেওয়ার দাবি করছি। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি।
জি এম কাদের বলেন, কোভিড-১৯ মহামারির কারণে জীবিকা হারিয়েছে কোটি কোটি মানুষ। তাদের মধ্যে যারা হতদরিদ্র তাদের না খেয়ে থাকার অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। জীবিকা হারিয়ে নতুন দরিদ্র সৃষ্টি হয়েছে প্রায় ২ কোটি ৫০ লাখ মানুষ এবং প্রতিদিন এর সংখ্যা বাড়ছে। করোনার কারণে লকডাউন ও ব্যবসা বাণিজ্যে মন্দা দীর্ঘস্থায়ী হলে দেশে দুর্ভিক্ষের অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে। সেখানেও জীবন বিপন্ন হবে। আর্থিক ও খাদ্য সহায়তা দিয়ে এসব দরিদ্র ও নব্য দরিদ্রদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। এখানে সমাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনির আওতা অনেক বাড়াতে হবে। অর্থের প্রয়োজন বাড়বে।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান বলেন, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এ বছরের বাজেট বৃদ্ধি করা হয়েছে ১৪ শতাংশ। শুধুমাত্র কোভিড-১৯ টিকার জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩৫ হাজার কোটি রুপি। কেবলমাত্র স্বাস্থ্যখাতে ভারতে বাড়ানো হয়েছে ১৩৭ শতাংশ বা ১,২৩,৩৯৪ কোটি টাকা। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে এ সংখ্যা আরো বেশি। সেভাবে দেখলে সত্যিকারভাবে আমাদের ২০২১-২২ বাজেটে জীবন ও জীবিকার প্রাধান্য যথেষ্ট আছে বলা যায় না।
তিনি বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতি পূরণের উৎসগুলো দুর্বল ও অনিশ্চিত। ঘাটতি পূরণে বৈদেশিক উৎস থেকে প্রাপ্তি ৯৭ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা ধরা হয়েছে; বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় বিষয়টি অনিশ্চিত। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার প্রস্তাব ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা। দেশীয় ব্যাংকগুলোর বেশিরভাগ রুগ্ন। এগুলোর ওপর নির্ভরশীল হওয়া কতটা বাস্তব সম্মত? তাছাড়া এতে ব্যাংকের তারল্য সংকট বাড়ার আশঙ্কা থাকে। সেক্ষেত্রে সাধারণ ব্যবসায়ীরা ব্যবসায় পুঁজি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ব্যাংক ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে সংকট বাড়বে। ফলস্বরূপ ব্যবসা সার্বিকভাবে সংকুচিত হবে, কর্মসংস্থান কমবে। সার্বিকভাবে বলা যায় বাজেটের ঘাটতি পূরণ প্রায় অনিশ্চিত। ফলে প্রস্তাবিত বাজেটে খাতভিক্তিক বরাদ্দের সংকুলান যথাযথ নাও হতে পারে।
জিএম কাদের বলেন, করোনাকালীন সময়ে জীবিকা হারিয়ে নতুন বেকার হওয়া ২ কোটি ৫০ লাখ এবং আগের কর্মহীন বেকারদের জন্য জীবন রক্ষা ও জীবিকার কোনো ব্যবস্থা প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থমন্ত্রী রেখেছেন বলে চোখে পড়েনি। যতটুকু বরাদ্দ হয় সে বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের আওতাধীন জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল এর চলতি বছরের মাঠ জরিপের ফলে বলা হয়েছে সামাজিক সুরক্ষা খাত থেকে সাহায্য প্রাপ্ত মানুষের মধ্যে ৪৬ শতাংশ সরকারি কোনো সাহায্য পাওয়ার উপযুক্ত নয়। অর্থাৎ প্রায় অর্ধেক প্রাপক অনিয়মের মাধ্যমে প্রকৃত প্রাপককে বঞ্চিত করে এ সুবিধাটি ভোগ করছেন।
তিনি বলেন, গণমাধ্যমে প্রকাশিত স্বাস্থ্যখাতের অনিয়ম এখন দেশব্যাপী আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু দুর্নীতি কমানোর জন্য কোনো কার্যকর উদ্যোগ চোখে পড়ে না। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রীসহ দায়িত্বপ্রাপ্তরা দুর্নীতির বিষয়টি আমলে নিচ্ছেন বলে মনে হয় না। অভিযোগগুলো গুরুতর। দেশবাসী আশা করে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে যথাযথ তদন্ত হবে ও দোষীদের শাস্তির আওতায় আনা হবে।
বিরোধী দলীয় উপনেতা বলেন, যতই অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হোক সুশাসন না থাকলে দুর্নীতি, অপচয় ও সমন্বয়হীনতার কারণে বাজেট বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না। সুশাসন না থাকলে অর্থ বরাদ্দের সুফল যাদের উদ্দেশ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয় তারা লাভ করেন না। এক কথায় সুশাসন ছাড়া বাজেট তৈরি ও বাস্তবায়ন সম্পূর্ন অর্থহীন। বাজেটের উদ্দেশ্য জীবনমানের উন্নয়ন। শান্তি, স্বস্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ছাড়া মানুষের জীবনমান উন্নয়ন সম্ভব হয় না। সুশাসনের মাধ্যমেই সেটা সম্ভব। এ বিষয়ে বাজেটে কোনো দিক নির্দেশনা নেই। বরং সুশাসনে ব্যত্যয়ের সুযোগ বাজেটে রাখা হয়েছে। কিছু উদাহরণ দেওয়া গেল।
জিএম কাদের বলেন, কালো টাকা সাদা করার যে সুযোগ রাখা হয়েছে সেটা দুর্নীতিকে বৈধতা দেওয়ার সামিল এটি সুশাসনের পরিপন্থি। এ বিষয়টি নিশ্চিতভাবে দুর্নীতিকে উৎসাহিত করবে। যে কারণে এ সুযোগ রাখা হয়েছে বলা হয় সেটা হল দেশে বিনিয়োগবৃদ্ধি ও বিদেশে টাকা পাচার বন্ধ করা। বেশ কয়েকটি বাজেটে কিছুদিন থেকে এ সুযোগ দেওয়া হয়ে আসছে। ফলাফল শূন্য। বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট গত পাঁচ বছরে ১ হাজার ২৪টি অর্থপাচার ঘটনার প্রমাণ পেয়েছে।
তিনি বলেন, বিএফআইইউ সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কাছে অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তথ্য প্রমাণসহ প্রতিবেদন পাঠিয়েছে। ফলাফল এখন পর্যন্ত কারো বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এমন কোনো তথ্য নেই। অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ বৈধতা দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর দুর্নীতির বিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কালো টাকা সাদা করার তা যেকোনো শর্তেই হোক বন্ধ করা উচিত বলে মনি করি।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান বলেন, আমাদের ব্যাংকিং ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অত্যন্ত নাজুক অবস্থার মধ্য দিয়ে চলছে। বাংলাদেশ ব্যংকের রিপোর্ট অনুযায়ী খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। বংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি, হলমার্কের ৪ হাজার কোটি টাকা অর্থ লোপাট, বিসমিল্লাহ্ গ্রুপের আর্থিক অনিয়ম এবং বেসিক ব্যাংকের অনাদায়ী খেলাপি ঋণ উদ্ধারের বিষয়ে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ এখনও দৃশ্যমান নয়। ২০১৮-২০২১ এই স্বল্প সময়ে ৫৯ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকার অনিয়ম চিহ্নিত করেছে সরকারি প্রতিষ্ঠান কম্প্রোট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি)। তাদের তথ্য মতে এ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া আর্থিক অনিয়মের ৫২.১৮ শতাংশই হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকিং খাতের। যার পরিমাণ ৩১ হাজার কোটি টাকা।
গোলাম মোহাম্মদ কাদের বলেন, মহামারি কোভিড-১৯ এর কারণে দীর্ঘদিন শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ থাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দূরশিক্ষণ কার্যক্রম প্রবর্তন করা প্রয়োজন। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে প্রযুক্তিগত সুবিধার আওতায় নিয়ে আসা ও প্রত্যেক শিক্ষার্থীর হাতে ডিজিটাল যন্ত্র তুলে দেওয়ার বিষয়টি বাজেটে নেই। বাজেটে উচ্চ শিক্ষায় ১৫ শতাংশ কর আরোপ করা (বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল শিক্ষা) হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এই খরচ শিক্ষার্থীদেরই বহন করতে হবে। এতে উচ্চ শিক্ষার ব্যয় বেড়ে যাবে ফলে উচ্চ শিক্ষার প্রসার বাধাগ্রস্ত হবে। এটা আরোপ না করার সুপারিশ করছি।
তিনি বলেন, করোনা মহামারির শুরু থেকে এখন পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। সে কারণে উচ্চ শিক্ষার শিক্ষার্থীরা শিক্ষা জীবন শেষ করতে পারেননি। আবার লকডাউনের কারণে অফিস আদালতের কার্যক্রম সীমিত হওয়ায় সরকারি চাকরির নিয়োগ কার্যক্রম থমকে আছে। এসব কারণে অনেকের সরকারি চাকরিতে প্রবেশের নির্ধারিত বয়স ৩০ পার হয়েছে, অনেকের পার হওয়ার পথে। এসব কারণে তারা চাকরিতে প্রবেশের বয়স বৃদ্ধি করে ৩২ বছর করার দাবি জানিয়েছেন। বিষয়টি বিবেচনার পক্ষে যুক্তি আছে মনে করি।
সংসদ উপনেতা বলেন, সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের গাড়ি কেনার জন্য বিনা সুদে ৩০ লাখ টাকা ঋণ দেওয়া হয় এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দেওয়া হয় মাসিক ৫০ হাজার টাকা। এ সুবিধা সরকার থেকে দেওয়ার উদ্দেশ্য যাতে পরে সুবিধাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের সরকারি পরিবহন পুলের গাড়ি ব্যবহার না করতে হয়। কিন্তু বিভিন্ন সূত্রে জানা যায় এ নিয়মে সুবিধাপ্রাপ্তদের বেশিরভাগ সরকারি ঋণে গাড়ি কেনার পরও সরকারি পরিবহন পুলের এক বা একাধিক গাড়িও ব্যবহার করছেন। প্রকৃতপক্ষে এটিকে রাষ্ট্রের জন্য অনেক বড় অপচয় বলা যায়। এধরনের সরকারি দায়িত্বশীলদের মাধ্যমে জনগণের অর্থ অপচয়ের আরও বিভিন্ন তথ্য শোনা যায়। বিষয়গুলোর দিকে সরকারকে বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে। এখানে অর্থ সাশ্রয় হলে সে অর্থে অনেক অতি প্রয়োজনীয় জনকল্যাণমূলক ব্যয়ে বাজেটে বরাদ্দ বৃদ্ধি সম্ভব হবে।
এইউএ/জেডএস