বিশ্বনন্দিত বিজ্ঞানী পরিচয়ে কোটি টাকার প্রতারণা
মো.সাইফুল ইসলাম ওরফে বিজ্ঞানী সাইফুল নিজেকে পরিচয় দিতেন বিশ্বনন্দিত বিজ্ঞানী হিসেবে। জলবায়ু সংক্রান্ত তার বিভিন্ন প্রজেক্ট সারা বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে বলেও দাবি করতেন তিনি। তার উদ্ভাবিত প্রজেক্টে মধ্যপ্রাচ্য, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশের কোম্পানি বিনিয়োগ করতে চায় বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার। এসব কথা বলে দেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষকে তার ভুয়া প্রজেক্টে বিনিয়োগের জন্য উৎসাহিত করতেন সাইফুল।
ভিকটিমদের বিশ্বাস অর্জনের জন্য রাজা-বাদশা নামে একটি ভুয়া প্রতিষ্ঠানও খোলেন সাইফুল। আর এই প্রতিষ্ঠানের নামে ভিকটিমদের বিনিয়োগে উৎসাহিত করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন ভুয়া বিজ্ঞানী সাইফুল ইসলাম।
সাইফুল ইসলামের প্রতারণা শিকার কয়েকজন ভিকটিম এ বিষয়ে র্যাবের কাছে অভিযোগ করেন। অভিযোগ পাওয়ার পর র্যাব সাইফুল ইসলাম ও তার চক্রের বিষয়ে গোয়েন্দা নজরদারি শুরু করে। র্যাবের নজরদারি ও তদন্তে ভিকটিমদের অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। পরে মঙ্গলবার (১৫ জুন) রাজধানীর উত্তরায় রাজা-বাদাশার কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে সাইফুল ইসলামসহ ১৬ প্রতারককে আটক করে র্যাব।
আটক প্রতারকরা হলেন : মো. সাইফুল ইসলাম ওরফে বিজ্ঞানী সাইফুল ওরফে সায়েন্টিস্ট সাইফুল (৫৪), মোছা. বকুলি ইয়াসমিন (৪৬), মো. ইমরান রাজা (২৫), মোছা. কাকুলী আক্তার (১৯), মো. রোমান বাদশা (১৮), মো. আনিসুজ্জামান সিদ্দীকী (৫৩), মো. নাজমুল হক (৩০), মো. তারেক আজিজ (৪০), মো. বেল্লাল হোসেন (৬১), মো. আব্দুল মান্নান (৫০), মো. শিমুল মিয়া (২৪), মো. নুরনবী (৪৫), মো.আবুল হাশেম (৪২), মো. আলী হোসেন (৩৮), মো. শওকত আলী (৫০) ও মো. রোকনুজ্জামান (৫০)।
এ সময় তাদের কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, ১ একটি ম্যাগজিন, ২ রাউন্ড গোলাবারুদ, ২ বোতল বিদেশি মদ, ৬টি সিল, নগদ ৪৫ হাজার ৪৬০ টাকা, ২০টি মোবাইল ফোন, ১৪টি চেক বই, ১২টি ভিজিটিং কার্ড, ৬টি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের চিঠি, বিভিন্ন মূল্যের ১২১টি জাল স্ট্যাম্প, ৩টি চুক্তিনামা দলিল, ৩টি বই, ৯টি স্বাক্ষরিত চেক ও বিদেশি নেতাদের সঙ্গে পত্রালাপের ভুয়া কপি জব্দ করা হয়েছে।
বুধবার (১৬ জুন) বিকেলে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে অবস্থিত র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির সদর দফতরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এসব কথা বলেন।
খন্দকার আল মঈন বলেন, বর্তমান বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও প্রতিকার বিশ্বব্যাপী একটি বহুল আলোচিত বিষয় । এই তথ্যকে পুঁজি করে ভুয়া বিজ্ঞানী সাইফুল ইসলাম একটি প্রতারণার ফাঁদ তৈরি করে। জ্বালানিবিহীন জেনারেটর তৈরি ও পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপন, জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর গবেষণা ও প্রভাব প্রতিকার প্রজেক্ট তৈরি করার কথা বলেন সাইফুল ইসলাম। এছাড়া করোনা প্রতিরোধক কয়েল উদ্ভাবনসহ অন্যান্য অভিনব আবিষ্কারেরও কথা বলেন তিনি। তার এসব প্রজেক্টে দেশি বিদেশি সংস্থার ফান্ডও পেয়েছেন বলে ভিকটিমদের বলতেন। এসব কথা বলে তিনি সাধারণ মানুষকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলতেন।
তিনি বলেন, সাইফুল ইসলাম ২০১১ সালে রাজা-বাদশা নামে একটি প্রতিষ্ঠান খোলেন। ওই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি দীর্ঘ দিন ধরে প্রতারণা করে আসছিলেন। তিনি নিজেকে একজন আন্তর্জাতিক স্বনামধন্য বিজ্ঞানী হিসেবে পরিচয় দিয়ে ভিকটিমদের প্রলুব্ধ করতেন। তিনি ভিকটিমদের বলতেন, বিদেশে তার বিভিন্ন আবিষ্কার ও গবেষণা ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে। এছাড়া তার প্রতিষ্ঠান জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রতিকার ও জ্বালানিবিহীন জেনারেটর দ্বারা পরিচালিত পাওয়ার প্ল্যান্ট ও করোনা প্রতিরোধ ব্যবস্থার উদ্ভাবন ও বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে। তিনি ভিকটিমদের কাছে বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপন করতেন যে, করোনা প্রতিরোধে তার কয়েল টেকনিক পদ্ধতি বিশ্বব্যাপী করোনা প্রতিরোধে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।
তিনি আরও বলেন, সাইফুল ইসলাম ভিকটিমদের বলতেন, তার প্রজেক্টগুলো বাস্তবায়নে রাষ্ট্রীয় নীতিগত সিদ্ধান্ত প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এ সংক্রান্তে বিভিন্ন ভুয়া পত্রালাপগুলো তিনি উপস্থাপন করতেন। তার সঙ্গে বিদেশি বিজ্ঞানী, গবেষক ও নেতৃবৃন্দের যোগাযোগ রয়েছে বলেও দাবি করতেন। যারা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে সম্মত রয়েছেন বলে মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন করতেন।
র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, ভিকটিমরা তার এসব কথায় প্রভাবিত হয়ে ভুয়া প্রজেক্টে টাকা বিনিয়োগ করতেন। এভাবে তিনি অনেকের কাছ থেকে প্রতারণা করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে অফিসের ঠিকানা পরিবর্তন করে উধাও হয়ে যেতেন। প্রজেক্টসমূহের যেকোনো একটিতে ২৫ হাজার টাকা অর্থ বিনিয়োগে করলে কোটি টাকার অফার এবং জমি প্রদানে প্রজেক্টের মালিকানা শেয়ার অফার দিতেন তিনি। স্বল্প শিক্ষিত ধনী ব্যবসায়ী ও জমিজমা সম্পত্তির মালিকদের তিনি টার্গেট করতেন। সাইফুল ইসলাম ও তার চক্র এখন পর্যন্ত শতাধিক ব্যক্তির সঙ্গে প্রতারণা করেছে।
তিনি বলেন, ইতিমধ্যে উপকূলীয় অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রজেক্টের আওতায় নোয়াখালীতে প্রায় ৪৫০ বিঘা জমি ছাড়াও লক্ষ্মীপুর, রাজশাহী এবং ময়মনসিংহের ভালুকায় আরও সহস্রাধিক বিঘা জমি প্রতারণার মাধ্যমে আত্মসাতের চেষ্টা করছিলেন তিনি।
এমএসি/এসকেডি