স্ত্রীকে ২ কোটি টাকার ফ্ল্যাট উপহার, ফাঁসলেন সাব-রেজিস্ট্রার
মোসাম্মৎ ইসরাত জাহান। পেশায় গৃহিণী। কিন্তু কাগজে-কলমে তাকে ব্যবসায়ী হিসেবে দেখানো হয়েছে। এর পেছনে কারণও আছে। কিছু না করেই তিনি প্রায় দুই কোটি টাকা মূল্যের তিনটি ফ্ল্যাট; নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ ও পটুয়াখালীতে ৪২ শতাংশ জমির মালিক হয়েছেন। ৪৫ লাখ টাকার পারিবারিক সঞ্চয়পত্র এবং ব্যাংকে নগদ ৩৫ লাখ টাকা জমাও আছে তার নামে।
প্রশ্ন উঠেছে, ঘরের কাজের বিনিময়ে এত সম্পদের মালিক কীভাবে হলেন তিনি? এজন্য স্বামী মো. মজিবুর রহমানকে কৃতিত্ব দিতে হয়। পেশায় তিনি সাব-রেজিস্ট্রার। বর্তমান কর্মস্থল ঝালকাঠি সদর। স্ত্রীকে এতটাই ভালোবাসেন যে ঘুষের টাকায় অঢেল সম্পদের মালিক বানিয়েছেন তাকে!
স্ত্রী ইসরাতকে ঢাকার শ্যামপুর থানার জুরাইনের কেয়ারীনগর অ্যাপার্টমেন্ট প্রজেক্টে হাজার বর্গফুটের তিনটি ফ্ল্যাট উপহার দিয়েছেন। যার বাজারমূল্য প্রায় দুই কোটি টাকা। শুধু কী তাই! স্ত্রীর নামে ৪৫ লাখ টাকার পারিবারিক সঞ্চয়পত্র এবং তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ৩৫ লাখ টাকা জমাও রেখেছেন তিনি। এছাড়া ইসরাত জাহানের নামে নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ ও পটুয়াখালীতে ৪২ শতাংশ জমি কিনে দিয়েছেন সাব-রেজিস্ট্রার স্বামী মজিবুর রহমান।
স্ত্রীর প্রতি এমন ভালোবাসার উদ্দেশ্য কী— বিষয়টি তদন্তে মাঠে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তদন্তে বেরিয়ে আসে ‘অবৈধ আয় বৈধ করতে’ স্ত্রীর প্রতি এমন ভালোবাসা প্রদর্শন।
নারায়ণগঞ্জ জেলার ফতুল্লা থানার ভূঁইঘর মৌজায় ৩.৭০ শতাংশ জমি, মুন্সিগঞ্জের লৌহজংয়ে ১০ শতাংশ জমি এবং পটুয়াখালী জেলার বাউফলে ২৯ শতাংশ জমি রয়েছে ইসরাতের নামে। এছাড়া ঢাকার শ্যামপুর থানার জুরাইনের কেয়ারীনগর অ্যাপার্টমেন্ট প্রজেক্টে ১০১৬ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট (বিল্ডিং নং- ৭, ফ্ল্যাট নং- ই ৪), একই প্রজেক্টে ১০৬৯ বর্গফুটের আরও একটি ফ্ল্যাট (বিল্ডিং নং- ৭ , ফ্লাট নং- এ ৪) এবং ৫৮৩ বর্গফুটের পৃথক একটি ফ্ল্যাটের মালিক গৃহিণী ইসরাত। রয়েছে ৪৫ লাখ টাকার পারিবারিক সঞ্চয়পত্র এবং ব্যাংকে নগদ জমা আছে ৩৫ লাখ টাকা।
দুদক সূত্রে জানা যায়, অবৈধ সম্পদ বৈধ করতে স্ত্রীর নামে ব্যবসায়িক জাল কাগজপত্র তৈরি করেন স্বামী মো. মজিবুর রহমান। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। তার এমন অপকর্মের ভুক্তভোগী হয়েছেন স্ত্রী। এখন দুর্নীতি মামলার প্রধান আসামি স্ত্রী ইসরাত। সহযোগী হিসেবে আসামি করা হয়েছে সাব-রেজিস্ট্রার স্বামী মো. মজিবুর রহমানকে।
গত ১০ জুন অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মো. মজিবুর রহমান ও তার স্ত্রী ইসরাত জাহানকে আসামি করে মামলা করা হয়। দুদকের সহকারী পরিচালক আতাউর রহমান সরকার বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন।
দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা উপপরিচালক মুহাম্মদ আরিফ সাদেক ঢাকা পোস্টকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, মামলায় তাদের বিরুদ্ধে এক কোটি ৫৩ লাখ ৭৭ হাজার টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়েছে।
দুদক সূত্রে জানা যায়, নারায়ণগঞ্জ জেলার ফতুল্লা থানার ভূঁইঘর মৌজায় ৩.৭০ শতাংশ জমি, মুন্সিগঞ্জের লৌহজংয়ে ১০ শতাংশ জমি এবং পটুয়াখালী জেলার বাউফলে ২৯ শতাংশ জমি রয়েছে ইসরাতের নামে। এছাড়া ঢাকার শ্যামপুর থানার জুরাইনের কেয়ারীনগর অ্যাপার্টমেন্ট প্রজেক্টে ১০১৬ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট (বিল্ডিং নং- ৭, ফ্ল্যাট নং- ই ৪), একই প্রজেক্টে ১০৬৯ বর্গফুটের আরও একটি ফ্ল্যাট (বিল্ডিং নং- ৭ , ফ্লাট নং- এ ৪) এবং ৫৮৩ বর্গফুটের পৃথক একটি ফ্ল্যাটের মালিক গৃহিণী ইসরাত। রয়েছে ৪৫ লাখ টাকার পারিবারিক সঞ্চয়পত্র এবং ব্যাংকে নগদ জমা আছে ৩৫ লাখ টাকা। যদিও এজাহারে তিনটি ফ্ল্যাটের দালিলিক মূল্য আমলে নেওয়া হয়েছে। ফলে প্রকৃত বাজারমূল্য আসেনি মামলায়।
কী আছে ইসরাতের আয়কর নথিতে
মোসাম্মৎ ইসরাত জাহানের আয়কর নথিতে আয়ের উৎস হিসাবে দেখানো হয়েছে, ‘মেসার্স জে এম ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল’ নামে কাগুজে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। সেখান থেকে নয় লাখ ৬০ হাজার টাকা, সঞ্চয়পত্রের মুনাফা থেকে ২৫ লাখ ৯২ হাজার ৯৬৫ টাকা, কৃষি খাত থেকে আট লাখ ২০ হাজার টাকা এবং বাড়ি ভাড়া থেকে তিন লাখ ৫৮ হাজার টাকার আয় দেখানো হয়েছে।
ইসরাত জাহানের নামে পূবালী ব্যাংকের ধোলাইপাড় শাখা ও হোটেল ওসমানী ইন্টারন্যাশনাল শাখার হিসাবে বিভিন্ন সময় স্বামী মজিবুর রহমানের কর্মস্থল থেকে নিয়মিত লেনদেন হয়েছে। যার মাধ্যমে প্রমাণিত হয় সাব-রেজিস্ট্রার মজিবুর অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ স্ত্রীর আয়কর নথিতে দেখিয়ে বৈধ করার অপচেষ্টা চালিয়েছেন। ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে এসব অর্থ অর্জিত বলে মনে করে দুদক।
এ বিষয়ে দুদকের সহকারী পরিচালক ও তদন্ত কর্মকর্তা আতাউর রহমান সরকারের কাছে জানতে চাইলে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি। তবে দুদকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, অনুসন্ধানকালে দেখা যায় ইসরাত জাহানের নামে পূবালী ব্যাংকের ধোলাইপাড় শাখা ও হোটেল ওসমানী ইন্টারন্যাশনাল শাখার হিসাবে বিভিন্ন সময় স্বামী মজিবুর রহমানের কর্মস্থল থেকে নিয়মিত লেনদেন হয়েছে। যার মাধ্যমে প্রমাণিত হয় সাব-রেজিস্ট্রার মজিবুর অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ স্ত্রীর আয়কর নথিতে দেখিয়ে বৈধ করার অপচেষ্টা চালিয়েছেন। ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে এসব অর্থ অর্জিত বলে মনে করে দুদক। তদন্তে আরও সম্পদের তথ্য পাওয়া যেতে পারে।
এ বিষয়ে সাব-রেজিস্ট্রার মজিবুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। অনুসন্ধানকালে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুদকের একাধিক তলবি নোটিশেও হাজির হননি তিনি।
মামলায় স্ত্রী ইসরাতকে এক নম্বর আসামি করা হয়েছে। সাব-রেজিস্ট্রার স্বামীকে করা হয়েছে দ্বিতীয় আসামি। স্বামী মজিবুর রহমানকে স্ত্রীর সম্পদ অর্জনের সহায়তাকারী হিসেবে এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে।
দুদকের মামলার এজাহারে যা আছে
দুদকের মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত এক কোটি ৫৩ লাখ ৭৭ হাজার টাকার সম্পদ অর্জনপূর্বক ভোগদখলে রেখে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪ এর ২৭ (১) ধারা ও দণ্ডবিধির ১০৯ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।
আরএম/এসকেডি/এমএআর/