পি কে হালদারকে ধরে যেভাবে দেশে আনা হতে পারে
সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে বিদেশে পালিয়ে যাওয়া প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদারকে গ্রেফতারের প্রক্রিয়া শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও পুলিশ সদরদপ্তর। পি কে হালদারকে ধরতে রেড নোটিশ জারির জন্য আবেদন করা হয়েছে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল পুলিশ অর্গানাইজেশন- ইন্টারপোলে।
পুলিশ সদরদপ্তর সূত্র জানায়, সাধারণত বিদেশে কোনো আসামি লুকিয়ে থাকলে তাকে ধরতে ইন্টারপোলের সহযোগিতা লাগে। ইন্টারপোল বাংলাদেশে শুধুমাত্র বাংলাদেশ পুলিশের সঙ্গেই তথ্য আদান-প্রদান করে। তাই সম্প্রতি দুদক থেকে পুলিশ সদরদপ্তরের কাছে পি কে হালদারের ইন্টারপোলের বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে। পুলিশ সদরদপ্তর সুনির্দিষ্ট ফরম্যাটে ইন্টারপোলকে বিষয়টি অবহিত করেছে এবং পি কে হালদারের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ বা রেড অ্যালার্ট জারি করতে বলেছে।
পরবর্তী পদক্ষেপ যা হবে
দুদকের পক্ষ থেকে ডিসেম্বরের শেষের দিকে ইন্টারপোলকে অবহিত করার কথা বলা হলেও তারা পুলিশকে পি কে হালদারের দুর্নীতি নিয়ে তেমন কোনো নথিপত্র দেয়নি। পুলিশ সদরদপ্তর থেকে দুদকে গিয়ে এসব নথিপত্র সংগ্রহ করে ৪ জানুয়ারি পুলিশ সদরদপ্তরের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি) বিভাগ থেকে রেড নোটিশ জারির বিষয়ে আবেদন করা হয়েছে।
প্রক্রিয়ার পরবর্তী পদক্ষেপ জানতে চাইলে পুলিশ সদরদপ্তর জানায়, বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর ইন্টারপোলের বোর্ড মিটিং হয়। পরবর্তী বোর্ড মিটিংয়ে পি কে হালদারের আবেদনের বিষয়ে আলোচনা হবে। যদি তারা বাংলাদেশের আবেদনে সন্তুষ্ট বা পজিটিভ হয় তাহলে তারা রেড নোটিশ জারি করবে।
রেড নোটিশ জারির মাধ্যমে পৃথিবীর সব দেশের ইন্টারপোলের কার্যালয়ে পি কে হালদারের ছবি ও তার অপকর্মের বর্ণনা চলে যাবে। ইন্টারপোলের ওয়েবসাইটের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ তালিকায় পি কে হালদারের ছবিসহ বিস্তারিত তথ্য দেওয়া থাকবে। পাশাপাশি সম্ভাব্য কোন দেশে পি কে হালদার থাকতে পারে সেই দেশগুলোর নামও উল্লেখ থাকবে ওয়েবসাইটে।
যেভাবে ফিরিয়ে আনা হতে পারে
পি কে হালদার কোন দেশে আছে এসব তথ্য জানার পর ইন্টারপোল সেই দেশের পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে পুলিশ দিয়ে তাকে গ্রেফতার করিয়ে নিজ হেফাজতে নেবে। তার পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু হবে।
পুলিশ সদরদপ্তর জানায়, যেই দেশে পি কে হালদারকে গ্রেফতার করা হবে সেই দেশের সঙ্গে যদি বাংলাদেশের ‘বন্দি বিনিময় চুক্তি’ থাকে তাহলে খুব সহজেই তাকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। আর যদি চুক্তি না থাকে সেক্ষেত্রে দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নতুন করে একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করে তাকে ফিরিয়ে আনতে পারবে।
পুলিশ সদরদপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) সোহেল রানা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘পুলিশ সদরদপ্তর থেকে সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় পি কে হালদারের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারির আবেদন করা হয়েছে। আমরা আশা করছি শিগগিরই তারা নোটিশ জারি করবে।’
সম্ভাব্য যে দেশে থাকতে পারেন পি কে হালদার
সম্প্রতি দুদকের আইনজীবী খোরশেদ আলম আদালতকে জানিয়েছিলেন পি কে হালদার দুবাই অথবা সিঙ্গাপুরে পালিয়ে রয়েছেন। তবে পুলিশের পক্ষ থেকে ইন্টারপোলকে সম্ভাব্য অবস্থানের দেশ হিসেবে দুবাই, সিঙ্গাপুরের পাশাপাশি কানাডার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। পুলিশ কিংবা দুদকের কাছে হালদারের বর্তমান অবস্থান নিয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই।
পি কে হালদারের যত অপকর্ম
প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ রয়েছে পি কে হালদারের বিরুদ্ধে। পি কে হালদার এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক। দুদকের তথ্যমতে তিনি নানা কৌশলে নামে-বেনামে অসংখ্য কোম্পানি খুলে শেয়ারবাজার থেকে বিপুল পরিমাণ শেয়ার কেনেন এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে নিজের আত্মীয়, বন্ধু ও সাবেক সহকর্মীসহ বিভিন্ন ব্যক্তিকে পর্ষদে বসিয়ে অন্তত চারটি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নেন।
এই চার কোম্পানি হলো- ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (আইএলএফএসএল), পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড এবং বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি)।
এর মধ্যে আইএলএফএসএল গ্রাহকদের অভিযোগের মুখে গত বছরের শুরুতে পি কে হালদারের বিদেশ পালানোর পর দুদক তার ৩০০ কোটি টাকার ‘অবৈধ সম্পদের’ খবর দিয়ে মামলা করে। এছাড়াও তাদের বিরুদ্ধে অর্থপাচারের মামলার তদন্ত করছে সিআইডি।
দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা
মঙ্গলবার (৫ জানুয়ারি) পি কে হালদারের মা লীলাবতী হালদার, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী ও সাবেক সচিব ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের চেয়ারম্যান এন আই খানসহ ২৫ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন হাইকোর্ট।
দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞার তালিকায় রয়েছেন- বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী, হারুনুর রশিদ (ফাস ফাইনান্স), পি কে হালদারের বন্ধু উজ্জ্বল কুমার নন্দী, সামি হুদা, পি কে হালদারের খালাতো ভাই অমিতাভ অধিকারী, অবন্তিকা বড়াল, শামীমা (আইএলএফএসএল ), রুনাই (আইএলএফএসএল), সাবেক সচিব ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের চেয়ারম্যান এন আই খান, সুকুমার মৃধা (ইনকাম ট্যাক্স আইনজীবী), অনিন্দিতা মৃধা, তপন দে, স্বপন কুমার মিস্ত্রি, অভিজিৎ চৌধুরী, রাজিব সোম, ব্যাংক এশিয়ার সাবেক পরিচালক ইরফান উদ্দিন আহমেদ, অঙ্গন মোহন রায়, নঙ্গ চৌ মং, নিজামুল আহসান, মানিক লাল সমাদ্দার, সোহেল সামস।
এছাড়া পিকে হালদারকে ‘বিভিন্নভাবে তথ্য দিয়ে সহায়তাকারী’ মাহবুব মুসা, এ কিউ সিদ্দিকী, মোয়াজ্জেম হোসেন ও পি কে হালদারের মা লিলাবতী হালদারের ক্ষেত্রেও দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
এআর/এইচকে