অবৈধ গ্যাস সংযোগে বারবার পুড়ছে সাততলা বস্তি
২০১২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ৫টি বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে মহাখালীর সাততলা বস্তিতে। প্রতিবারই ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের প্রায় ১২-১৮টি ইউনিটকে ঘটনাস্থলে গিয়ে ঘণ্টাব্যাপী চেষ্টা করে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে হয়েছে।
সর্বশেষ ২০২০ সালের ২৪ নভেম্বর লাগা আগুনে কাজ করেছিল ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট এবং আজ সোমবার (৭ জুন) ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড প্রায় ২ ঘণ্টা ৩০ মিনিটের চেষ্টায় নিয়ন্ত্রণে আনে ফায়ার সার্ভিসের ১৮টি ইউনিট।
আজকের আগুনে বস্তির প্রায় শতাধিক ঘরে পুড়ে ছাই হয়েছে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। সঙ্গে পুড়ে গেছে ঘরে থাকা আসবাবপত্র।
সাততলা বস্তিতে প্রতিবার আগুন লাগার পর যে বিষয়টি সামনে আসে সেটি হলো বিদ্যুৎ ও গ্যাসের অবৈধ সংযোগ। আগুন লাগার পর পর প্রতি বছরই ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে বলা হয়, বস্তিটিতে থাকা অবৈধ গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগের কারণে, বিশেষ করে অবৈধ গ্যাস সংযোগের কারণে বারবার আগুনে পুড়ছে সাততলা বস্তি। এবারও আগুনের সূত্রপাত অবৈধ গ্যাস সংযোগের থেকে হতে পারে বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. সাজ্জাদ হোসাইন।
আগুন নিয়ন্ত্রণের পর সরেজমিনে সাততলা বস্তিতে গিয়ে অবৈধ গ্যাস সংযোগের চিত্র দেখা যায়। সরেজমিনে দেখা যায়, সাততলা বস্তির ভেতর ছোট ছোট চিপা অলিগলিতে যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অবৈধ গ্যাস সংযোগের লাইন। চিপা পায়ে হাঁটা রাস্তার ওপর দিয়ে অরক্ষিতভাবে নেওয়া হয়েছে অধিকাংশ অবৈধ গ্যাস সংযোগের লাইন। এসব লাইনের ওপর দিয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা প্রতিনিয়ত চলাচল করেন। আবার অনেক রান্না ঘরের চুলাও বসানো হয়েছে অরক্ষিত এসব গ্যাস লাইনের খুব কাছে। এছাড়া সংযোগ লাইনের ওপর ময়লা আবর্জনা থেকে শুরু করে রয়েছে বিভিন্ন দাহ্য পদার্থ। এভাবেই সারা সাততলা বস্তি জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অবৈধ, অরক্ষিত ও ঝুঁকিপূর্ণ গ্যাস সংযোগ।
অন্যদিকে দেখা গেছে, বৃষ্টির পানিতে মাটির ভেতরে থাকা অল্প কিছু গ্যাস সংযোগ লাইনও ভেসে উঠছে। এসব লাইন ওপর পা দিয়ে মানুষজন হাঁটাচলা করছেন। ফলে লাইনগুলোর ওপর পড়ছে প্রচুর চাপ। এই চাপের কারণে লাইনে সৃষ্টি হচ্ছে লিকেজ। আর এই লিকেজ থেকে বারবার গ্যাস বের হয়ে অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আজকের অগ্নিকাণ্ডও অবৈধ গ্যাস সংযোগের লিকেজ থেকে হয়েছে বলে দাবি স্থানীয় বাসিন্দাদের। এ বিষয়ে সাততলা বস্তির বাসিন্দা সাফিয়া বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, রাত সাড়ে ৩টার দিকে বস্তির দক্ষিণ পাশে একটি ঘরে রান্নার কাজ চলছিল। চুলা থেকে হঠাৎ করে গ্যাস লিকেজ হয়ে আগুন ছড়ি পড়ে সারা ঘরে। আগুন লাগার পর ঘরের মানুষজন আগুন আগুন বলে চিৎকার শুরু করলে আমরা ঘুম থেকে উঠে বাইরে আসি। এরপর ওই ঘর থেকে আগুন এক এক করে বস্তির বিভিন্ন ঘরে ছড়িয়ে পরে। পরে সবাই মিলে পানি দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করে। না পাড়ায় তখন ফায়ার সার্ভিসকে ফোন দেওয়া হয়। আগুন ধীরে ধীরে বড় হতে থাকায় আমরা আর কোনো রাস্তা না পেয়ে কোনো মতে জীবনটা নিয়ে বের হই।
বস্তির আরেক বাসিন্দা ইয়ামিন হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাগো বস্তির সব থেকে খারাপ জিনিস হইল গ্যাসের লাইন। দুই দিন পর পর শোনা যায় বস্তির ভেতরে ওই জায়গায় গ্যাস লিকেজ হইছে, ওই ঘরের গ্যাস লাইন থেকে গ্যাস বের হচ্ছে। পরে যারা গ্যাস দিয়েছে তাদের জানাইলে তারা আইসা কোনোমতে প্লাস্টিক দিয়া জোড়াতালি দিয়ে লিকেজ বন্ধ কইরা যায়। পরে আবার সেই প্লাস্টিক উইঠা গেলে আবারও লিকেজ শুরু হয়। আর এই গ্যাস লিকেজের কারণেই আমাগো বস্তিতে আগুন লাগছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, স্থানীয় প্রভাবশালীদের দখলে রয়েছে সাততলা বস্তি। তারা কোনো ধরনের নিয়মনীতি না মেনে অবৈধ গ্যাস ও বিদ্যুতের সংযোগ সাততলা বস্তিতে ছড়িয়েছে। প্রতি ঘর থেকে গ্যাস সংযোগবাবদ চক্রটি হাজার টাকা করে নিচ্ছে। এভাবে তারা প্রতিমাসে বস্তির প্রায় ১ হাজার ঘর থেকে টাকা তুলছে।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বস্তির এক বাসিন্দা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের বস্তিটি পরিচালিত হয় স্থানীয় রাজনৈতিক লোকদের দ্বারা। যখন যে দলের সরকার থাকে তখন সেই দলের স্থানীয় প্রভাবশালী নেতারা বস্তিটি নিয়ন্ত্রণ করে। তারাই মূলত বিদ্যুৎ অফিস ও তিতাস গ্যাসের সঙ্গে যোগসাজশ করে আমাদের বস্তিতে অবৈধ সংযোগ দেয়। মাঝে মধ্যেই গ্যাস লাইনে লিকেজ হয়। আমরা খবর দিলে স্থানীয় নেতারা ম্যাকানিক এনে রাবার দিয়ে লাইন ঠিক করে যায়। তবে কয়েক বছর বারবার আগুন লাগায় গ্যাস লাইনের সমস্যার স্থায়ী সমাধানের দাবি করলে তারা নিজেদের গুণ্ডাবাহিনী দিয়ে আমাদের হুমকি দেয়। আবার অনেক সময় মারধরও করে। বস্তিবাসী অধিকাংশ খেটে খাওয়া মানুষ। তাই তাদের ভয়ে কেউ কিছু বলে না। আর সরকারের পক্ষ থেকেও কেউ আসে না অবৈধ গ্যাস সংযোগের খোঁজ নিতে।
এদিকে সাততলা বস্তির আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর ঘটনাস্থলে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. সাজ্জাদ হোসাইন বলেন, এখানে প্রচুর পরিমাণে অবৈধ গ্যাস ও বিদ্যুতের লাইন রয়েছে। আমরা প্রাথমিকভাবে মনে করছি এই দুইটার থেকে যেকোনো একটির কারণে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে।
এমএসি/জেইউ/এইচকে