ঘরবন্দি বছরেও সড়কে গেছে প্রায় ৫ হাজার প্রাণ
পুরো পৃথিবীর জন্যই ২০২০ সালটা ভালো ছিল না। মহামারি করোনা ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে দেশে দেশে করা হয় লকডাউন, ঘরবন্দি হয়ে যায় মানুষ। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম ছিল না।
তবে এই ঘরবন্দি থাকার বছরেও সারাদেশে সর্বমোট ৪ হাজার ৯২টি সড়ক দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। আর এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৪ হাজার ৯৬৯ জন এবং আহত হয়েছেন ৫ হাজার ৮৫ জন।
বুধবার (৬ জানুয়ারি) জাতীয় প্রেসক্লাবের মাওলানা আকরাম খাঁ হলে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) আয়োজিত ‘২০২০ সালের সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান উপস্থাপন’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য উপস্থাপন করেন সংগঠনটির চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন।
সংবাদ সম্মেলনে ইলিয়াস কাঞ্চন জানান, দেশের সড়ক দুর্ঘটনা ২০১৮-১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে কম সংগঠিত হয়েছে। তবে এটাকে গত বছরগুলোর তুলনায় বলা যায় না। কারণ, ২০২০ সালটি করোনা মহামারীর বছর। জরুরি যানবাহন ছাড়া অন্যান্য যানবাহন চলাচল ছিলো সম্পূর্ণ বন্ধ। যে কারণে সড়ক দুর্ঘটনা আরও কম হওয়া উচিত ছিল। কারণ, গত এপ্রিল এবং মে ২০২০ ছাড়া অন্যান্য মাসগুলোর সড়ক দুর্ঘটনা বিগত বছরগুলোর মতই হয়েছে।
সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী করা হয়েছে যেসব কারণ:
সড়কের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও মনিটরিংয়ের অভাব; টাস্কফোর্সের দেওয়া ১১১টি সুপারিশনামা বাস্তবায়ন না হওয়া; চালকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানোর প্রবণতা; দৈনিক চুক্তিভিত্তিক গাড়ি চালনা করা; লাইসেন্স ছাড়া চালক নিয়োগ; পথচারীদের মধ্যে সচেতনতার অভাব; ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করে ওভারটেকিং করা; বিরতি ছাড়াই দীর্ঘসময় ধরে গাড়ি চালনা; ফিটনেসবিহীন গাড়ি চালনা বন্ধে আইনের প্রয়োগ না থাকা; সড়ক ও মহাসড়কে মোটরসাইকেল ও তিন চাকার গাড়ি বৃদ্ধি হওয়া; মহাসড়কের নির্মাণ ত্রুটি; একই রাস্তায় বৈধ ও অবৈধ এবং দ্রুত ও স্লথ যানবাহন চলাচল এবং রাস্তার পাশে হাটবাজার ও দোকানপাট থাকা।
২০২০ সালে সড়ক, রেল ও নৌ-পথে উল্লেখযোগ্য ৯টি বড় দুর্ঘটনা ঘটছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন নিসচার চেয়ারম্যান।
সড়ক পথের উল্লেখযোগ্য দুর্ঘটনাগুলো হচ্ছে- ১ মার্চ রাজশাহীর গোদাগারীতে মাইক্রোবাস উল্টে ৮ জনের মৃত্যু; ৭ মার্চ হবিগঞ্জের নবীগঞ্জে মাইক্রোবাস উল্টে ১২ জনের মৃত্যু; ২২ মার্চ চট্টগ্রামের লোহাগড়ায় ট্রাক-হিউম্যান হলারের মুখোমুখি সংঘর্ষে ১৫ জনের মৃত্যু এবং ২২ মে গাইবান্ধার পলাশবাড়িতে ট্রাক খাদে পড়ে ১৫ জনের মৃত্যু।
রেলপথের দুর্ঘটনাগুলো হচ্ছে- ১৭ অক্টোবর যশোরের অভয়নগরে প্রাইভেট কার ও ট্রেনের ধাক্কায় ৪ জনের মৃত্যু এবং ২০ ডিসেম্বর জয়পুরহাটে অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ে বাস ও ট্রেনের সংঘর্ষে ১২ জন মৃত্যু।
নৌ-পথের দুর্ঘটনাগুলো হচ্ছে- ২৯ জুন ঢাকার বুড়িগঙ্গায় লঞ্চের ধাক্কায় ৩৪ জনের মৃত্যু; ৫ আগস্ট ২০২০ নেত্রকোনার মদনে নৌকা ও ট্রলারের সংঘর্ষে ১৮ জনের মৃত্যু এবং ৯ সেপ্টেম্বর নেত্রকোনার কলমাকান্দিতে ট্রলার ডুবে ১২ জনের মৃত্যু।
সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে সরকারকে সংগঠনের পক্ষ থেকে ১৪টি সুপারিশ জানিয়েছেন ইলিয়াস কাঞ্চন। সুপারিশগুলো হচ্ছে- সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ এর বাস্তবায়ন সংক্রান্ত জরুরি কার্যক্রম গ্রহণ করা; প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ দেওয়া ৬দফা নির্দেশ দ্রুত বাস্তবায়ন; টাস্কফোর্সের দেওয়া ১১১টি সুপারিশনামা দ্রুত সম্ভব বাস্তবায়ন করা; হাইওয়েতে শৃঙ্খলা ফেরাতে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়রে যৌথ তত্ত্বাবধানে উচ্চ পর্যায়ের মনিটরিং সেল গঠন ও সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করা; করোনা থেকে নিরাপদ রাখতে যেভাবে সরকার প্রচার চালাচ্ছে, সেভাবে সড়ক দুর্ঘটনার বিষয়ে প্রচার চালানো; বিভিন্ন মিডিয়া মাধ্যমে সচেতনতা মূলক অনুষ্ঠান প্রচারের ধারাবাহিকতা তা বজায় রাখা; স্কুলের পাঠ্যক্রমে সড়ক দুর্ঘটনারোধের বিষয় অন্তর্ভুক্ত করার ঘোষণা অবশ্যই বাস্তবায়ন করা; ঢাকা রুট ফ্রান্সাইজের পরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়ন করা; ট্রাফিক সিগন্যাল অমান্য করা, যত্র-তত্র গাড়ী পার্কিং করা, নির্দিষ্ট স্থান ব্যতিরেকে যেখানে-সেখানে যাত্রী উঠানো-নামানো, ওভার টেকিং করা, পাল্টা-পাল্টি ও বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, অতিরিক্ত যাত্রী ও মাল বোঝাই করা, গাড়ীর ছাদে যাত্রী বহন করা, ওভার ব্রিজ কিংবা আন্ডারপাস বা জেব্রা ক্রসিং থাকা স্বত্বেও সেগুলো ব্যবহার না করার প্রবণতাকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মাধ্যমে কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা; সরকারের নেওয়া 'সেইফ' প্রকল্পরে মাধ্যমে ১২ ও ২৪ দিনের প্রশিক্ষণ কর্মশালার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে তা দ্রুত বাস্তবায়ন করা; সকল মহাসড়ক এবং প্রধান সড়ককে অবশ্যই ন্যুনতম চার লেনে উন্নীত করা; পথচারীদের নির্বিঘ্নে চলাচলের জন্য ফুটপাথগুলো দখলমুক্ত চলাচলের ব্যবস্থা করা ও নিয়মিত মনিটরিংয়ের মাধ্যমে পুনরায় যেনো ফুটপাত দখল না হয় এ বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে; সড়কের ত্রুটিগুলো অচিরেই দূর করতে হবে এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রশিক্ষণরত শিক্ষকদের মতো মাদ্রাসা শিক্ষক ও স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের সড়ক দুর্ঘটনারোধে করনীয় সম্পর্কিত প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে।
এইচএন/এমএইচএস