ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি কম-বেশি হয় যেসব কারণে

প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে ভূমিকম্প অন্যতম। ভয়াবহ এ দুর্যোগের কবলে পড়ে বিভিন্ন দেশের ব্যাপক জান মালের ক্ষতি হওয়ার রেকর্ড রয়েছে। সবশেষ গতকাল শুক্রবার সাত দশমিক সাত মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে মিয়ানমার। ভূমিকম্প এতটাই শক্তিশালী ছিল যে শত শত মাইল দূরে থাইল্যান্ডেও তা জোরালোভাবে অনুভূত হয় এবং দেশটির রাজধানী ব্যাংককে ভবন ধসে পড়ে। ঘটে অনেক প্রাণহানিও।
বিজ্ঞাপন
এর আগে চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি সাত দশমিক এক মাত্রার ভূমিকম্পে হাজারো ঘরবাড়ি ভেঙে গুঁড়িয়ে যায় তিব্বতে। এ ঘটনায় মৃত্যুও হয় শতাধিক মানুষের। তবে ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় একই মাত্রার ভূমিকম্পে কোনো প্রাণহানি হয়নি, অবকাঠামোগতও তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। তাহলে ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির মাত্রা কেন বাড়ে-কমে?
বিশেষজ্ঞরা বেশ কয়েকটি মানদণ্ড বের করেছেন যেগুলোর কারণে ভূমিকম্পের ফলে ক্ষতি কম বা বেশি হয়।
বিজ্ঞাপন
কম্পনের মাত্রা ও স্থায়ীত্বকাল
পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ঠ আলাদা আলাদা বিট বা প্লেট টেকটোনিক দিয়ে তৈরি হয়েছে, যা নিচের নরম পদার্থের ওপরে ভাসছে। যেসব স্থানে একটি প্লেট এসে আরেকটি প্লেটের কাছাকাছি মিশেছে বা ধাক্কা দিচ্ছে বা ফাটলের তৈরি হয়েছে, সেটাকে বলা হয় ফল্ট লাইন। মাটির নিচে দুই দশমিক পাঁচ বা তার কম কম্পন হলে সাধারণত তা অনুভূত হয় না, তবে এটা যন্ত্রে ধরা পড়ে। পাঁচ মাত্রার বেশি কম্পন মানুষ বুঝতে পারে এবং এতে সামান্য ক্ষয়ক্ষতিও হতে পারে। সাত মাত্রার ওপরের ভূমিকম্পকে বড় কম্পন হিসেবে ধরা হয়। আর আট মাত্রার বেশি ভূমিকম্পকে বিবেচনা করা হয় বড় দুর্বিপাক হিসেবে এবং এটির ভয়াবহ ক্ষতি করতে পারে।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন
আবার কতক্ষণ ধরে কম্পন হচ্ছে সেটিও গুরুত্বপূর্ণ। যত বেশি সময় ধরে কম্পন চলবে, ক্ষয়ক্ষতির মাত্রাও তার সঙ্গে বাড়তে পারে। ভূমিকম্প ও অগ্ন্যুৎপাত সংক্রান্ত বিষয় পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা প্যাসিফিক নর্থওয়েস্ট সিসমিক নেটওয়ার্ক বলছে, কম মাত্রার ভূমিকম্প কেবল কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী হয়। আর মাঝারি থেকে বড় ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে কয়েক মিনিট ধরেও কম্পন চলতে পারে। যেমনটা হয়েছিল ২০০৪ সালে ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রায় ভূমিকম্পের সময়। ২০০৪ সালে ২৬ ডিসেম্বর সুমাত্রা ও আন্দামানের কাছে ভারত মহাসাগরে নয় দশমিক এক মাত্রার ভূমিকম্প হয়। এর ফলে সৃষ্ট একের পর এক প্রবল জলোচ্ছ্বাসে ১৪টি দেশে প্রাণ হারান প্রায় দুই লাখ ৩০ হাজার মানুষ। সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যান ইন্দোনেশিয়ায়।
গভীরতা
শুধু কম্পনের মাত্রা নয়, মাটির নিচে কোথায় কম্পনটা হলো সেই জায়গাটাও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ২০২৩ সালের ৮ সেপ্টেম্বর মরোক্কোর পশ্চিমাঞ্চলে ছয় দশমিক আট মাত্রার যে ভূমিকম্প হয়, সেটার কেন্দ্র ছিল ভূ-পৃষ্ঠের ১৮ কিলোমিটার নিচে। এভারেস্ট চূড়া যত উঁচু তার চেয়েও বেশি ছিল এই দূরত্ব। কিন্তু ভূতাত্ত্বিক মানদণ্ডে এটা খুব বেশি গভীর নয়। দুই হাজারেরও বেশি মানুষের প্রাণহানি হয় সেখানে।
প্রায় কাছাকাছি সময়ে ২০২৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ইন্দোনেশিয়ার নর্থ মালাকু প্রদেশে ছয় দশমিক দুই মাত্রার যে ভূমিকম্প হয়, এর কেন্দ্র ছিল ভূপৃষ্ঠের ১৬৮ কিলোমিটার গভীরে। সেখানে কোনো প্রাণহানি ঘটেনি।
ভূমিকম্পের সময়
মরোক্কোয় ভূমিকম্প হয়েছিল রাত ১১টা ১১ মিনিটে। ঘুমন্ত বাসিন্দাদের নিয়ে অনেক ভবন ধ্বংস হয়ে যায়। তবে ভূতাত্ত্বিকরা একটা কথা বলেন যে ‘ভূমিকম্প নয়, মানুষের প্রাণহানির জন্য দায়ী ভবনগুলো’, যেহেতু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভবন ধসেই মানুষের মৃত্যু হয়। তবে রাতের তুলনায় দিনের বেলার ভূমিকম্পে ক্ষতি কম হয় বলেও মনে করা হয়।
ভবনের অবস্থা
ভূমিকম্প সহনশীল ঘরবাড়ি তৈরি করা সম্ভব। সেক্ষেত্রে সর্বোচ্চ মাত্রার কম্পন সহ্য করতে পারে এমন ভবন নির্মাণ করতে হয়। জাপানি স্থপতিরাই এটা সম্ভব করে দেখিয়েছেন। ভবন বা অবকাঠামোকে এমন একটা ভিতের ওপর দাঁড় করানো হয় যেটা ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট শক বা কম্পন সহ্য করতে পারে। ভিতটা বা ভিতের ওই অংশটা ৩০ থেকে ৫০ সেন্টিমিটার পুরু রাবারের ব্লক দিয়ে তৈরি করা হয়। তবে এরকম ভিত তৈরিতে বেশ ভালোরকম খরচ হয়, ফলে ভবনের নির্মাণব্যয় অনেকটাই বেড়ে যায়।
২০২৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি তুরস্কে সাত দশমিক আট মাত্রার ভূমিকম্প হয় এবং বলা হচ্ছিলো, নীতিমালা মেনে নির্মিত না হওয়ার কারণেই তখন অসংখ্য ভবন ধসে পড়েছিল।
এক বিশেষজ্ঞ বলছেন, ‘ভূমিকম্পটা শক্তিশালী ছিল, তবে সঠিকভাবে নির্মিত ভবন ধসিয়ে ফেলার মতো অত বিধ্বংসী ক্ষমতার ছিল না। বরং অনেক এলাকাতেই কম্পন সর্বোচ্চ মাত্রার চেয়ে কম ছিল। ফলে আমরা বলতেই পারি, ধসে পড়া হাজার হাজার ভবনের কোনোটিই সঠিক নীতিমালা মেনে নির্মিত হয়নি।’
জনসংখ্যার ঘনত্ব
জনসংখ্যার ঘনত্বের ওপরও ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি অনেকটা নির্ভর করে। ২০২১ সালের জুলাইয়ে আলাস্কা উপত্যকায় আট দশমিক দুই মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হেনেছিল এবং এটা খুবই সম্ভব যে ওই ঘটনার স্মৃতি অনেকেরই মনে নেই। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্পগুলোর মধ্যে এটাকে রাখা হয়েছে সাত নম্বরে। ওই ভূমিকম্পে কেউ মারা যায়নি, কোনো ক্ষয়ক্ষতিও হয়নি। এর কারণ ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল জনবসতি থেকে অনেক দূরে।
সেই তুলনায় ২০১০ সালের জানুয়ারিতে হাইতিতে সাত মাত্রার ভূমিকম্পে আড়াই লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু ও অন্তত তিন লাখ মানুষ আহত হন।
মাটির ধরন
ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থলের ওপরের মাটির প্রকৃতি কী বা মাটি কতটা শক্ত তার ওপরও ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা নির্ভর করে। ভূপৃষ্ঠে বা এর কাছাকাছি স্তরে কাদামাটি থাকলে শক্তিশালী কম্পন সহ্য করতে পারে না সেটি। এক্ষেত্রে কম্পন শুরু করে মাটির ওপরের স্তরটি তরল পদার্থের মতো টালমাটাল আচরণ শুরু করে এবং ধ্বংসযজ্ঞের মাত্রা অনেক বেড়ে যায়। ১৯৬৪ সালে জাপানের নিগাতয় ভূমিকম্পে ঠিক এমনটাই ঘটেছিল।
জরুরি উদ্ধার তৎপরতা
উদ্ধার তৎপরতা যত দ্রুত শুরু হয়, ততই বেশি সংখ্যক মানুষকে বাঁচানো সম্ভব হয়। পূর্বপ্রস্তুতি এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে।
জাপানের স্কুলগুলোয় বছরে দুইবার অনুশীলন করানো হয় যে ভূমিকম্প হলে কী করতে হবে। বাড়িতে থাকলে, বাইরে বা গাড়িতে থাকা অবস্থায় ভূমিকম্প হলে কী করতে হবে তা শেখানো হয়। সূত্র: বিবিসি বাংলা
এমএ