বাসের টিকিটে বাড়তি টাকা আদায়, কাউন্টারম্যান চাইছেন বকশিশ!

ঈদ উপলক্ষ্যে বাসের ভাড়া বৃদ্ধি ও অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের ঘটনা যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। প্রতিবছরই এমন অভিযোগ আসে বাসের নিয়মিত যাত্রীদের থেকে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি, যেখানে কাউন্টারম্যান একাধিকবার বকশিশ দাবি করছেন। এ ছাড়া ঢাকা-উত্তরবঙ্গ রুটের এসি বাসগুলোতে গত মাসের তুলনায় ৭০০ থেকে ১৫০০ টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
বিজ্ঞাপন
সরকারের সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় প্রতিবারই এ ধরনের ভাড়া নৈরাজ্য রোধের আশ্বাস দিলেও বাস্তব পরিস্থিতি তার বিপরীত। বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের রুটগুলোতে বাস ভাড়া বৃদ্ধি ক্রমবর্ধমান সমস্যার সৃষ্টি করেছে, যেখানে সরকারি তদারকির দাবি জানিয়েছেন যাত্রীরা।
এদিকে এসি বাসের ভাড়া বৃদ্ধির বিষয়ে বিভিন্ন নামি-দামি বাসের মালিকরা আঙুল তুলছেন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) দিকে। এসি বাসের ভাড়া সরকার নির্ধারিত না হওয়ায় ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় করছেন মালিকরা।
বিজ্ঞাপন
পরিবারের সঙ্গে ঈদ আনন্দ উপভোগ করতে আগামী ২৯ মার্চ ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাবেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী জুবায়ের আহাম্মেদ। সেই মোতাবেক গত ১৩ মার্চ বাস কোম্পানি সৌদিয়ার নদ্দা কাউন্টার থেকে ইকোনোমি এসি বাসের দুটি আসনের টিকিট সংগ্রহ করেন। আসন প্রতি ৯৫০ টাকা করে মোট ভাড়া আসে ১৯০০ টাকা।
বিজ্ঞাপন
২০০০ টাকা দিলে কাউন্টারম্যান টাকা ফেরত না দিয়েই আপত্তি জানিয়ে জুবায়েরকে বলেন, ভাই ঈদ বকশিশ দেবেন না? তখন জুবায়ের বলেন, ঠিক আছে ১০০ টাকা আপনি রেখে দেন। তখন কাউন্টারম্যান বলেন, এটা তো পরিবহনের বকশিশ। আমারটা দেবেন না? পরে জুবায়ের বাধ্য হোন আরও ৫০ টাকা দিতে।
একই উপলক্ষ্যে আগামী ২৯ মার্চ ঢাকা থেকে রাজশাহী যাবেন গোলাম মুর্তজা। তিনি হানিফ এন্টারপ্রাইজের কেটিসি হানিফের বিজনেস ক্লাস বাসের প্রতি আসনের টিকিট সংগ্রহ করেন ১৮০০ টাকা করে। মুর্তজা ঢাকা পোস্টকে বলেন, একই বাসে আমি গত মাসে রাজশাহী গিয়েছি প্রতি আসনের ভাড়া ১১০০ টাকা দিয়ে। গত ১০ দিন আগের যাত্রায়ও এই বাসের ভাড়া ১১০০ টাকা ছিল। এখন সেখানে ৭০০ টাকা বেড়ে গিয়েছে কোনও কারণ ছাড়াই। বাধ্য হয়ে এখন বেশি দামে টিকিট সংগ্রহ করতে হচ্ছে।
আরও পড়ুন
বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা লিংকন মো. লুৎফরজামান সরকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঢাকা-রংপুর রুটের এসি বাস ভাড়া সাধারণ সময়ে ১৪০০ টাকা। ঈদ উপলক্ষ্যে প্রতিবছরই ভাড়া বাড়ানো হয়, এটা নিয়মে পরিণত হয়েছে। কিন্তু ১৪০০ টাকার ভাড়া ২৫০০, ২৮০০ এবং ৩০০০ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হচ্ছে! এটা কতটা যৌক্তিক, তা ভেবে দেখা উচিত। কারণ এই অংশে ঘরেফেরা মানুষের চাপ অনেক বেশি থাকে, কারণ দেশের অন্য অংশের তুলনায় উত্তরবঙ্গের মানুষ ঢাকামুখী বেশি। ফলে বাস ভাড়া নির্ধারণে সবার দিক বিবেচনা করা উচিত ও সরকারি তদারকি থাকা উচিত।
অনলাইনগুলোতে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, ঢাকা-রংপুর রুটে হানিফ এন্টারপ্রাইজের ভলবো এসি বাসের ভাড়া গত ১৯ মার্চ ছিল ১৫০০ টাকা। সেই একই রুটে, একই বাসে আগামী ২৯ মার্চে ভাড়া নিচ্ছে ২৫০০ টাকা। এখানে ১০০০ টাকা বেশি রাখা হচ্ছে।
ঢাকা-পঞ্চগড় রুটে শ্যামলী এন. আর ট্রাভেলসের নন-এসি বাসে আগামী ২৯ মার্চের ভাড়া রাখা হচ্ছে ১২০০ টাকা। সেই একই রুটে, একই বাসে আগামী ৩ এপ্রিলের পর থেকে যেকোনো দিনের ভাড়া দেখাচ্ছে ১০৫০ টাকা। এখানে গাবতলী থেকে পঞ্চগড় রুটের সরকারি ভাড়া ১১৭৪ টাকা।
ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে গ্রিন সেন্টমার্টিন স্লিপার এসি বাসে আগামী ২৯ মার্চের ভাড়া রাখা হচ্ছে ২০০০ টাকা। সেই একই রুটে, একই বাসে আগামী ১৯ এপ্রিলের ভাড়া দেখাচ্ছে ১৫০০ টাকা। এখানে ৫০০ টাকা বেশি রাখা হচ্ছে।
ঢাকা-বগুড়া রুটে হেরিটেজ ট্রাভেলসের স্লিপার এসি বাসে আগামী ২৯ মার্চের ভাড়া রাখা হচ্ছে ৩০০০ টাকা। সেই একই রুটে, একই বাসে আগামী ৫ এপ্রিলের ভাড়া দেখাচ্ছে ১৬০০ টাকা। এখানে ১৪০০ টাকা বেশি রাখা হচ্ছে।
শুধু এই চারটি রুট নয়, দেশের অন্য বাস রুটগুলোতেও প্রায় একই চিত্র দেখা গেছে। ঈদের আগে বাসের ভাড়া বাড়ানোর নৈরাজ্য নতুন কিছু নয়। সড়ক সংশ্লিষ্টরা প্রতিবারই এই সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দেন এবং এবারও আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় একই ধরনের আশার বাণী শুনানো হয়েছে। অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়া ঠেকাতে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন। তবে বাস্তবে এর কোনো প্রভাব দেখা যাচ্ছে না।
আরও পড়ুন
ভাড়া বৃদ্ধির বিষয়ে জানতে চাইলে হানিফ এন্টারপ্রাইজের মালিক কফিল উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি জানি না, এখন পরিবহন দেখি না। আপনি ম্যানেজারের সঙ্গে আলাপ করলে ভালো হয়।
হানিফ এন্টারপ্রাইজের জেনারেল ম্যানেজার মোশাররফ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, এসি বাসের ভাড়া বাড়েনি। প্রতিবছর যা নেওয়া হয়, সেটাই আছে। এসি গাড়ি একেকটা একেক রকম। যেমন গাড়ি, তেমন ভাড়া। আমরা এসি বাসের ভাড়া নির্ধারণের জন্য বারবার বলেছি বিআরটিএকে, কিন্তু তারা করেনি।
শ্যামলী এন আর ট্রাভেলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন সাধারণ সম্পাদক শুভঙ্কর ঘোষ রাকেশ ঢাকা পোস্টকে বলেন, নন এসি বাসের ভাড়া কার্যকরী ধরতে হবে। বিআরটিএ সবসময় নন এসি বাসের ভাড়া নির্ধারণ করে। এসি বাসের জন্য সরকারকে ভ্যাট দিতে হয়, এজন্য এটি মালিক দ্বারা নির্ধারিত হয়ে থাকে। এসির ভাড়া এক ক্যাটাগরিতে ফেলা যায় না। কারণ কেউ হুন্দাই বাস ব্যবহার করে, কেউ ওয়ান-জে ব্যবহার করে, কেউ ল্যালেন্ড ব্যবহার করে, কেউ স্লিপার দেয়, কেউ সেমি-স্লিপার দেয়। এত ক্যাটাগরির ভাড়া নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি।
তিনি আরও বলেন, এসি বাস হচ্ছে বিলাসবহুল সেবা। এর ভাড়া বিআরটিএ নির্ধারণ করতে পারেনি বলে ভাড়া নিয়ে এত জটিলতা। আমরা নিজেরা বসেও একটা ভাড়ার তালিকা করেছিলাম। কিন্তু কোনও পরিবহন মালিকই সেটা মানেনি। ছোট কোম্পানিগুলো এর থেকে আরও বেশি ভাড়া আদায় করে। বিআরটিএর একটি এসি বাসের ভাড়া প্রণয়ন করা অতীব জরুরি।
অভিযোগগুলো জানালে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব সাইফুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বকশিশের বিষয়ে আমি এখনই সরাসরি মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করছি এবং আমি ওই কাউন্টারের লোক পাঠিয়ে দেখব, এই কাজটি কেন করা হয়েছে। আমি আপনাকে অবশ্যই বিষয়টি জানাব।
অবশ্য তিনি নিজেই ৫ মিনিট পরে কল করে ঢাকা পোস্টকে জানান, বিষয়টি নিয়ে সৌদিয়ার মালিকের সঙ্গে এখনই কথা বলেছি। সেই কাউন্টারে থাকা কর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে এবং সৌদিয়ার যতগুলো কাউন্টার সারা দেশে আছে, কোথাও যেন এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয় সেজন্য এখন থেকেই তিনি নিজে তদারকি শুরু করছেন।
ভাড়ার বিষয়ে তিনি বলেন, নন এসি গাড়িগুলোতে সরকার নির্ধারিত যে ভাড়া আছে, সারা বছর তার থেকে কম ভাড়ায় গাড়ি চলে। একই রুটে অনেক গাড়ি থাকার কারণে কম্পিটিশন করতে গিয়ে তারা সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে কম নিয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে ১০০/১৫০ টাকা কমে যেতে পারেন যাত্রীরা। ঈদের সময় যেহেতু একমুখী যাত্রী হয় এবং ফেরার সময় খালি আসতে হয়। এ ছাড়া এই সময়ে অন্যান্য সময়ের মতোই কিন্তু ব্রিজের টোল, কর্মীর বেতন সবকিছুই সমান। এজন্য ঈদের সময় যাত্রী বেশি থাকায়, সরকার নির্ধারিত ভাড়া দাবি করে। এতে যাত্রীরা মনে করতে পারেন, তারা ভাড়া বেশি নিচ্ছে।
তিনি যাত্রীদের প্রতি অনুরোধ করে বলেন, প্রত্যেকটা কাউন্টারেই সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চার্ট থাকে। আপনারা সে নির্ধারিত ভাড়ার চার্ট দেখেই ভাড়া পরিশোধ করবেন।
এসি বাসের ভাড়া বৃদ্ধির বিষয়ে মালিক সমিতির মহাসচিব বলেন, সরকার এসি বাসের ভাড়া নির্ধারণের বিষয়টি ফ্রি করে দিয়েছে। যেহেতু এই গাড়িতে মালিকের ইনভেস্টমেন্ট, অপারেশনে কষ্ট এবং ভ্যাট দিতে হয়। আর প্রতি ১০০ টাকায় ১৫ টাকা ভ্যাট দিতে হয় এনবিআরকে। এটা যাত্রী থেকে আলাদা নেওয়া যায় না। এটা টিকিটের মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত রাখা হয়েছে। এজন্য সরকার বলেছে, ভাড়াটা আপনারা নিজেরাই নির্ধারণ করবেন।
তিনি বলেন, আমরা সব বাস মালিকদের অনুরোধ করে বলেছি সারা বছর এসি গাড়িতে যে ভাড়া নিয়েছেন, ঈদের সময়ও সেই একই ভাড়া নেবেন। আমি বাস মালিকদের আবারও অনুরোধ করব, তারা যেন এই কাজটি না করেন। এসি গাড়ির ভাড়া সরকার নির্ধারণ করে না বলেই এ রকম ভিন্নতা তৈরি হয়।
এসি বাসের ভাড়ার তারতম্যের বিষয়ে জানতে চাইলে বিআরটিএ'র চেয়ারম্যান মো. ইয়াসীন ঢাকা পোস্টকে বলেন, এটা ঠিক না। তারপরও স্পেসিফিক আমি জানাচ্ছি।
এমএইচএন/এমজে