ডিবি বলছে এলএসডি ‘নতুন’, মাদক নিয়ন্ত্রণ বলছে ‘২ বছর আগের’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থী হাফিজুর রহমানের আত্মহত্যার ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে বুধবার বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো প্রাণঘাতী মাদক এলএসডি বা লাইসার্জিক অ্যাসিড ডায়েথিলামাইড উদ্ধার করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন ডিবির পুলিশের প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার একেএম হাফিজ আক্তার। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো উদ্ধার করা হয় এলএসডি।
তবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর (ডিএনসি) বলছে, বাংলাদেশে এলএসডি নতুন নয়। ২০১৯ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে এলএসডি উদ্ধার করেছিল মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। যদিও ডিবির সংবাদ সম্মেলনের দুইদিন পর মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর একথা জানিয়েছে।
২০১৯ সালের এলএসডি উদ্ধারের কর্মকর্তাদের বরাতের অধিদফতরের সহকারী পরিচালক মো. মেহেদী হাসান বলেন, ২০১৯ সালে মহাখালী ডিওএইচএসে দুই তরুণের কাছ থেকে ৪৬ স্ট্রিপ এলএসডি উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় কাফরুল থানায় একটি মামলাও হয়। ডিএনসির সুপারিনটেনডেন্ট ফজলুল হক খান বাদী হয়ে মামলাটি করেন।
২০১৯ সালের সেই মামলাটি তদন্ত করেন পরিদর্শক মো. মনিরুজ্জামান। তদন্তের পর ২০২০ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। মামলাটি এখনো বিচারাধীন। চার্জশিটে নাম দেওয়া দুই আসামি হচ্ছেন রেদোয়ান আনান ও সৈয়দ আহনাদ।
এর আগে গত বুধবার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হাফিজুর রহমানের মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে রাজধানীর লালমাটিয়া ও ধানমন্ডির দুইটি বাসা থেকে এলএসডি উদ্ধার করে ডিবির রমনা বিভাগ। পাশাপাশি এলএসডি বিক্রির সঙ্গে জড়িত নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ’র ছাত্র সাদমান সাকিব (রূপল) ও আসহাব ওয়াদুদ (তুর্জ) এবং ইনডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্র আদিব আশরাফকে গ্রেফতার করা হয়।
ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, সাদমান সাকিব বছরখানেক আগে টেলিগ্রাম অ্যাপের মাধ্যমে নেদারল্যান্ড থেকে এই মাদক অর্ডার করে। মাদকের জন্য তারা পে-পালে টাকা পরিশোধ করলে পার্সেলের মাধ্যমে তা ঢাকায় আসে। প্রতিটি ব্লট তারা ৮০০-১০০০ টাকা দরে কিনেছিল। তিনবন্ধু একটি ‘আপনার আব্বা’ নামে একটি ফেসবুক গ্রুপ খুলে। সেখান থেকে তারা এলএসডি বিক্রি করত।
এলএসডি খেলে কি হয়
আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ ও এলএসডির ইতিহাস ঘেঁটে ডিবি জানতে পারে, এটি ব্যবহার করলে যে কারো মাথা ভার হয়ে যাবে। হেলোজেনিক প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। কেউ যদি গান শোনে তার সামনে গানের মিউজিকগুলো বিভিন্ন রংয়ের মতো ঘুরতে থাকে। সেবনকারী অত্যন্ত হিংসাত্মক ও আক্রমণাত্মক আচরণ করে। একটি এলএসডি ব্লট সেবন করলে ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত এর প্রতিক্রিয়া থাকে। অতিরিক্ত সেবনে ২০ ঘণ্টা পর্যন্তও প্রতিক্রিয়া হয়।
ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, ‘এটি সেবন করে সেবনকারী নিজেকে অনেক শক্তিশালী ভাবে। তিনি ভাবেন যে সে উড়তে পারে। তার অতীত স্মৃতি চলে আসে। অনেকে বলেছে, এটি সেবনের পর তারা মনে করে যে তারা ট্রেন ধাক্কা দিতে পারবে।’
লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাই-ইথ্যালামাইড বা এলএসডি এক ধরনের তরল। ভারতের অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যুর পর এই মাদকটি আলোচনায় আসে। তার বিরুদ্ধে এই মাদক নেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল।
এলএসডি অত্যন্ত দামি একটি মাদক। সাধারণত ব্লটিং পেপারের ওপরে এই তরল মাদক ফেলে সেই কাগজ শুঁকে নেশা করে মাদকাসক্তরা। এলএসডি মাখা এক-একটি ছোট ছোট টুকরো ব্লটিং পেপারের দাম কয়েক হাজার টাকা।
১৯৩৮ সালে সুইস রসায়নবিদ আলবার্ট হফম্যান প্যারাসাইটিক ফাঙ্গাস নিয়ে কাজ করতে গিয়ে এলএসডি আবিষ্কার করেন। আবিষ্কারের প্রথমদিকে এলএসডি ওষুধ হিসেবে ব্যবহার হতো। তবে ওষুধটি মস্তিষ্কের ক্ষতি করে বলে একে নিষিদ্ধ করা হয়।
বিজ্ঞানীরা জানান, সাধারণত এলএসডি নেওয়ার পর একজন মানুষ চোখ বন্ধ করেও দেখতে পায়। তার দেখা এসব দৃশ্য সবসময় বাইরের পৃথিবী বা স্মৃতি থেকে আসে না বরং তাদের কল্পনাশক্তি অনেক বেড়ে যায়। এলএসডির প্রভাবে মস্তিষ্কের অন্যান্য যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে।
তারা বলেন, এলএসডি নেওয়ার পর প্রকৃতি ও বাইরের জগতের সঙ্গে এমন এক সম্পর্ক অনুভূত হয় যাকে অনেকসময় ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক রূপ দেওয়া হয়ে থাকে। এই মাদকের প্রভাব কেটে গেলেও ওই রকম অনুভূতি থেকে যেতে পারে।
এলএসডি ব্যবহার করলে মানুষের স্মৃতির ভাণ্ডার খুলে যায়। নেশার চূড়ান্ত পর্যায়ে কেউ কেউ মাতৃগর্ভের স্মৃতিও মনে করতে পারেন। তবে সে সব স্মৃতির ভার অধিকাংশ মানুষই সহ্য করতে পারেন না। ফলে মস্তিষ্ক বিকৃতির প্রবল সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া অধিকাংশ মাদকগ্রহণকারীই স্মৃতির চূড়ান্ত স্তরে প্রবেশের আগে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। এলএসডি গ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই এমন দাবি করে থাকেন। তবে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা বলছেন, হ্যালুসিনেশনই এসব অনুভূতির মূল কারণ।
এআর/এমএইচএস