কলকাতা বইমেলায় বাংলাদেশের না থাকা নিয়ে প্রতিক্রিয়া

গত ২৮ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া ৪৮তম আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা শেষ হয়েছে রোববার (৮ ফেব্রুয়ারি)। মেলায় বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশ অংশ নিলেও এবার ছিল না বাংলাদেশ।
কলকাতায় প্রায় অর্ধশতাব্দীর ঐতিহ্যমণ্ডিত এ বইমেলাতে ১৯৯৬ সাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দিয়ে আসছে বাংলাদেশ। প্রতি বছর বইমেলার আকর্ষণ হিসেবে থাকতো বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থাপত্যের অনুকরণে তৈরি বিশাল প্যাভিলিয়ন। মেলায় বহুবার ‘থিম কান্ট্রি’ হিসেবেও মনোনীত হয়েছে বাংলাদেশ। এদিকে পশ্চিমবঙ্গের পাঠকরাও অপেক্ষা করে থাকতেন বাংলাদেশের লেখকদের নতুন নতুন বইয়ের জন্য।
কিন্তু গত অগাস্টে রাজনৈতিক পালাবদলের পর এবারের কলকাতা বইমেলায় বাংলাদেশ অনুপস্থিত ছিল। মেলার আয়োজকদের ভাষ্যমতে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক কারণেই বাংলাদেশের যোগদান সম্ভব হয়নি। কয়েকমাস ধরে ভারত সরকার মেডিকেল ও ইমার্জেন্সি কেস ছাড়া বাংলাদেশি নাগরিকদের ভিসা দেওয়া বন্ধ রেখেছে। ফলে এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের প্রকাশক-লেখকরা চাইলেও কলকাতা বইমেলায় আসা সম্ভব ছিল না।
প্রায় তিন দশকের ঐতিহ্যর পরম্পরা ভেঙে এবারে কলকাতা বইমেলায় ছিল না বাংলাদেশের বইয়ের সম্ভার, লেখক, প্রকাশক বা কবিরাও।
কলকাতা বইমেলায় ‘বাংলাদেশ প্যাভিলিয়ন’ একটা বড় আকর্ষণ হয়ে উঠেছিল সেটাও এবারে মেলা প্রাঙ্গণে ছিল না। তার জায়গায় অনেকটা জায়গা নিয়ে রয়েছিল ‘থিম কান্ট্রি’ জার্মানির প্যাভিলিয়ন।
ঘরের পাশে প্রতিবেশী দেশের সাহিত্য সম্ভার এই বইমেলায় না থাকা নিয়ে কলকাতার পাঠক-লেখক-প্রকাশকরা কোন চখে দেখছেন জানতে চাইলে পশ্চিমবঙ্গের প্রবীণ নন্দিত লেখক ও গদ্যকার, সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার প্রাপ্ত লেখক স্বপ্নময় চক্রবর্তী বলেন, বাংলাদেশকে ছাড়া এই আয়োজন যে অসম্পূর্ণ, বলতে কোনো দ্বিধা নেই।
তিনি বলেন, প্রায় ৫০ বছর আগে কলকাতা বইমেলা যখন শুরু হয়, তখন থেকেই প্রতি বছর মেলায় আসছি। মেলায় ‘একটাও বাংলাদেশের স্টল নেই, পদ্মাপারের কোনো বই নেই’– এটা আমার কাছে নতুন ও যন্ত্রণাদায়ক একটা অভিজ্ঞতা!।
স্বপ্নময় চক্রবর্তী বলেন, এই যে পরিবেশনটা– বইমেলা যদি একটা পুরো প্লেট হয়, যেখানে আট ধরনের খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে, মনে হচ্ছে যেন নুনটা কম আছে! একটু নুন-কম, নুন-কম লাগছে.. বাংলাদেশটা এখানে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

‘আসলে ভাবনা, চিন্তা, দর্শন এগুলোর তো পাসপোর্ট-ভিসা লাগে না। এগুলো আপনি কর্ডনিং করে আটকাতে পারবেন না, বিএসএফ দিয়ে কী ফোর্স বা মিলিটারি বা তারকাঁটা দিয়েও পারবেন না। ভাবনাচিন্তা আসলে আটকানো সহজ নয়, এগুলো প্রোপ্যাগেট করে। বাংলাদেশের প্যাভিলিয়ন এখানে দেখতে পাব না, এটা আমার পক্ষে খুবই বেদনাদায়ক!’ বলেন স্বপ্নময় চক্রবর্তী।
তিনি বলেন, ঢাকার একুশে বইমেলাতেও হয়তো সরকারিভাবে পশ্চিমবঙ্গ আমন্ত্রিত হয় না, তাসত্ত্বেও বলব বাংলাদেশকে কলকাতা বইমেলার খুবই প্রয়োজন ছিল।
কলকাতার বই মেলার উদ্বোধনের দিনকয়েক আগে দিল্লিতে এসে গিল্ডের সভাপতি ত্রিদিব কুমার চট্টোপাধ্যায় ব্যাখ্যা করেছিলেন কেন এবারে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব থাকছে না।
দিল্লিতে জার্মান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে গিল্ডের সভাপতি ত্রিদিব কুমার চট্টোপাধ্যায় বলেন, কলকাতা বইমেলায় এবার বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব থাকছে না। ১৯৯৬ সাল থেকে বাংলাদেশ কলকাতা বইমেলাতে আসছিল। এবারে যে ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি চলছে, সেই বিষয়ে আমাদের মন্তব্য করা উচিত নয়। কিন্তু আমরা সবাই জানি কী চলছে। সে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কলকাতা বইমেলার পবিত্রতা, নিরাপত্তা এবং অন্য কোনো স্তর যাতে বিপদগ্রস্ত না হয় সেই জন্যই আমরা এবারে বাংলাদেশকে রাখতে পারছি না। যা খুবই দুর্ভাগ্যজনক।
তিনি আরও বলেন, সাহিত্যের কোনো সীমান্ত হয় না। কাঁটাতারের বেড়া হয় না। বাংলাদেশ থেকে যারা আসতে চেয়েছিলেন আমরা তাদের বলেছি আপনারা ভারত সরকারের মাধ্যমে আসুন। বাংলাদেশের কোনো প্রকাশক যদি ভারত সরকারের কাছ থেকে সরাসরি অনুমতি নিয়ে মেলায় আসতে চান, তাহলে কোনো আপত্তি থাকবে না।

গিল্ডের সাধারণ সম্পাদক ও দে'জ পাবলিশার্সের কর্ণধার সুধাংশু শেখর দে বলেন, বাংলাদেশের বন্ধুরা মেলায় এলে সত্যিই খুব খুশি হতাম। যে পরিস্থিতিতেই হোক তারা আসতে পারেননি, কিন্তু বই তো কোনো অপরাধ করেনি, বইয়ের তো কোনো সীমানা নেই, সীমারেখাও নেই!।
তিনি আরও বলেন, বইয়ের আদান-প্রদান, বই যেখানে যাওয়ার সেখানে যেতে দেওয়াটা খুব দরকার। বইকে বাধা দেওয়া বা আটকে রাখা হোক আমরা কখনও চাই না, চাই না বই একটা ব্যারিকেড হয়ে যাক।
বাংলাদেশের বইয়ের অনুরাগী ও প্রবীণ পাঠক অশোক মজুমদার বলেন, মিস তো করেছি। বাংলাদেশের লেখকদের অনেক ভালো ভালো গল্প আছে, কবিতা আছে। যদিও দাম বেশি বাংলাদেশের বইগুলোর, কিন্তু আমার পছন্দ।

তিনি বলেন, পরিস্থিতি একটু জটিল হয়ে আছে। চারদিকে খবর পড়ছি, আপনারা সব জানেন। আমি আশা করব আস্তে আস্তে এই পরিস্থিতি আমরা কাটিয়ে উঠব। বাংলাদেশ থেকে আমাদের লেখক বন্ধুরা, সিনিয়র লেখকরা আবার আসবেন। আমরা আবার একসঙ্গে চা খাব।
তিনি আরও বলেন, আমরাও কিন্তু আগে একই রকমভাবে অমর একুশে গ্রন্থমেলায় গিয়েছি। সেই যাতায়াতও এখন বন্ধ! আমি আশা করব সেই যাতায়াতও খুব দ্রুতই আমরা শুরু করতে পারব।
পশ্চিমবঙ্গের বর্ষীয়ান কবি সুবোধ সরকার বলেন, নিজেদের মধ্যে আলোচনায়, কবি-লেখক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবীরা সবাই বলছেন যে খুব দুর্ভাগ্যজনক! কিন্তু এ কথাটা মানতে হবে যে বাংলাদেশের সাহিত্য, বাংলা ভাষাতে লেখা হলেও তার পাঠক কলকাতায় কম। কিন্তু এই সত্যিটা মেনে নিয়েও বলব বাংলাদেশের বই আমাদের এখানে আসা উচিত!
সূত্র, বিবিসি বাংলা
এমএন