ড্যাপ-ইমারত নির্মাণ বিধি সংশোধনে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থার দাবি

ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) ও ইমারত নির্মাণ বিধিমালার সংশোধনে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা রাজউক এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের যে সব কর্মকর্তা গোষ্ঠীস্বার্থে কাজ করছে, তাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত তদন্তপূর্বক যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি)।
বুধবার (৫ ফেব্রুয়ারি) বাংলামোটরে বিআইপির কনফারেন্স রুমে ড্যাপ ও ইমারত নির্মাণ বিধিমালার সংশোধনে জনস্বার্থ, পরিবেশ ও বাসযোগ্যতার সংকট শীর্ষক ‘নাগরিক সংলাপে এ দাবি জানানো হয়।
বক্তারা বলেন, বিগত সময়ে গোষ্ঠীস্বার্থে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার পরিকল্পনায় যে-সব পরিবর্তন করা হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক সঠিক তদন্ত করে শ্বেতপত্র প্রকাশ করবার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। পরিকল্পনা, ইমারত নির্মাণ, উন্নয়ন, পরিবেশ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন আইন প্রণয়ন ও সংশোধন প্রক্রিয়ায় স্বার্থান্বেষী মহলের প্রভাবের বিষয়ে তদন্তপূর্বক আইনসমূহের প্রয়োজনীয় সংশোধনীর ব্যবস্থা অচিরেই গ্রহণ করা দরকার।
আরও পড়ুন
আলোচকরা বলেন, দেশের মানুষের আর্থ সামাজিক ও পরিকল্পনাগত বিষয়াদি, সংস্কৃতি, কমিউনিটি প্রভৃতি বিষয়াদিকে বিবেচনায় নিয়ে পরিকল্পনার দর্শন ঠিক করা এবং কেমন শহর মানুষ চায় সেই ব্যাপারে গণমানুষকে সম্পৃক্ত করেই ইমারত সংশ্লিষ্ট আইন, বিধিবিধান ও পরিকল্পনা তৈরি করা দরকার। পরিকল্পনা প্রণয়নে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট মহলের অনৈতিক প্রভাবকে দূর করে পরিকল্পনাবিদদের স্বাধীনভাবে কাজ করবার সুযোগ না দিলে শহরকে বাসযোগ্য করা এবং পরিকল্পিত ও টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়।
বিআইপির পক্ষ থেকে বলা হয়, ২০০৮ সালের ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় আবাসিক ভবনের জন্য মোটা দাগে রাস্তার প্রশস্ততা ও প্লটের আয়তনের উপর ভিত্তি করে সর্বনিম্ন ‘এফএআর’ মান ৩.১৫ ও সর্বোচ্চ ৬.৫ দেওয়া হয়েছিল। বর্তমান বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় আবাসিক এ৩ (ফ্ল্যাট বা এপার্টমেন্ট) শ্রেণীর জন্য এই মান সর্বোচ্চ ৪.২৫ নির্ধারণ করা হয়েছিল, যা মে’২০২৪ সালে খসড়া ইমারত বিধিমালায় অনুসরণ করা হয়েছিল।
অথচ ডিসেম্বর ২০২৪ সালে রাজউক কর্তৃক প্রণীত ইমারত বিধিমালার খসড়াতে প্লটভিত্তিক আবাসিক এ৩ ক্যাটাগরির ফার মান ৫.৫ করা হয়েছে, যা প্রায় অবাসযোগ্য ঢাকা শহরের উপর চাপ মারাত্মকভাবে বাড়িয়ে দেবে। অথচ বৈশ্বিকভাবেই ছোট আয়তনের প্লটভিত্তিক আবাসিক ভবনের ক্ষেত্রে ফার মান সাধারণত ১ থেকে ৩ এর মধ্যেই হয়ে থাকে। ড্যাপে এলাকাভিত্তিক ফার ও জনঘনত্ব দুই থেকে তিনগুণ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে রাজউক। অথচ সেসব এলাকার নাগরিক সুবিধাদি একই থাকছে। গোষ্ঠীস্বার্থে বিধিমালার ফার মান পরিবর্তন শহরের জন্য বাসযোগ্যতার জন্য মারাত্মক হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
সেখানে বলা হয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খেলার মাঠ বিবেচনায় নিয়ে ফার মান সাধারণত থাকে ১-৩ এর মধ্যে। অথচ প্রস্তাবিত বিধিমালায় ফার মান সর্বোচ্চ ৬, ৭, এমনকি এনএর বা নিয়ন্ত্রণহীন ফার মান প্রস্তাব করা হয়েছে। নগর পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নগর এলাকার ধরন, মান ও অবস্থান অনুযায়ী পরিকল্পনার কৌশল, জনঘনত্ব, ফার মান, উচ্চতা সীমা প্রভৃতি ভিন্ন হয়ে থাকে। ২০২৪ সালের শুরুতে প্রস্তুতকৃত খসড়া ইমারত বিধিমালায় আবাসিক এলাকার ফার মান বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার সঙ্গে সংগতি রেখে কেন্দ্রীয় ঢাকা, বহিস্থ নগর ও অন্যান্য নগর এলাকার জন্য পৃথক ফার মান দেওয়া হয়েছিল। এটা অত্যন্ত বিস্ময়কর যে বর্তমান ইমারত বিধিমালা প্রস্তাবনায় এই এলাকাভিত্তিক প্রস্তাবনা বাদ দেওয়া হয়েছে। ভবনের সেটব্যাক দূরত্ব যথাযথ করে ভবনের ভেতর প্রাকৃতিক আলো-বাতাস চলাচলের বিষয়টিও উপেক্ষিত বিধিমালার প্রস্তাবনায়।
ইমারত বিধিমালায় প্রস্তাবিত রাস্তার উপর ফার দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে স্বার্থান্বেষী মহল। ন্যূনতম এমজিসি বা ভূমি আচ্ছাদন এর প্রস্তাবনা বাদ দিয়ে স্বার্থসিদ্ধি করতে চায় এই মহল। প্রস্তাবনাসমূহে পরিকল্পনা সংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহে খুবই দুর্বলভাবে নিয়ে এসে নগরে ঝুঁকির মাত্রা কমানো ও নাগরিক সুবিধাদি বাড়ানোর উদ্যোগ নেই সংশোধন প্রস্তাবে। পার্ক-খেলার মাঠ-বিদ্যালয় না নির্মাণ করে শহরের জনঘনত্ব বাড়ানোর প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) এর সংশোধনী প্রস্তাবে, যা শুধু শহরের ধ্ববংসায়নই বাড়াবে, কমাবে বাসযোগ্যতা।
বিআইপির সাধারণ সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসানের সঞ্চালনায় ‘নাগরিক সংলাপে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান, বিআইপির সাধারণ সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান, বিআইপির উপদেষ্টা পরিষদের আহ্বায়ক পরিকল্পনাবিদ মো. ফজলে রেজা সুমন, বাংলাদেশ গাছ রক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়কারী আমিরুল রাজীব, ধরিত্রী আন্দোলনের সদস্য সচিব মোহাম্মদ শরীফ জামিল, রিভার এন্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ, বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. আনোয়ার জাহিদ, বায়ুমণ্ডল অধ্যায় কেন্দ্রের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কামরুজ্জামান মজুমদার প্রমুখ।
এএসএস/এমএসএ