বিএবির তহবিলের ১৭৫ কোটি লুটপাটের প্রমাণ দুদকে

বিভিন্ন ইস্যুতে ব্যাংকে থেকে চাঁদা উত্তোলন করে ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (বিএবি) হিসাবে জমাকৃত ১৭৫ কোটি টাকা লুটপাটের প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
২০১৪ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে এক্সিম ও প্রিমিয়ার ব্যাংকের দুটি হিসাবেই প্রায় ১৭৫ কোটি টাকা জমা হলেও তার কোনো যথাযথ হিসাব পাওয়া যায়নি। অভিযোগ রয়েছে, ব্যাংক হিসাবের বাইরেও হাজার কোটি টাকার অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য রয়েছে। যদিও তার সরাসরি তথ্য-প্রমাণ আপাতত পাওয়া যায়নি। সেজন্য প্রকাশ্য অনুসন্ধান শুরু করতে পারে।
মঙ্গলবার (১৪ জানুয়ারি) দুপুরে গুলশান অ্যাভিনিউয়ের জাব্বার টাওয়ারে সংগঠনটির কার্যালয়ে দুদকের সহকারী পরিচালক মো. আশিকুর রহমানের নেতৃত্বে অভিযান চালানো হয়।
বিষয়টি নিশ্চিত করে দুদকের উপপরিচালক আকতারুল ইসলাম বলেন, বিএবিএর চেয়ারম্যান ও নির্বাহীদের বিভিন্ন ব্যাংক থেকে বেআইনিভাবে চাঁদা উত্তোলন করার অভিযোগে এই অভিযান পরিচালনা করে দুদক। অভিযান চলাকালে বিভিন্ন রেকর্ডপত্র ও বিএবির ব্যাংক হিসাব পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিএবির আর্টিকেল অব অ্যাসোসিয়েশনে বিধান না থাকা সত্ত্বেও ওই অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার ও অন্য সদস্যরা ক্ষমতার অপব্যবহার করে ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে শত শত কোটি টাকা চাঁদা তুলেছেন, যা বিএবির আয়ব্যয় হিসাবে যথাযথভাবে প্রতিফলন হয়নি।
বিএবি ও দুদক সূত্রে এ বিষয়ে আরও জানা যায়, ৯টি ব্যাংক দিয়ে সংগঠনটির যাত্রা শুরু হয় ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (বিএবি)। বর্তমানে এর সদস্য ৪১ ব্যাংক। নিয়ম অনুযায়ী ব্যাংক থেকে প্রতি বছরে ৪ লাখ টাকা চাঁদা তোলা হয়। প্রতিটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদাধিকার বলে নির্বাহী কমিটির সদস্য। যাদের মধ্য থেকে চেয়ারম্যানসহ কয়েকটি পদ ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়। কিন্তু ক্ষমতার অপব্যবহার করে ২০০৮ সালে এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার বিএবির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে ২০১৪ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে। অথচ নিয়ম অনুযায়ী দুই বছর পরপর নির্বাচন হওয়ার কথা। কিন্তু তিনি ১৭ বছর ধরে জোর করে দায়িত্ব পালন করে হাজার কোটি টাকার অনিয়মের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছেন। ২০১৩ সালে সবচেয়ে বেশি অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে বলে দুদকের অভিযানে প্রমাণ মিলেছে।
সূত্র জানায়, ২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এক্সিম ও প্রিমিয়ার ব্যাংকের দুটি অ্যাকাউন্টে প্রায় ১৭৫ কোটি টাকা ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে নিয়েছে বিএবি। যা আইনসিদ্ধ নয়। নজরুল ইসলাম মজুমদার বিভিন্ন ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তাদের ফোন দিয়ে অর্থ আদায় করেছেন। ব্যাংক, গ্রাহক ও ব্যাংক কর্মকর্তাদের স্বার্থ দেখার কথা থাকলেও তিনি নিজের এবং আওয়ামী সরকারের দলীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সংগঠনটির ফান্ড থেকে অবৈধ উপায়ে জয় বাংলা কনসার্টে জিরো কমিনিউকেশকে ২২ কোটি টাকা অনুদান দেওয়া হয়। সংগঠনটির সম্পদের মধ্যে বিএবির নামে জব্বার টাওয়ারে একটি ফ্লোর ৬ কোটি ১৭ লাখ টাকায় ক্রয় ও ৫ কোটি টাকা এফবিআর থাকার তথ্য পেয়েছে দুদক।
দুদকের এনফোর্সমেন্ট টিম অভিযোগ-সংক্রান্ত রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করে কমিশন বরাবর শিগগিরই পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দাখিল করবে বলে জানা গেছে।
২০০৮ সাল থেকে টানা ১৭ বছর বিএবির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন এক্সিম ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার। এ সময় তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অতি ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিতি পান। ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তাকে সরিয়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে বিএবির চেয়ারম্যান পদও হারান তিনি। সরকার বদলের পর নজরুল ইসলাম মজুমদারের নেতৃত্বাধীন বিএবির দুই ভাইস চেয়ারম্যানও ব্যাংকের পরিচালক পদ হারান।
তারা হলেন—আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুস সামাদ। অপরজন হলেন—ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) ভাইস চেয়ারম্যান আনিসুজ্জামান চৌধুরী। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের আগে সর্বশেষ ‘শেখ হাসিনা আন্তঃব্যাংক ফুটবল টুর্নামেন্ট’ আয়োজন করে বিএবি। এ জন্যও ব্যাংকগুলো থেকে চাঁদা তোলা হয়। নজরুল ইসলাম মজুমদারের নেতৃত্বে বিএবি গত ১৫ বছরে বিভিন্ন ইস্যুতে ব্যাংকগুলো থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা তুলেছেন বলে জানান ব্যাংকাররা। এ জন্য সরকার বদলের পর এসব টাকার ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, দাবি ওঠে নিরীক্ষার।
আরএম/এএমকে