পুলিশের প্রতিবেদনের ‘অপেক্ষায়’ জাতিসংঘ
ছাত্র-জনতার আন্দোলন কতটা নৃশংসভাবে দমনের চেষ্টা করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার, সে বিষয়ে জাতিসংঘের একটি অগ্রবর্তী এবং তথ্যানুসন্ধান দল তদন্ত করেছে। তথ্যানুসন্ধান দলের বাংলাদেশে মাঠপর্যায়ে কাজ শেষে গত বছরে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের একটি সংস্থার প্রতিবেদন না পাওয়ায় এখনো আটকে আছে প্রতিবেদনের কাজ।
সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, জুলাই অভ্যুত্থান ঘিরে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড ও অপরাধ বিষয়ে জাতিসংঘের তদন্ত কমিটিকে বেশ কয়েকটি সংস্থার প্রতিবেদন জমা না দেওয়ার তথ্য সঠিক নয়। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই), জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা অধিদপ্তর (এনএসআই), টেলিযোগাযোগসহ অন্যান্য সংস্থার প্রতিবেদন জাতিসংঘে অনেক আগে চলে গেছে। শুধুমাত্র পুলিশের প্রতিবেদন এখনো জাতিসংঘে পাঠাতে পারেনি সরকার। তবে খুব শিগগিরই যেন সংস্থাটির প্রতিবেদন জাতিসংঘে পাঠানো যায়, সেজন্য তাগিদ দেওয়া হচ্ছে।
গত ৫ আগস্ট ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। এরপর ৮ আগস্ট গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ড. মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব নেওয়ার পর জুলাই ও আগস্টের শুরুতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো তদন্তের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ লক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টা জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ককে চিঠি লেখেন।
আরও পড়ুন
পরবর্তী পদক্ষেপে তদন্তের জন্য জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রধান রুরি ম্যানগোভেনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি অগ্রবর্তী দল ২২ আগস্ট থেকে ২৯ আগস্ট পর্যন্ত ঢাকা সফর করেন। এরপর তদন্ত করার জন্য জাতিসংঘের মূল দল তথা তথ্যানুসন্ধান দল এক মাসের বেশি সময় বাংলাদেশে অবস্থান করে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া মানবতাবিরোধী অপরাধ, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ ১৫ ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তদন্ত করে। তদন্তের স্বার্থে সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধান দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করেছে।
তদন্ত প্রতিবেদন গত বছরের (২০২৪) নভেম্বরের শেষ সপ্তাহের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জমা দেওয়ার সম্ভাবনার কথা জানানো হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে অবশ্য সরকারের সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টারা তথ্যানুসন্ধান দলের তদন্তের প্রতিবেদন ডিসেম্বরে পাওয়ার কথা বলে আসছিলেন। তবে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন সংস্থা থেকে যথাসময়ে প্রতিবেদন না পাওয়ায় এখনো পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনের কাজ শেষ করতে পারেনি জাতিসংঘ।
জানা গেছে, বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন সংস্থা থেকে প্রতিবেদন পেতে চিঠি দিয়ে বারবার তাগিদ দিয়েছে জাতিসংঘ। সবশেষ, অক্টোবরে চিঠি দিয়ে নভেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলেছিল সংস্থাটি। কিন্তু এরপর কেটে গেছে বেশ কিছু সময়। তবে সরকারের সংশ্লিষ্টরা বলছে, পুলিশ থেকে তথ্য পেলে চলতি মাসের মাঝামাঝিতে সম্ভব না হলেও শেষের দিকে জাতিসংঘে প্রতিবেদন পাঠাতে চায় সরকার।
আরও পড়ুন
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, জুলাই-আগস্টে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো তদন্তের স্বার্থে আমাদের বিভিন্ন সংস্থাগুলোর তথ্য পেলে চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরি করবে জাতিসংঘ। আমাদের সংস্থাগুলোর প্রাপ্ত তথ্যের কম্পাইল করতে গিয়ে দেখা যায়, তথ্যগত অনেক গরমিল হচ্ছে। এ ধরনের তথ্য দিয়ে জাতিসংঘে প্রতিবেদন পাঠাতে গেলে স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাবে। পরে আবার যাচাই-বাছাই করা হয় এবং পুলিশ বাদ দিয়ে অন্যান্য সংস্থার প্রতিবেদন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। আর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রাপ্ত প্রতিবেদন জেনেভার বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনের মাধ্যমে জাতিসংঘের কাছে পাঠিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ‘পুলিশের প্রতিবেদন দিতে দেরি হচ্ছে। যেটা কিনা সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ। এটা না পাওয়ায় একটু সময় লেগে যাচ্ছে।’
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, যেসব সংস্থার প্রতিবেদন আমরা পেয়েছি সঙ্গে সঙ্গে কূটনৈতিক চ্যানেলে জাতিসংঘে পাঠানো হয়েছে। কিছু তথ্য না পাওয়ায় আমরা জাতিসংঘের বেঁধে দেওয়া সময়ে দিতে পারিনি। আশা করছি, যে প্রতিবেদন পাঠাতে আমাদের একটু সময় লাগছে সেটা জানুয়ারির মাঝামাঝিতে পাঠাতে পারব। আর জাতিসংঘ আমাদের সংস্থার প্রতিবেদন পেলে তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদন করতে পারব।
আরও পড়ুন
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, আমি আশা করি— জানুয়ারির মধ্যে সব রিপোর্ট পেয়ে যাব।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধান দলটি এক মাসের বেশি সময় বাংলাদেশ অবস্থান করেছেন। এ সময় তারা ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রংপুরসহ দেশের আটটি বিভাগীয় শহর ঘুরে সহিংসতার শিকার ব্যক্তি, ভুক্তভোগীদের স্বজন এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য নেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছেন। সরকারি পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কর্মকর্তা, নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করেছেন। তদন্তের স্বার্থে প্রতিনিধিদল ছাত্র আন্দোলনের নেতা, বেসরকারি সাহায্য সংস্থার প্রতিনিধি, মানবাধিকারকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেছেন। এ ছাড়া, তারা সহিংসতার শিকার ব্যক্তি, ঘটনার সাক্ষী এবং বিভিন্ন সংস্থার সহযোগিতা নিয়েছে।
তথ্যানুসন্ধান দলটি গত জুলাই ও আগস্টের শুরুর দিকে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া মানবতাবিরোধী অপরাধ, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ ১৫ ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তদন্ত করেছে। তারা মানবতাবিরোধী অপরাধ, নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যা, রাজনৈতিক ও বেসরকারি পক্ষগুলোর মাধ্যমে হত্যা ও নির্যাতন, জনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার নামে মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগ, নিবর্তনমূলক আটক ও গ্রেপ্তার, গুম, ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন রাখা, সরকারি ও বেসরকারি সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে জোর দিয়েছে।
এনআই/এমজে