আদালত পাড়ায় পুলিশ ছিল ‘নির্বিকার’
চট্টগ্রাম আদালত এলাকায় গত ২৬ নভেম্বর বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর অনুসারীদের হাতে নির্মমভাবে খুন হন আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ। আইনজীবীদের অভিযোগ, ওই দিন নির্বিকার ছিল পুলিশ। শুধু তা-ই নয়, অনুরোধ করার পরও আদালত এলাকায় পর্যাপ্ত পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়নি।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, আদালত যেহেতু কোতোয়ালি থানা এলাকায়, এ কারণে নিরাপত্তার দায়িত্ব বর্তায় ওই থানা পুলিশের কাঁধে।
আইনজীবীরা জানান, গুরুত্বপূর্ণ আসামিদের বিচারিক প্রক্রিয়ার শুনানিতে বিপুল আইনজীবী অংশ নেন। এ ছাড়া আদালত পাড়ায় বিশৃঙ্খলা এড়াতে আসামিকে আদালতে তোলার আগে বিচারকের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে থাকেন কোতোয়ালি থানার ওসি। পরে সকাল কিংবা বিকেলে আসামিকে আদালতে হাজির করা হয়। অন্যদিকে, প্রভাবশালী আসামিদের আদালতে হাজির করার আগে বিভিন্ন সতর্কতা ব্যবস্থা নেয় পুলিশ। কিন্তু আইনজীবী আলিফ হত্যাকাণ্ডের দিন আদালত পাড়ায় পুলিশ ছিল ‘নির্বিকার’।
আরও পড়ুন
ওই দিন আদালত এলাকায় নিরাপত্তার খণ্ডচিত্র
প্রত্যক্ষদর্শী আইনজীবীরা জানান, ২৫ নভেম্বর গ্রেপ্তারের পর ২৬ নভেম্বর চিম্ময় দাসকে আদালতে তোলা হয়। ওই দিন আদালত এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পর্যাপ্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়নি।
আইনজীবী রায়হানুল ওয়াজেদ চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, চিম্ময় দাসকে যে দিন আদালতে তোলা হয় সে দিন আদালতের বিভিন্ন প্রবেশমুখে চেকপোস্ট বসানো হয়নি। অথচ আগে প্রভাবশালী আসামিদের ক্ষেত্রে তা করা হতো। এ ছাড়া ওই দিন আগেভাগে চিন্ময়কে আদালতে হাজির করা হয়। তাকে হাজির করার এক ঘণ্টা পর বিচারক এজলাসে বসেন। ওই এক ঘণ্টা সময়ের মধ্যে চিন্ময়ের সমর্থকেরা বিনা বাধায় দলে দলে আদালতে প্রবেশ করেন।
তিনি আরও বলেন, কোতোয়ালি থানার তৎকালীন ওসি ফজলুল কাদের চৌধুরী পর্যাপ্ত পুলিশ ফোর্স আদালতে আনেননি। ফলে চিন্ময়ের কাছাকাছি চলে যান তার সমর্থকেরা। এমনকি পুলিশ হেফাজতে থাকা অবস্থায় মাইক হাতে চিন্ময় বক্তব্য রাখেন। তাকে ডাব এনে খাওয়ান সমর্থকেরা। পরে আদালত চিন্ময়ের জামিন না মঞ্জুর করলে তার অনুসারীরা বিক্ষোভ শুরু করেন। এ ছাড়া আশপাশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর ও প্রিজনভ্যান আটকে দেন তারা। একপর্যায়ে চট্টগ্রাম আদালতের সবচেয়ে বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটে। আইনজীবী আলিফ নির্মমভাবে খুন হন, আহত হন কয়েকজন।
‘এ ঘটনায় আমরা সবচেয়ে বেশি পুলিশকে দায়ী করছি। কারণ, তারা সে দিন পেশাদার আচরণ করেননি। ওসি ঘটনার তীব্রতা বুঝেও পর্যাপ্ত ফোর্স আনেননি। অন্যদিকে, পুলিশ নির্বিকার থাকায় খুনিরা সহজে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে পালিয়ে যায়।’
ওসি ফজলুল কাদেরের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর নগরীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোতোয়ালি থানার ওসি হিসেবে দায়িত্ব পান ফজলুল কাদের। এর আগে তিনি কোনো থানায় ওসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেননি। অভিযোগ রয়েছে, পুলিশের শীর্ষপর্যায়ের কোনো কর্মকর্তার আশীর্বাদে তাকে পদায়ন করা হয়।
জানা যায়, কোতোয়ালি থানার ওসি হওয়ার আগে ফজলুল কাদের পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) ছিলেন। সিআইডির চট্টগ্রাম মেট্রো ও জেলা ইউনিটে দায়িত্ব পালনকালে তার অপেশাদার আচরণে ক্ষুব্ধ ছিলেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এমনকি তার বিরুদ্ধে দুবার বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন (এসিআর) পাঠানো হয়েছিল। সাধারণত এসিআর পাঠানো হয় যথাযথ দায়িত্ব পালন না করা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। এ ধরনের কর্মকর্তাদের প্রথমে মৌখিকভাবে সতর্ক করা হয়, এরপর লিখিতভাবে সতর্ক করা হয়। এতেও সংশোধন না হলে তার বিরুদ্ধে এসিআর পাঠান ইউনিটপ্রধান।
ফজলুল কাদেরের বিরুদ্ধে ২০২২ সালে এসিআর পাঠান সিআইডি চট্টগ্রাম জেলা ও মেট্রো ইউনিটের পুলিশ সুপার শাহনেওয়াজ খালেদ। ২০২৩ সালেও তার বিরুদ্ধে এসিআর পাঠানো হয়। পরপর দুবার এসিআর পাঠানোর কারণে ফজলুল কাদেরকে চট্টগ্রাম জেলা ও মেট্রো ইউনিট থেকে সিআইডি হেডকোয়ার্টারে বদলি করা হয়। সেখানে তাকে একপ্রকার ওএসডি করে রাখা হয়।
আইনজীবী আলিফ হত্যাকাণ্ডের পর নড়েচড়ে বসেন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। ঘটনার পরপরই ওসি ফজলুল কাদেরকে গোয়েন্দা পুলিশে বদলি করা হয়।
আরও পড়ুন
চট্টগ্রাম সিআইডি’র এসপি শাহনেওয়াজ খালেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ফজলুল কাদের আমার ইউনিটে ছিলেন। তার বিরুদ্ধে প্রক্রিয়া অনুসরণ করে পরপর দুবার এসিআর (বার্ষিক গোপনীয় অনুবেদন) পাঠানো হয়।
ফজলুল কাদের বর্তমানে চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ উত্তর ও দক্ষিণ জোনের কর্মকর্তা। তার বিরুদ্ধের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমার সঙ্গে সিআইডির এসপি স্যারের ভালো সম্পর্ক ছিল। তারপরও আমার বিরুদ্ধে কেন এসিআর পাঠানো হয়েছে, আমি জানি না। এ ছাড়া আদালতের যে ঘটনা ঘটেছিল, সে দিনও আমি যথাযথ দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেছি।’
প্রসঙ্গত, আইনজীবী সাইফুল হত্যার ঘটনায় তার বাবা জামাল উদ্দিন বাদী হয়ে ৩১ জনের নাম উল্লেখ করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। এ ছাড়া ওই দিনের ঘটনায় আরও পাঁচটি মামলা হয়। মোট ছয় মামলায় গ্রেপ্তার হন ৪০ জন।
আইনজীবী হত্যায় গ্রেপ্তার আসামিরা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে দিয়েছেন। তারা জানান, আইনজীবী আলিফের ঘাড়ে বঁটি দিয়ে দুটি কোপ দেন রিপন দাস। আর কিরিচ দিয়ে কোপান চন্দন দাস। পরে রাস্তায় পড়ে থাকা এ আইনজীবীকে লাঠি, বাটাম ও ইট দিয়ে আঘাত করেন ১৫ থেকে ২০ জন।
এমআর/এমএসএ