পেট মানে না শীত
মাঝ পৌষে রাজধানীতে হঠাৎ শীত জেঁকে বসেছে। কুয়াশার সঙ্গে বইছে হিম শীতল বাতাস। তাতে ভোগান্তি বেড়ে যাওয়ায় প্রয়োজন ছাড়া লোকজন বাইরে বের হচ্ছেন না। তবুও জীবিকার তাগিদে যাদের বের হতে হয়েছে তারা পড়েছেন চরম বিপাকে। বিশেষ করে কর্মজীবী মানুষের কাঁপুনি তুলেছে হঠাৎ শীতের আগমনে।
বৃহস্পতিবার (২ জানুয়ারি) সকালে রাজধানীর বাড্ডা লিংক রোড থেকে মধ্যবাড্ডার সড়কের পাশের ফুটপাতে একদল লোককে দেখা যায়, শরীরে নেই তেমন কোনো গরম কাপড়, শীতে কাঁপছে, সাধারণ পোশাকের সঙ্গে শুধু একটা গামছা গায়ে জড়ানো। তার আসলে প্রতিদিন এ এলাকায় নিজেদের শ্রম বিক্রি করতে আসেন। যাদের বাড়িতে বা প্রতিষ্ঠানে কাজের দরকার তারা এখান থেকে তাদেরকে চুক্তি করে নিয়ে যান। বিনিময়ে দিন শেষে ৭০০/৮০০ টাকা মজুরি মেলে তাদের।
তারা বলছেন- শীত পড়েছে খুব, তবুও ভোরে এসে দাঁড়িয়েছে। যত শীতই পড়ুক কাজে যেতে হবে, নইলে খাবার জুটবে না। কারণ পেট মানে না শীত। কাজ না করলে খাওয়া নেই।
আরও পড়ুন
শীত উপেক্ষা করে কাজ পাওয়ার আশায় অপেক্ষা করছিলেন ৬১ বছর বয়সী কাসেম মিয়া। তিনি বলেন, শীত তো লাগেই, কিন্তু কি করার, একদিন কাজ না করলে পেটে খাবার জুটবে না। তাই যতই শীত পড়ুক আমাদের ভোরেই বাইরে আসতে হয়েছে। দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করছি আজকের কাজ পাওয়ার জন্য। বেলা অনেকখানি গড়িয়েছে, তবুও কাজ পাইনি, শীতের কারণে মানুষের বাইরে চলাচল কম।
গরম কাপড় না পরার কারণে শীতে কাঁপছেন, বলার পর তিনি বলেন, কাজ শুরু করলে তো আর শীত লাগে না, তাই গরম কাপড় নিয়ে আসা হয়নি। কিন্তু আজ তীব্র শীত হাড় পর্যন্ত কাঁপিয়ে ফেলছে। শীত হোক, বৃষ্টি হোক, রোদ হোক তবুও আমাদের কাজের জন্য বের হতে হবেই। আমাদেরও শীত লাগে, কিন্তু এই শীত পেট মানে না।
কাজের জন্য দাঁড়িয়ে থাকা পাশের আরেকজন আব্দুস সালাম। তিনিও শীতে প্রায় জবুথবু। তিনি বলেন, বৃষ্টির মতো করে পড়ছে কুয়াশা, ভোরে এটা আরো বেশি ছিল, বেলা বেড়েছে তবুও সূর্যের কোনো দেখা নেই। এরমধ্যে অন্যদের যেমন শীত লাগছে, আমারও তেমনি শীতে ধরেছে, কিন্তু শীত দেখে তো লাভ নেই, শীতের ভয় থাকলে পেটে খাবার জুটবে না। যে কারণে বাধ্য হয়ে আমাদের বের হতে হয়, এই শীতের মধ্যেও কাজ করতে হয়। আজ আবার অতিরিক্ত শীত এই শীতে এখনো কেউ আসেনি আমাদের কাজে নিয়ে যাওয়ার জন্য। বেলা গড়ালেও এখনো কাজ না পেয়ে বসে আছি, শীতে কাঁপছি। কিন্তু সংসার, নিজের পেট চালাতে হলে শীত ভুলে কাজ করতেই হবে।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন ২১ নম্বর ওয়ার্ডের পরিচ্ছন্নতাকর্মী হাফিজা খাতুন। তিনিও বের হয়েছেন ভোরে। শীতে জবুথবু, তবুও টানছেন ময়লার গাড়ি, করছেন ময়লা সংগ্রহ। তিনি বলেন, গায়ে গরম কাপড় রেখে কাজ করা যায় না, তাই গরম কাপড় পরে আসা হয়নি। কিন্তু ভোর থেকে তীব্র শীত, শীতের কাঁপুনিতে বলতে গেলে কিছুই করতে পারছি না। কিন্তু কাজ না করলে সংসার চলবে কীভাবে? যে কারণে বাধ্য হয়ে শীতের ভোর থেকেই কাজ করতে হচ্ছে। এর চেয়ে বেশি শীত হলেও আমাদের কাজ করেই খেতে হবে।
ফুটপাতে একটি বক্স নিয়ে বসে পান-সিগারেট বিক্রি করছেন ব্যবসায়ী জাফর মিয়া। তিনি বলেন, চাদর মাফলার সবকিছু পরেও শীত মানছে না। কিন্তু আমার ছোট্ট এই ব্যবসার জন্য ভোরেই বের হতে হয়েছে। শীতের চোটে কাঁপুনি উঠে যাচ্ছে, তবুও এই কাজ না করলে বুড়াবুড়ি আমাদের দুজনার সংসারে খাবার জুটবে না। তাই শীতকে ভয় পেয়ে কাজে বের না হওয়ার কোনো উপায় নেই।
রিকশা চালক সিরাজুল ইসলামও শীত ভুলে সকালেই রিকশা নিয়ে বের হয়েছেন। শরীরে নেই কোনো গরম কাপড়। তিনি বলেন, গরম কাপড় পড়ে রিকশা চালানো যায় না, তাই গরম কাপড় ছাড়া বের হয়ে এখন মহাবিপদে। খুব শীত লাগছে। এরমধ্যে যাত্রী সংখ্যাও খুবই কম। শীতকে ভয় পেয়ে রিকশা না চালালে একদিকে যেমন দেওয়া যাবে না জমা খরচের টাকা, অন্যদিকে নিজের সংসারও চলবে না। তাই বাধ্য হয়ে কাঁপতে কাঁপতে রিকশা চালাচ্ছি। অন্যদের মতো আমারও মনে হয় এই তীব্র শীতে কম্বলের মধ্যে ঘরে শুয়ে থাকি। কিন্তু পেট মানে না শীত, তাই বাধ্য হয়ে আমাদের কাজে বের হওয়া।
এএসএস/জেডএস