এখন পর্যন্ত বেঁচে আছি— কারাগার থেকে ফিরে বাঁচার আকুতি ব্যবসায়ীর
৫ আগস্ট সরকার পতনের পর চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী খোরশেদ আলমের দুই প্রতিষ্ঠানে হামলা করে প্রায় ৩৬ লাখ টাকা লুট করে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। পরে রাজনৈতিক নেতার পিএস পরিচয়ে টাকা উদ্ধার করে ব্যবসা করতে সহায়তার আশ্বাস পান। আশ্বাস দিয়ে ১৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করা হয়। চাঁদার টাকা না পেয়ে অপহরণ করে তার ওপর চালানো হয় শারীরিক নির্যাতন। এরপর মিথ্যা মামলায় আসামি করা হয়। দীর্ঘ তিন মাস কারাগারে থেকে জামিনে বের হয়ে বাঁচার আকুতি জানিয়েছেন লোহাগাড়ার এই ব্যবসায়ী।
বুধবার (২৫ ডিসেম্বর) নগরের একটি রেস্টুরেন্টে সংবাদ সম্মেলন করে এসব কথা জানান তিনি।
ভোক্তভোগী খোরশেদ আলম লোহাগাড়া উপজেলার পদুয়া গ্রামের মৃত ছগির আহমেদের ছেলে। ‘মেসার্স রাইয়ান ট্রেডার্স’ এবং ‘রাইয়ান এন্টারপ্রাইজ’ নামে দুটি প্রতিষ্ঠানের মালিক তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব অভিযোগ করেছেন, চট্টগ্রাম মহানগর জামায়াতের আমিরের শাজাহান চৌধুরীর ব্যক্তিগত সচিব মো. আরমান উদ্দিনের বিরুদ্ধে।
আরও পড়ুন
সংবাদ সম্মেলনে ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী দাবি করেন, ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর তার দুই প্রতিষ্ঠানে হামলা করে প্রায় ৩৬ লাখ টাকা লুট করে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় মামলা হলে আরমান উদ্দিন তাকে ডেকে পাঠান। আরমান ওই ব্যবসায়ীকে টাকাগুলো উদ্ধার করে দেওয়ার বিনিময়ে ১৫ লাখ টাকা দেওয়ার দাবি জানান। একইসঙ্গে ভবিষ্যতে তাকে ব্যবসা করতে সহায়তা করবেন বলে আশ্বাস দেন।
খোরশেদ বলেন, ২১ আগস্ট মামলায় না জড়ানোর শর্তে আরমানের সঙ্গে আমার ৮ লাখ টাকা দেওয়ার মৌখিক চুক্তি হয়। মূলত দোকান খুলে দেওয়া এবং লুট করা মালামাল উদ্ধারের জন্য ৩ লাখ টাকা এবং কোনো মিথ্যা মামলায় আসামি না করার জন্য আরও ৫ লাখ টাকা দেওয়া হবে বলে আমি অঙ্গীকার করি। পরদিন ওবায়দুলের মাধ্যমে ৩ লাখ টাকা নগদ এবং ৫ লাখ টাকার একটি চেক আদিলের হাতে তুলে দেই। একইসঙ্গে চেকটি দোকান খুলে দেওয়া এবং মালামাল উদ্ধারের পর পাস করবো বলে অঙ্গীকার করি।
লিখিত বক্তব্যে ব্যবসায়ী খোরশেদ বলেন, ২৫ আগস্ট আদিল ফোন দিয়ে চেকটি পাস করে দিতে তাগাদা দেন। তখন আমি দোকান খুলে দেওয়া এবং লুট করা মালামাল উদ্ধারের কথা বলি। পরে ২৮ আগস্ট মীমাংসা আশ্বাস দেন আরমান। কথা মতো ঠাকুরদীঘি পেট্রোল পাম্পের উত্তর পাশে আসা মাত্র আদিল, আবদুর রহমান, রিদোয়ানুল হক ও আবদুল জলিল আমাকে জোরপূর্বক একটি কালো নোয়াহ গাড়িতে (চট্ট মেট্রো-চ ১২-০২৬১) তুলে ফেলেন। মাইক্রোবাসে ঢুকিয়ে তারা আমার হাত-পা বেঁধে ফেলে। তারপর তারা আমাকে মারধর শুরু করেন।
তিনি বলেন, ‘মারতে মারতে তারা আমাকে নগরের কল্পলোক আবাসিক এলাকার একটি ভবনের চারতলায় নিয়ে যান। সেখানে আরমানের সঙ্গে দেখা হয়। তিনি আমাকে দেখেই জিজ্ঞেস করেন, ৫ লাখ টাকার চেকটি পাস করিসনি কেন? ৫ লাখ টাকার চেক ক্যাশ করিয়ে না দিলে এবং আরও ১০ লাখ টাকা না দিলে ওই ভবন থেকেই বস্তা ভরে তাকে শাহ আমানত সেতুর নিচে ফেলে দেওয়ার হুমকি দেন তারা। বেধড়ক মারধরের পর ১০০ টাকার ৯টি স্ট্যাম্পে জোর করে সই নেন। এরপর চান্দগাঁও থানায় নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি মামলার এজাহারভুক্ত ৩২ নম্বর আসামি করা হয়। কারাগারে থাকাকালীন সময়েই তাকে লোহাগাড়া থানায় ৩টি এবং কোতোয়ালি থানায় আরো একটি মামলার আসামি করা হয়।
তিনি আরও বলেন, ‘৩ মাস ১০ দিনন কারাভোগের পর মামলাগুলো থেকে জামিনে বেরিয়ে আসি। আমাকে আরো মামলার আসামি করবেন বলে আরমান হুমকি দিয়েছেন। মৃত্যুর হুমকিও দিয়েছেন। আমি এখন পর্যন্ত বেঁচে আছি, কিন্তু আমার বিরুদ্ধে আর কয়টি মামলা হয়েছে তা জানি না।’
অভিযুক্ত মো. আরমান উদ্দিন বলেন, আমার বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ মিথ্যা। কিছু লোক আমার নাম ভাঙিয়ে অপকর্ম করছেন। আমি এ বিষয়ে লোহাগাড়া থানায় জিডিও করেছি। আমি চাঁদা দাবি করেছি বা চেক নিয়েছি, এমন কোনো প্রমাণ থাকলে দেখাতে বলেন।
আরমান উদ্দিনের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার বিওসির মোড় এলাকার বাসিন্দা আরমান উদ্দিন। কয়েক বছর আগে থেকে তিনি জামায়াত নেতা শাহজাহান চৌধুরীর পিএ পরিচয় দিতে থাকেন। বর্তমানে চট্টগ্রাম মহানগর ও দক্ষিণ চট্টগ্রামে ব্যাপক প্রভাব রয়েছে আরমানের। শাহজাহান চৌধুরীর সাম্রাজ্যের পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করেন আরমান। সরকারের পতনের পর আরমান জামায়াত নেতা শাহজাহান চৌধুরীর সঙ্গে প্রশাসনের শীর্ষ কর্তাদের বৈঠক করেন।
শাহজাহান চৌধুরীর পক্ষ হয়ে প্রশাসনের কর্তাদের সঙ্গে আরমানই সমন্বয় করেন। এ সম্পর্কের সুবাদে চট্টগ্রামে তার প্রভাব বাড়তে থাকে।
জামায়াতের একাধিক নেতা বলেন, জামায়াত নেতাদের সাধারণত পিএ বলতে কেউ থাকেন না। কিন্তু শাহজাহান চৌধুরী এর ব্যতিক্রম। তিনি ব্যক্তিগতভাবে আরমানকে সঙ্গে রাখেন। দলীয় গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়েও শাহজাহান চৌধুরীর সঙ্গে আরমান উপস্থিত থাকেন। এতে করে বিব্রত হন বেশিরভাগ নেতারা।
সাতকানিয়া জামায়াতের এক নেতা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আরমান সিনিয়র নেতার পরিচয় দিয়ে বিপুল পরিমাণ টাকা মালিক হয়েছেন। অবস্থা এমন- আরমান সাতকানিয়া-লোহাগাড়ায় এলে তাকে এমপির মতো করে প্রোটোকল দেয় জামায়াত পরিচয় দেওয়া কিছু লোক। তার প্রভাবে মূল জামায়াতের নেতাকর্মীরা বিব্রত। আমরা একাধিকবার বিষয়টি শাহজাহান ভাইকে জানিয়েছি। কিন্তু প্রথমে একটু করে বকা দিলেও শাহজাহান চৌধুরী ঠিকই তাকে প্রশ্রয় দিয়ে থাকেন। বিষয়টি নিয়ে শিগগিরই কেন্দ্রে অভিযোগ জানানো হবে।
এ বিষয়ে জানতে শাহজাহান চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
এমআর/এমএসএ