চিন্ময়ের জামিন শুনানি : জেলা পিপির নির্দেশনা নিয়ে তোলপাড়!
বাংলাদেশ সনাতন জাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ও সাবেক ইসকন নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর জামিন এগিয়ে আনতে বুধবার (১১ ডিসেম্বর) আবেদন করেন এক আইনজীবী। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট রবীন্দ্র ঘোষ চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ মো. সাইফুল ইসলামের আদালতে এ আবেদন করেন। যদিও যথাযথ প্রক্রিয়ায় আবেদন না করায় আদালত এটি খারিজ করে দিয়েছেন।
এদিকে, রবীন্দ্র ঘোষ যে আবেদন করবেন এটি আগেই নির্দেশনা দিয়েছিলেন চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মো. আশরাফ হোসেন চৌধুরী রাজ্জাক। ‘পাবলিক প্রসিকিউটরস অফিস’ নামে সরকারি আইনজীবীদের একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে এ নির্দেশনা দেন তিনি।
বুধবার সকাল ৭টা ৫৬ মিনিটে পিপি মো. আশরাফ হোসেন ওই গ্রুপের সদস্যদের উদ্দেশ্যে লেখেন, ‘আসসালামুয়ালাইকুম! প্রিয় ভাই ও বোনেরা আজকে ইসকনের মামলায় ঢাকার একজন আইনজীবী মুভ করতে পারেন! প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে যাতে কোনো ধরনের বিঘ্ন সৃষ্টি করতে না পারে সেজন্য ওপর থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে! ব্যাপারটা সরকার ফলোআপে আছে!!!’
জেলা পিপির এই নির্দেশনায় কয়েকজন সম্মতি প্রকাশ করলেও হোসাইন মোহাম্মদ নামে এক আইনজীবী লেখেন, ‘এটা কেমন কথা হলো, সম্মানিত পিপি মহোদয়! তাহলে আমরা কি শহীদ আলিফের রক্তের সঙ্গে বেঈমানি করতে পারি?’
এর জবাবে জেলা পিপি আশরাফ হোসেন পুনরায় লেখেন, ‘সরকারের তরফ থেকে নির্দেশনা!!’
এদিকে, জেলা পিপির এই খুদে বার্তা পৌঁছেছে চট্টগ্রাম জেলার বেশিরভাগ আইনজীবীর হাতেই। হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে পিপির দেওয়া স্ক্রিনশট ঘুরছে আইনজীবীদের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মেও। যেখানে আইনজীবীরা বলাবলি করছেন, আদৌও সরকার থেকে এরকম কোনো নির্দেশনা আসছে কি না তারা নিশ্চিত নন। চট্টগ্রাম আদালত এলাকায় খুন হওয়া অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলাম আলিফ এই বারের একজন সদস্য। যিনি চিন্ময়ের মুক্তির দাবিতে আন্দোলনকারীদের হাতে নির্মমভাবে খুন হয়েছিলেন। তার রক্তের দাগ এখনো ভালোভাবে শুকায়নি। ঘটনার পরপরই বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন চট্টগ্রামসহ সারাদেশের আইনজীবীরা। এ ঘটনার জন্য আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে ইসকন নেতা চিন্ময়কে দায়ী করা হচ্ছিল। সেই চিন্ময়ের জামিন এগোতে ঢাকা থেকে আইনজীবী আসছেন। এটি নিয়ে জেলা পিপির এমন মেসেজ অপ্রত্যাশিত ছিল।
আরও পড়ুন
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর (এপিপি) ঢাকা পোস্টকে বলেন, দুনিয়ায় আসলে কেউ কারও না। আইনজীবী আলিফ হত্যার পর থেকে জেলা পিপির ভূমিকা কিছুটা প্রশ্নবিদ্ধ। তিনি এখনো আলিফের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। ঘটনার পর থেকে অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে বেশিরভাগ মামলার শুনানির সময় আসেন না। আজ (বুধবার) তিনি আদালতে আসেননি। যতটুকু খবর পেয়েছি তিনি ঢাকায় রয়েছেন।
হোয়াটসঅ্যাপে খুদে বার্তা দেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে জেলা পিপি মো. আশরাফ হোসেন চৌধুরী রাজ্জাক ঢাকা পোস্টকে বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশনা মোতাবেক মেসেজটি দিয়েছি। এর মানে হলো- শুনানি শেষে আদালত যা নির্দেশনা দেন, এটি নিয়ে কেউ যাতে হট্টগোল কিংবা বিশৃঙ্খলা না করেন; এতটুকুই। আমরা কাউকে শুনানিতে অংশ নিতে বারণ করিনি।
জানা গেছে, গত ৩ ডিসেম্বর চিন্ময় দাসের জামিন আবেদন শুনানির দিন ধার্য ছিল। কিন্তু ওইদিন চিন্ময়ের পক্ষে কোনো আইনজীবী আদালতে উপস্থিত ছিলেন না। পাশাপাশি রাষ্ট্রপক্ষও শুনানির জন্য সময়ের আবেদন করেন। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত জামিন শুনানির জন্য ২০২৫ সালের ২ জানুয়ারি ধার্য করেন। কিন্তু এর মধ্যে আজ (বুধবার) আসামিপক্ষে ঢাকা থেকে আইনজীবী রবীন্দ্র ঘোষ এসে জামিন শুনানির তারিখ এগিয়ে আনার জন্য আবেদন করেন।
এতে তিনি উল্লেখ করেন, অভিযুক্ত চিন্ময় দাস একজন সন্ন্যাসী। তিনি সনাতনীদের পবিত্র তীর্ঘপীঠ শ্রী শ্রী পুণ্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ এবং বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের একজন প্রধান মুখপাত্র। মামলায় চিন্ময়ের বিরুদ্ধে বাদীর অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট এবং বিভ্রান্তিকর। এছাড়া চিন্ময় দাস দীর্ঘমেয়াদি পাকস্থলী, কার্ডিওভাসকুলার, ডায়াবেটিস ও শ্বাসকষ্ট রোগে আক্রান্ত। তার পক্ষে নিয়োজিত আইনজীবীকে বিভিন্ন মাধ্যমে অত্র মামলা পরিচালনা তথা শুনানি না করার জন্য হুমকি প্রদান করা হয়েছে। তাই শুনানিতে তিনি আদালতে উপস্থিত হতে পারেনি। এটি সম্পূর্ণ ন্যায় বিচার বহির্ভূত। যেহেতু চিন্ময়ের পক্ষের আইনজীবী নিরাপত্তাজনিত কারণে অত্র মামলার জামিন শুনানির ধার্য তারিখে আদালতে উপস্থিত হতে পারেননি, সেহেতু ন্যায় বিচারের স্বার্থে এই ফৌজদারি মিছ মামলার ধার্য তারিখ অগ্রবর্তী পূর্বক শুনানি করা একান্ত আবশ্যক। না হয় অভিযুক্ত ব্যক্তি ন্যায়বিচার হতে সম্পূর্ণ বঞ্চিত হবেন।
আদালত সূত্রে জানা যায়, আবেদনে আসামিপক্ষের ওকালতনামা ছিল না এবং ফাইলিং আইনজীবীরও লিখিত অনুমতি ছিল না। তাই মহানগর দায়রা জজ আদালত আবেদনটি নট মেনটেইনেবল বলে খারিজ করে দেন।
জানা গেছে, গত ২৫ নভেম্বর বিকেলে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যাওয়ার সময় শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে বাংলাদেশ পুলিশের বিশেষায়িত গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সদস্যরা চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেপ্তার করে। পরদিন কোতোয়ালি থানায় দায়ের হওয়া রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে তাকে মহানগর ষষ্ঠ কাজী শরীফুল ইসলামের আদালতে হাজির করা হয়। আদালত জামিন না মঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এটি নিয়ে বিক্ষোভ করেন ইসকন অনুসারীরা। এসময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় বিক্ষোভকারীরা। দুপুর পর বিক্ষোভকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে আদালত এলাকায় মসজিদ-দোকানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে হামলা চালায়। এসময় বেশ কয়েকটি মোটরসাইকেলও ভাঙচুর করা হয়।
একপর্যায়ে বিকেলে আদালতের প্রধান ফটকের বিপরীতে রঙ্গম কনভেনশন হলের গলিতে একদল ইসকন অনুসারীর হাতে খুন হন অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলাম। এ ঘটনায় ২৯ নভেম্বর দিবাগত রাতে নগরের কোতোয়ালি থানায় ৩১ জনের নাম উল্লেখ করে একটি হত্যা মামলা করা হয়েছে। ভুক্তভোগীর বাবা জামাল উদ্দিন বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। একই ঘটনায় কোতোয়ালি থানায় আরও কয়েকটি মামলা দায়ের হয়।
এমআর/এসএম