ভোগান্তি পেরিয়ে স্বস্তির দেখা
ছোট্ট মেয়ে রূপকথা। বয়স মাত্র পাঁচ। রূপকথার সমবয়সীরা স্কুলে যায়। তাদের দেখে রূপকথাও স্কুলে যেতে চায়। তার মা তাসনিয়া বেগম ঘরেই মেয়েকে অক্ষরজ্ঞান দিয়েছেন। এখন স্কুলে ভর্তি করাতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কিন্তু এজন্য চাই জন্ম নিবন্ধন সনদ। রাজধানীর পান্থপথ এলাকার বাসিন্দা তাসনিয়া মেয়ের জন্ম নিবন্ধন করতে যান সিটি করপোরেশনে। জমা দেন তার এবং স্বামীর জন্ম নিবন্ধন। কিন্তু তাকে জানানো হয়, তাদের জন্ম নিবন্ধন দিয়ে কাজ হবে না। মেয়ের জন্ম নিবন্ধন করার আগে বাবা-মায়ের জন্ম নিবন্ধন করাতে হবে।
তাসনিয়া ভেবেছিলেন, তিনি ও তার স্বামীর জন্ম নিবন্ধন করা সহজ হবে। কিন্তু বিষয়টি বেশ জটিল হয়ে ওঠে তার জন্য। ঢাকায় তাসনিয়ার বাবার নামে ফ্ল্যাট আছে, সে কারণে তিনি শেষ পর্যন্ত ঢাকার ঠিকানায় জন্ম নিবন্ধন করতে পেরেছেন। কিন্তু তার স্বামীর জন্ম নিবন্ধন করতে হয় গ্রামের ঠিকানায়।
তাসনিয়াকে মেয়ে রূপকথার জন্ম নিবন্ধনেও গ্রামের ঠিকানা দিতে বলা হয়েছিল। তিনি রাজি হননি। এরপর পরিচিত একজনের সহায়তায় কাজটা করেছেন। কিন্তু ততদিনে এক জন্ম নিবন্ধনের পেছনে ঘুরতে ঘুরতে চলে গেছে দুই মাস। তার মতে, জন্ম নিবন্ধনের প্রক্রিয়া আরও সহজ করা উচিত। কিন্তু কীভাবে?
রূপকথার স্কুল ছুটির আগে অন্য অভিভাবকদের সঙ্গে আলোচনায় উঠে আসে বিষয়টি। এ সময় এক অভিভাবক বলেন, তারা এসব ভোগান্তির কথা জানাতে পারেন amiojittechai.com ওয়েবসাইটে। সেখানে অনেকেই তাদের সমস্যা নিয়ে কথা বলে। তাসনিয়া কিছুটা দ্বিধা নিয়ে বলেন, তার মতো সাধারণ গৃহিণীর কথা কে শুনবে? অন্য অভিভাবকরা তাকে সাহস দেন। তাসনিয়া ওয়েবসাইটটি ভিজিট করেন। সেখানে চোখে পড়ে অসংখ্য মানুষের ভোগান্তির কথা। নিরাপত্তাহীনতা, ভোটাধিকার, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির মতো বিষয়গুলো নিয়ে লিখছেন অনেকেই। এতদিন তারা নিজেদের ভোগান্তির কথা বলার প্ল্যাটফর্ম পাননি।
তাসনিয়ার মতোই একজন সাধারণ গৃহিণী আকলিমা খাতুন। স্বামীর মৃত্যুর পর পেনশনের জন্য মৃত্যুসনদ আনতে গিয়েছিলেন। তখন সিটি করপোরেশন থেকে জানানো হয়, তার দেওয়া জন্ম নিবন্ধন চলবে না। নতুন করে বানাতে হবে। বাধ্য হয়ে মৃত স্বামীর জন্ম নিবন্ধন করেছিলেন তিনি।
শুধু তাসনিয়া বা আকলিমা নন, জন্ম নিবন্ধন নিয়ে ভোগান্তির শিকার হননি, এমন মানুষ খুব কমই পাওয়া যাবে। এসব ভোগান্তির কিছুটা ওয়েবসাইটে চোখে পড়ে তাসনিয়ার। বাংলাদেশে প্রায় ১৮ ধরনের নাগরিক সেবার জন্য জন্ম নিবন্ধন সনদ প্রয়োজন। এর মধ্যে রয়েছে পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার বিষয়টিও।
তাসনিয়া বুঝতে পারেন তার মতো ভোগান্তির শিকার হওয়া মানুষের সংখ্যা কম নয়। সরকার নির্ধারিত ফি থাকলেও অনেকক্ষেত্রে অসচেতনতার সুযোগ নিয়ে নাগরিকদের কাছ থেকে ইচ্ছেমতো টাকা নেওয়া হচ্ছে বা দিতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকে। আবার ডিজিটাল জন্ম নিবন্ধন সনদের আবেদন প্রক্রিয়ায় রয়েছে আরেক ঝামেলা। এই প্রক্রিয়ায় বাবা-মায়ের ক্ষেত্রে শুধু ১৭ ডিজিটের জন্ম নিবন্ধন গ্রহণযোগ্য হয়। কিন্তু কারো কারো সনদে রয়েছে ১৬ ডিজিট। ফলে ওই সনদ ব্যবহার করে মেয়ের জন্ম নিবন্ধনের অনলাইন আবেদন করতে পারেননি অনেকে।
তাসনিয়া জানতে পারেন, ইউএসএইডের স্ট্রেনদেনিং পলিটিক্যাল ল্যান্ডস্কেপ (এসপিএল) প্রকল্পের অধীনে পরিচালিত amiojittechai.com ওয়েবসাইটে মানুষের আশা আর কষ্টের কথা শুনে তাদের জীবনযাত্রার উন্নতিতে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। সত্যি বলতে ওয়েবসাইটটি কেবল অভিযোগ জানানোর প্ল্যাটফর্ম নয়। এটি এমন একটি প্ল্যাটফর্ম যেখানে প্রতিটি পোস্টেই দেশের বাস্তব চিত্র ফুটে ওঠে।
ওয়েবসাইটটিতে রেজিস্ট্রেশন করার প্রক্রিয়াও সহজ। তাসনিয়াও নিজের কষ্টগুলো লিখে পোস্ট করেন। তিনি জানান, অন্য শিশুদের মতো তার মেয়ে রূপকথারও স্কুল ড্রেস পরে ক্লাসে যাওয়ার বায়নার কথা। কিন্তু জন্ম নিবন্ধনের ভোগান্তির কারণে মেয়েকে স্কুলে দেওয়ার আনন্দ পাননি তিনি।
তাসনিয়া আরও যোগ করেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় অনেক সময় পরীক্ষার ফল বা পড়ালেখা নিয়ে চাপ সৃষ্টি করা হয়, এতে সন্তানদের মূল্যবোধ তৈরির বিষয়টি কম গুরুত্ব পায়। প্রতিটি পোস্টে ছবি ও ভিডিও যুক্ত করার সুবিধা থাকায় তাসনিয়া অভিভাবকদের ওয়েটিং রুম নিয়ে একটি ভিডিও ধারণ করেন। এতে তাদের সংকট আরও দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। অন্য ব্যবহারকারীরা তার এসব পোস্টে মন্তব্য করেন এবং বিষয়টি সমাধানের পরামর্শও দেয়।
‘আমিও জিততে চাই’ বাংলাদেশের সামাজিক পরিবর্তনের পথে একটি বড় পদক্ষেপ। এই প্ল্যাটফর্মের লক্ষ্য দেশের প্রান্তিক জনগণের কথা শোনা এবং প্রশাসনের নজরে আনা। এই ওয়েবসাইটের প্রতিটি পোস্টে উল্লেখ করা সমস্যাগুলো পৌঁছে যাবে নীতিনির্ধারকদের কাছে।
তাসনিয়া এখন নিজেকে একা মনে করেন না। ‘আমিও জিততে চাই’ ওয়েবসাইটটি তার মতো অনেকের ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে, যেহেতু তাদের প্রতিটি মতামত সামাজিক পরিবর্তনের দাবিতে রূপ নিচ্ছে। তাসনিয়া এখন আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন। তিনি আত্মবিশ্বাসী একদিন তাদের সমস্যাগুলোর সমাধান হবে। প্রশাসনে পরিবর্তন আসবে। তার মতো মানুষদের জীবনযাত্রা সহজ তো হবেই, একটি সুন্দর এবং পরিচ্ছন্ন সমাজও গড়ে উঠবে।
জেডএস