বিদেশি মিশনে দূত নিয়োগে উদাহরণ গড়তে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার
নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের ১০০ দিন পূর্ণ করেছে। এই সময়ে সরকার বিভিন্ন দূতাবাসে রাষ্ট্রদূত/হাইকমিশনার নিয়োগ ও রদবদল প্রক্রিয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। যার অংশ হিসেবে শূন্য পদে নিয়োগ ও রদবদল মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ২১ রাষ্ট্রদূতের নিয়োগ চূড়ান্ত হতে চলেছে।
এদিকে এখন পর্যন্ত দুটি মিশনে নিয়োগ ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ স্থায়ী প্রতিনিধি এবং ওআইসিতে (ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা) স্থায়ী প্রতিনিধি প্রেরণ। আশা করা হচ্ছে, চলতি বছরের মধ্যে অন্যান্য মিশনে দূত নিয়োগের ঘোষণা করা হবে।
কূটনৈতিক অঙ্গন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে এত কম সময়ে এত বেশি মিশনে রাষ্ট্রদূত নিয়োগ বা রদবদলের ঘটনা এটাই প্রথম। এর আগে একসঙ্গে এত মিশনে দূত নিয়োগ বা রদবদলের ঘটনা ঘটেনি। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এটা কূটনৈতিক অঙ্গনে বড় পরিবর্তন।
আরও পড়ুন
সরকার বদলের পর প্রশাসনে রদবদলের অংশ হিসেবে গত ১৪ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, জাপান, জার্মানি, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতদের চুক্তি বাতিল করেছে সরকার। এছাড়া মালদ্বীপে প্রেষণে নিযুক্ত হাইকমিশনারকে দেশে ফিরতে বলা হয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, জাপান, জার্মানি, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মালদ্বীপের রাষ্ট্রদূত/হাইকমিশনার এরই মধ্যে তাদের নিজ নিজ স্টেশন ছেড়ে গেছেন।
পরে ২৯ সেপ্টেম্বর এক দাপ্তরিক আদেশে যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনিমকে অবিলম্বে ঢাকায় ফিরে আসতে নির্দেশনা দেওয়া হয়।
লন্ডনের পর গত ১ অক্টোবর ভারত, নিউইয়র্কে স্থায়ী মিশন, বেলজিয়াম, অস্ট্রেলিয়া ও পর্তুগালে দায়িত্ব পালনরত পাঁচ রাষ্ট্রদূত/হাইকমিশনারকে বর্তমান দায়িত্ব ছেড়ে ‘অনতিবিলম্বে’ ঢাকায় ফেরার নির্দেশনা দিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পেশাদার ওই পাঁচ কূটনীতিকের আগামী ডিসেম্বরে অবসরোত্তর ছুটিতে যাওয়ার কথা রয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর নিয়োগ বাতিল হওয়া যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, জাপান, জার্মানি, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের চুক্তিভিত্তিক রাষ্ট্রদূতরা এবং ভারত, যুক্তরাজ্য, নিউইয়র্কে জাতিসংঘে স্থায়ী মিশন, বেলজিয়াম, অস্ট্রেলিয়া ও পর্তুগালে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতেরা ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে অবসরোত্তর ছুটিতে যাবেন। এছাড়া, চীনে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত মো. জসীম উদ্দিনকে পররাষ্ট্রসচিব নিয়োগ করার ফলে সেপ্টেম্বরে সাত মিশনের রাষ্ট্রদূতের পদ শূন্য হয়ে পড়ে।
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র-চীনসহ ২১ মিশনে নতুন রাষ্ট্রদূত করছে সরকার। আর প্রথমবার রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পাচ্ছেন ৯ কূটনীতিক। এরইমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, যুক্তরাজ্য, সৌদি আরবসহ আটটি দেশে বাংলাদেশের নতুন রাষ্ট্রদূতের নামের প্রস্তাব সংশ্লিষ্ট দেশের সম্মতির জন্য দেশগুলোতে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া, গত মাসে বেলজিয়াম, অস্ট্রিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুরসহ আরও ১২ দেশে নতুন রাষ্ট্রদূত নিয়োগের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়েছে।
তবে দিল্লির হাইকমিশনে কাকে পাঠানো হবে, সেটি এখনো চূড়ান্ত করা হয়নি। এছাড়া, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, পোল্যান্ড, মালদ্বীপ ও আলজেরিয়ায় মিশনের রাষ্ট্রদূত পদগুলো এই মুহূর্তে খালি রয়েছে। আশা করা হচ্ছে, এসব মিশনেও চলতি বছরের মধ্যে দূত নিয়োগের প্রক্রিয়া শেষ করবে সরকার।
কূটনৈতিক সূত্র বলছে, ভিয়েনায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আসাদ আলমকে যুক্তরাষ্ট্রে, ওমানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো. নাজমুল ইসলামকে চীনে, মেক্সিকোয় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আবিদা ইসলামকে ব্রিটেনে, রোমানিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো. দাউদ আলীকে জাপানে, দক্ষিণ কোরিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম দেলোয়ার হোসেনকে সৌদি আরবে, আলজেরিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত জুলকার নাইনকে জার্মানিতে, ফরেন সার্ভিস একাডেমির মহাপরিচালক শাহনাজ গাজীকে রোমানিয়ায় এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মহাপরিচালক তারেক আহমদকে সংযুক্ত আরব আমিরাতে বাংলাদেশের পরবর্তী রাষ্ট্রদূত হিসেবে পাঠানোর জন্য হোস্ট কান্ট্রির সম্মতি চাওয়া হয়েছে।
বর্তমানে রাষ্ট্রাচার প্রধান খন্দকার মাসুদ আলমকে বেলজিয়াম ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক (জাতিসংঘ অনুবিভাগ) তৌফিক হাসানকে অস্ট্রিয়ায়, আঞ্চলিক সংস্থা অনুবিভাগের মহাপরিচালক রইস হাসান সরওয়ারকে বাহরাইনে, সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশের হাইকমিশনার মো. তৌহিদুল ইসলামকে ব্রাজিলে, নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল নাজমুল হুদাকে ইরাকে, সাংবাদিক মুশফিক ফজল আনসারীকে মেক্সিকোয়, ব্রাজিলের রাষ্ট্রদূত সাদিয়া ফয়জুন্নেসাকে নেপালে, বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ও ঢাকা নৌঅঞ্চলের কমান্ডার রিয়ার অ্যাডমিরাল খন্দকার মিসবাহ-উল-আজিমকে ওমানে, নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশের উপস্থায়ী প্রতিনিধি তৌফিক ইসলাম শাতিলকে দক্ষিণ কোরিয়া, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক (মিয়ানমার অনুবিভাগ) ফেরদৌসী শাহরিয়ারকে সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশের পরবর্তী রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়েছে।
এছাড়া, নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে বাংলাদেশের পরবর্তী স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে নেপালে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সালাহউদ্দীন নোমান চৌধুরীকে এবং ওআইসিতে নব প্রতিষ্ঠিত (আগে সৌদি আরবে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত ওআইসিতে স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন) স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে মিলানে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল এমজেএইচ জাবেদকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
রাষ্ট্রদূত/হাইকমিশনার নিয়োগের বাইরে অন্তর্বর্তী সরকার সম্প্রতি উপ-রাষ্ট্রদূত পর্যায়ে কিছু নিয়োগ সম্পন্ন করেছে।
প্রধান উপদেষ্টার দুই সফর
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র দিয়ে প্রথম বিদেশ সফর শুরু করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস। নিউইয়র্কে জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ দেন তিনি। দ্বিতীয় সফরে আজারবাইজানে কপ২৯ সম্মেলনে যোগ দেন তিনি। দুটি সফরই বহুপাক্ষিক।
সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে গিয়ে বাজিমাত করেছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন (২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে ক্ষমতা ছাড়বেন) ড. ইউনূসকে কাছে পেয়ে বুকে টেনে নেন। হাতে হাত রেখে বলেন, বাংলাদেশের সংস্কারের যে লক্ষ্য নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ঠিক করেছেন, তাকে বাস্তবে রূপ দিতে সব ধরনের সহযোগিতা করবে হোয়াইট হাউস।
তবে বর্তমান প্রেক্ষাপট ভিন্ন। হোয়াইট হাউসের ক্ষমতার রদবদল হয়েছে। ডেমোক্রেটদের কাছ থেকে ক্ষমতা চলে গেছে রিপাবলিকানদের হাতে। গত ৫ নভেম্বরের নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। মসনদে আসীন হওয়ার পর চার বছর হোয়াইট হাউসের দেখভাল করবেন ট্রাম্প।
ট্রাম্পের বিজয়ের পর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন হবে, সেটি এখন বড় প্রশ্ন। সংশ্লিষ্ট বোদ্ধামহল মনে করছে, ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সিতে ঢাকা-ওয়াশিংটনের সম্পর্কের কিছুক্ষেত্রে পরিবর্তন আসার পাশাপাশি কাজ করার ধরনে পরিবর্তন আসতে পারে। তবে বাংলাদেশ ইস্যুতে মোটাদাগে আমূল পরিবর্তন আনবে না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে ডেমোক্রেটদের সখ্য পুরোনো। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়া ড. ইউনূস যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন পেয়েছেন।
দ্বিতীয় বিদেশ সফরে আজারবাইজানে কপ২৯ সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধানদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন ড. ইউনূস। অনেকের সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে তার। সম্মেলনের মূল অধিবেশনে দেওয়া বক্তব্যে তিনি পৃথিবীকে জলবায়ু বিপর্যয় থেকে রক্ষা করার জন্য ‘শূন্য বর্জ্য ও শূন্য কার্বনে’র ওপর ভিত্তি করে একটি নতুন জীবনধারা গড়ে তোলার পরামর্শ দিয়েছেন। এছাড়া, ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় জলবায়ু ফান্ডে কোনো পরিবর্তন আসবে কি না, তা দেখার জন্য আরও কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হবে বলে উল্লেখ করেছেন ড. ইউনূস।
মিয়ানমারকে নিয়ে বেকায়দায় সরকার
মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে ঝামেলায় আছে বাংলাদেশ। আশ্রিত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন করতে না পারার পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে মিয়ানমার সীমান্তে চলমান অস্থিরতা এবং নতুন রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে বাংলাদেশের।
নতুন করে রোহিঙ্গা শরণার্থী আশ্রয়ে নীতিগতভাবে পক্ষে নয় অন্তর্বর্তী সরকার। তবুও ঠেকানো যাচ্ছে না অনুপ্রবেশ। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এখন পর্যন্ত ৬০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গার নতুন করে বাংলাদেশে প্রবেশের তথ্য দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। যদিও সরকারের তরফ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ৪০ হাজার অনুপ্রবেশের তথ্য জানানো হয়েছে।
মিয়ানমারে অভ্যন্তরীণ সংঘাতের জের ধরে বাংলাদেশ সীমান্তের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে সরকার। গত ১০ নভেম্বর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত উ ক্যাও সোয়ে মোয়ে-এর সঙ্গে এক বৈঠকে এ উদ্বেগের কথা তুলে ধরেন পররাষ্ট্র সচিব জসীম উদ্দিন।
বৈঠকের বিষয় তুলে ধরে মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের জেরে সীমান্তে নিরাপত্তা সংক্রান্ত উদ্বেগের বিষয়ে তুলে ধরেছেন পররাষ্ট্র সচিব। বাংলাদেশের দিকে মর্টার শেল চলে আসা এবং বাংলাদেশি নৌকা লক্ষ্য করে গুলির ঘটনার কথা তিনি বৈঠকে তুলেছেন।
এনআই/জেডএস