কারও নেই বেতন-বোনাস, কারও নেই ছুটি
মুসলমানদের সবচেয়ে বড় উৎসব ঈদুল ফিতর, তারপরই ঈদুল আজহা। ঈদুল ফিতর আর ঈদুল আজহা- এ দুই ঈদ ঘিরে উৎসবে মেতে ওঠেন দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ।
এ জন্য এ দুই ঈদে কর্মস্থল থেকে নিয়মিত বেতনের পাশপাশি প্রত্যেকে পেয়ে থাকেন বোনাস। চাঁদ দেখা সাপেক্ষে বৃহস্পতিবার বা শুক্রবার উদযাপিত হবে ঈদুল ফিতর। কিন্তু এখনো বেতন-বোনাস পাননি তৈরি পোশাক কারখানার বহু শ্রমিক।
এর সঙ্গে করোনা পরিস্থিতির কারণে তাদের ছুটি নিয়েও তৈরি হয়েছে জটিলতা। ঈদ ঘিরে করোনা ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে এবার সরকার বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ঈদের ছুটি তিন দিনের বেশি দেওয়া যাবে না। আর এ ছুটিতে কর্মস্থলও ত্যাগ করা যাবে না।
ফলে বছরে মাত্র ১১ দিন ছুটি পাওয়া পোশাকশ্রমিকরা ঈদে বাড়তি কোনো ছুটি নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন না। আর তাই বেতন-বোনাস এবং ঈদের ছুটি বাড়ানোর দাবিতে রাস্তায়ও নেমেছেন শ্রমিকরা। মিরপুর, কচুক্ষেত ও গাজীপুরের টঙ্গী এলাকায় রাস্তা অবরোধ করে শ্রমিকরা বিক্ষোভ করেছেন। বিক্ষোভে পুলিশ গুলি চালিয়েছে, গুলিতে শ্রমিকের শরীর ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে। এরপর মালিকরা ছুটি বাড়িয়েছেন।
হা-মীম কারখানার শ্রমিক এহতেশামুল করিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বছরে আমাদের ১১ দিনের ছুটি আছে, যা দেওয়া হয় মূলত দুই ঈদে। ঈদের ছুটির আশায় সারা বছর কাজ করি। কিন্তু এবার কোম্পানি ঘোষণা করেছে তিনদিনের বেশি ছুটি নেই। আবার ছুটিতে বাড়িতে যাওয়া যাবে না।
তিনি বলেন, আমাদের কি বউ, বাচ্চা, বাবা-মা নেই? তাদের কি ঈদ আনন্দ নেই? তাদের আমরা কী বোঝাবো, তাই আমরা আন্দোলনে নেমেছি। এখন ছুটি দিয়েছে, গ্রামের বাড়ি কুড়িগ্রামে যাচ্ছি। চাকরি থাকলে থাকবে, না থাকলে নেই।
একই কথা বলছেন আশুলিয়ার রেডিয়েন্ট গার্মেন্টের শ্রমিক সুফিয়া আক্তার মুনা। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনার কথা বলে আমাদের ছুটি দিচ্ছে না। আমাদের ঘরে বন্দি থাকতে বলে। আমাদের ছুটির আগেই তো দেখলাম ফেরিতে লাখ লাখ মানুষ ধাক্কাধাক্কি করে পার হচ্ছে। তাদের বেলায় করোনা নেই। আমাদের কি স্বজনদের সঙ্গে ঈদ উপভোগ করার অধিকার নেই?
কমলাপুরের তিন্নি গার্মেন্টসের শ্রমিক আরিফুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, টাকার জন্য বাবা-মাকে ছেড়ে রাতদিন পরিশ্রম করছি। একদিন পর ঈদ, এখনো বেতন-বোনাস কিছু দিচ্ছে না। ঈদ তো আর বার বার আসে না। বৃদ্ধ মা-বাবাকে ঈদের জামা-কাপড় না দিতে পারলে চাকরি করে কী লাভ। সরকার কি আমাদের কষ্ট দেখে না?
বিল্পবী গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি সালাহউদ্দিন স্বপন এ বিষয়ে ঢাকা পোস্টকে বলেন, সরকার, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ আর মালিকরা বলেন, গার্মেন্টস শ্রমিকদের করোনা হয় না। কারণ, তারা কঠোর পরিশ্রম করেন। তাহলে এখন আবার করোনার দোহাই দিয়ে কেন ছুটি দেওয়া হচ্ছে না? এটা তো শ্রমিকদের পাওনা ছুটি। বছরের ১১ দিন শ্রমিকরা ছুটি পায়, সেই ছুটি কেন কেড়ে নেবেন?
গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার বলেন, শ্রমিকরা বছরে দুবার স্বজনদের সঙ্গে মিলিত হয়। দেশের সব মানুষ ঢাকা ছেড়ে দলে দলে গ্রামে যাচ্ছে, তাতে সমস্যা নেই। শুধু গার্মেন্ট শ্রমিকদের কর্মস্থলে থাকতে বাধ্য করা হচ্ছে, এটা ঠিক নয়। ঈদে শ্রমিকদের পাওনা ছুটি আরও বাড়ানোর দাবি করছি।
ইউনিয়ন গার্মেন্টস শ্রমিকদের সভাপতি নুরুল ইসলাম বলেন, ঢাকায় দুই কোটি লোক রয়েছে। এর মধ্যে এক কোটি ২৫ লাখ শ্রমিক অন্যান্য সেক্টরে কাজ করছে। তারা ঈদ আনন্দ করতে গ্রামে যাচ্ছে। তাদের বেলায় করোনা হচ্ছে না। করোনা কেবল গার্মেন্টস শ্রমিকদের জন্য। এটা খুবই হাস্যকর। আমাদের দাবি, শ্রমিকদের ছুটি আরও বাড়ানো হোক। যাতে শ্রমিকরা স্বজনদের সঙ্গে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করতে পারে।
এদিকে তৈরি পোশাক মালিকদের প্রধান সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান গত শনিবার এক ভিডিও বার্তায় কারখানার শ্রমিকদের তিন দিনের বেশি ছুটি না দেওয়ার অনুরোধ জানান।
তিনি বলেন, আমি আমাদের পোশাক শিল্পের বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে বলছি, তারা যেন শ্রমিকদের তিন দিনের বেশি ছুটি না দেন। আমাদের স্বার্থে, শ্রমিকদের স্বার্থে করোনার সংক্রমণ যাতে না বাড়ে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
বিজিএমইএ সভাপতি আরও বলেন, দেখতে হবে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে করোনা সংক্রমণ ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় নিজেকে সুস্থ রাখতে হবে এবং সরকারের নির্দেশনাবলী কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে।
শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ানের সভাপতিত্বে গত ৯ মে রাজধানীর শ্রম ভবনে আয়োজিত ‘আরএমজি বিষয়ক ত্রিপক্ষীয় পরামর্শ পরিষদ (টিসিসি)’-এর সভা অনুষ্ঠিত হয়। শ্রমিক নেতাদের ছুটি বাড়ানোর দাবি পরিপ্রেক্ষিতে ওই অনুষ্ঠানে বিজিএমইএ-এর সিনিয়র সহ-সভাপতি আব্দুল মান্নান কচি বলেন, ছুটি দিতে আমাদের আপত্তি নেই। তবে দেশ ও জনগণের কথা চিন্তা করেই আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হয়। একই কথা বলেন বিকেএমইএ-এর সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেমও।
সভা শেষে প্রতিমন্ত্রী বলেন, সরকারি ছুটি তিনদিনই থাকবে। তবে মালিকরা যদি শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে ছুটি বাড়ায় তাহলে বাড়াতে পারেন। এটা মালিক-শ্রমিকদের মধ্যে আলোচনা সাপেক্ষে হতে পারে। তবে ছুটি যত দিনই হোক করোনার প্রকোপ রোধে শ্রমিকদের সবাইকে কর্মস্থল এলাকায় থাকতে হবে।
এমআই/এনএফ/জেএস