বিদেশ মিশনে পদায়ন নিয়ে স্বরাষ্ট্রের দুই বিভাগে বৈষম্য
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগে বিদেশের বাংলাদেশ দূতাবাসে পদায়ন নিয়ে কয়েক বছর ধরে চলছে বৈষম্য। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও মন্ত্রণালয় এমনকি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উদ্যোগেও দূর হয়নি এই বৈষম্য। বিষয়টি গড়ায় আদালতেও। সেখান থেকে রায় এলেও বৈষম্য দূর হয়নি। তাই বৈষম্য নিয়ে অভিযোগ জানিয়ে সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে স্মারকলিপি দিয়েছেন পদায়ন বঞ্চিত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৩ সালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বিদেশের বাংলাদেশ দূতাবাসে অস্থায়ী মিশনে পদায়ন কার্যক্রম শুরু হয়। তখন বিশ্বের ৮০টির বেশি দেশে বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোতে ভিসা ও পাসপোর্ট সংক্রান্ত নানা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জন্যও ১৯টি মিশনে ৭৩টি পদ সৃষ্টি করা হয়। আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত এবং মন্ত্রিপরিষদ ও অর্থ বিভাগের সম্মতিতে ২০১৬ সাল থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসে এ পদায়ন শুরু হয়। তবে শুরুর দিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মিশনে পদায়নের সুযোগ পেলেও ২০১৭ সালের ১৯ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে জননিরাপত্তা ও সুরক্ষা সেবা নামে দুটি বিভাগ গঠন করলে বিদেশের এসব মিশনে পদায়ন নিয়ে শুরু হয় বৈষম্য।
বিদেশের এসব মিশনে এককভাবে পদায়ন দেওয়া হয় সুরক্ষা সেবা বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। ভিসা, পাসপোর্ট ইস্যুতে পুলিশ ভেরিফিকেশনে গোয়েন্দা প্রতিবেদন ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত কাজের সিংহভাগ জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে সম্পন্ন হলেও বিদেশের মিশনে জননিরাপত্তা বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদায়ন বঞ্চিত করা হয়। ফলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এ নিয়ে বিভেদ ও বৈষম্য বাড়তে থাকে। তৈরি হয় একই মন্ত্রণালয়ে দুই নিয়ম।
আরও পড়ুন
কী বলছেন জননিরাপত্তা বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের প্রশাসনিক কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম বলেন, দুই বিভাগ থেকে সমানভাবে পদায়ন করতে হবে। জননিরাপত্তা বিভাগের কর্মকর্তা- কর্মচারীদেরও মিশনে পদায়নের সুযোগ দেওয়া হোক। এতদিন ধরে বৈষম্য চলে আসছিল। নতুন বাংলাদেশে আর তা চলতে পারে না। এর আগে আমাদের বারবার আমাদের বঞ্চিত করা হয়েছে। একই মন্ত্রণালয়ের এই দুই নীতি বন্ধ করা হোক।
জননিরাপত্তা বিভাগের আরেক প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘদিন ধরে একটি সহজ বিষয়ে বৈষম্য চলে আসছে। আমরা আসলে এর শান্তিপূর্ণ একটি সুরাহা চাই। আমরা চাই আলোচনা হোক। যোগ্য যারা রয়েছে তারা সুযোগ পাক। মন্ত্রণায়ের দুই বিভাগ থেকেই সমতার ভিত্তিতে মিশনে পাঠানো হোক। একটি বিভাগ থেকে সবাই যাবে, আরেকটি বিভাগ থেকে কেউ যাবে না, এটা হতে পারে না। অতি দ্রুত এ বিষয়ে কার্যকরী ও টেকসই পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।
মোহাম্মদ ইয়াসিন ফেরদৌস নামের আরেক প্রশাসনিক কর্মকর্তা বলেন, আমরা বারবার আমাদের দাবির কথা বলে আসছি। এটা তো আমাদের অধিকারও। মন্ত্রণালয়ের সবাই সমান সুযোগ পাবে। একটি পাসপোর্টের ভেরিফিকেশনের সিংহভাগ কাজ আমাদের বিশেষ শাখা থেকে হয়। ইমিগ্রেশনের সিকিউরিটিও আমাদের অথচ মিশনে আমাদের সুযোগ নেই। এ বৈষম্য শেষ হওয়ার সময় চলে এসেছে।
সমহারে পদায়নের নির্দেশনা দিয়ে পরিপত্র, তবুও সমাধানে ‘না’
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুটি বিভাগ গঠনের পর ২০১৭ সালের ৯ জানুয়ারি তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলমের সভাপতিত্বে একটি সভা হয়। ওই সভার কার্যবিবরণীর ৪.৬ ক্রমিকে প্রাথমিকভাবে দুটি বিভাগের মধ্যে কাজের সমন্বয়ের ক্ষেত্রে জননিরাপত্তা বিভাগকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তবে মিশনে পদায়ন নিয়ে দুই বিভাগের বিরোধ সৃষ্টি হলে ২০১৭ সালের ১ মার্চ তৎকালীন জননিরাপত্তা সচিব ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ এক পরিপত্র জারির মাধ্যমে জননিরাপত্তা ও সুরক্ষা সেবা বিভাগ থেকে সমহারে মিশনে পদায়নের সুযোগ সৃষ্টি করেন। কিন্তু সুরক্ষা সেবা বিভাগের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী এ আদেশ অমান্য করে একতরফাভাবে শুরু সুরক্ষা সেবা বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদায়ন করেন। ফলে দুই বিভাগের মধ্যে চলতে থাকা বিরোধ নিষ্পত্তি না হয়ে আরও দীর্ঘ হয়।
হাইকোর্টের আদেশ অমান্য
জারি করা পরিপত্রের নির্দেশনা দুই বছরেও বাস্তবায়ন না হলে ২০১৯ সালে জননিরাপত্তা বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা হাইকোর্ট বিভাগে একটি রিট করেন। রিটের আবেদন পর্যবেক্ষণ করে ২০২৩ সালের ৬ এপ্রিল হাইকোর্ট মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগ থেকে সমহারে পদায়নে রায় দেন। তবে আদালতের এ আদেশ অমান্য করে সুরক্ষা সেবা বিভাগ থেকে বিদেশে জনবল পদায়ন অব্যাহত থাকে। এ পরিপ্রেক্ষিতে জননিরাপত্তা বিভাগের আবেদনের ভিত্তিতে বিদেশে জনবল পদায়ন কার্যক্রম স্থগিত রাখার জন্য পত্র প্রেরণ করে হাইকোর্ট। তবুও আদালতের আদেশ অমান্য করে বিদেশে জনবল প্রেরণ করে সুরক্ষা সেবা বিভাগ।
বিরোধ মীমাংসায় ‘অকার্যকর’ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের উদ্যোগ
বিদেশের মিশনে পদায়ন নিয়ে সুরক্ষা সেবা ও জননিরাপত্তা বিভাগের এ বিরোধ নিরসনে উদ্যোগ নেয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের উপসচিব চৌধুরী মোয়াজ্জম আহমদ স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে দ্বিপাক্ষিক সভায় আলোচনার মাধ্যমে এ বিরোধ নিরসনের অনুরোধ জানালেও সে উদ্যোগ আলোর মুখ দেখেনি।
আরও পড়ুন
কথা রাখেননি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
একই মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগের মধ্যে চলা দীর্ঘদিনের এ বিরোধ নিষ্পত্তি করতে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল উভয় বিভাগের এক সম্মিলিত সভায় প্রতিশ্রুতি দেন, ‘আমি উভয় বিভাগের অভিভাবক হিসেবে জননিরাপত্তা বিভাগ ও সুরক্ষা সেবা বিভাগ থেকে সমহারে বিদেশের বাংলাদেশ মিশনে জনবল প্রেরণ করব।’ এ প্রতিশ্রুতির পরিপ্রেক্ষিতে তখন উভয় বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য সমহারে বিদেশ মিশনের পরিপত্র জারি হয়। কিন্তু জননিরাপত্তা বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অভিযোগ, সাবেক মন্ত্রীও তার কথা রাখেননি।
বৈষম্য নিরসনে স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকেও
মিশনে পদায়ন নিয়ে একই মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য নিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বরাবর একটি স্মারকলিপি জমা দিয়েছেন জননিরাপত্তা বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। স্মারকলিপিতে আগের সব ঘটনার বিবরণ দিয়ে বিদ্যমান সংকট নিরসনে দুই বিভাগ থেকে সমহারে বিদেশে প্রেরণের বিষয়টি নিশ্চিত করতে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
দাবি না মানলে বড় আন্দোলনের ডাক
জননিরাপত্তা বিভাগের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের। তারা জানান, বৈষম্য দূর করতে শান্তিপূর্ণ আলোচনা চালিয়ে যাবেন তারা। তবে সরকারের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ না এলে দাবি আদায়ে কঠোর কর্মসূচি দেওয়া ছাড়া তাদের আর কোনো পথ থাকবে না।
জানতে চাইলে জননিরাপত্তা বিভাগের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. আল কামার আলী কামাল বলেন, আমরা চাই মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগ থেকেই সমহারে মিশনে পাঠানো হোক। সমতা ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে পদায়ন হোক। আদালত থেকে শুরু করে পরিপত্র– সব জায়গাতেই সমহারে মিশনে প্রেরণের পক্ষে সম্মতি থাকলেও তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এটা স্পষ্ট বৈষম্য সৃষ্টি করছে। তাই আমরা বলতে চাই, আমাদের ন্যায্য দাবি না মানা হলে সামনে কঠোর কর্মসূচি দেওয়া ছাড়া আর পথ থাকবে না।
জননিরাপত্তা বিভাগের পার্সোনাল অফিসার (পিও) শেখ শহিদুল ইসলাম বলেন, সবকিছু সমাধানের একটি পথ আছে। বারবার আমাদের বঞ্চিত করা হয়েছে। আদালতে আমাদের পক্ষে রায়, পরিপত্রে আমাদের পক্ষে সিদ্ধান্ত অথচ মিশনে পদায়নে বৈষম্য। আমরা একটি টেকসই সমাধান চাই। দেশের নতুন সরকার এবং মন্ত্রণালয়ের নতুন অভিভাবক এই বৈষম্য আমলে নিয়ে একটি কার্যকরী সিদ্ধান্ত নেবেন বলে আমাদের বিশ্বাস।
তিনি বলেন, আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে আমাদের দাবি মানা না হলে অতি দ্রুত আমরা বড় কর্মসূচির দিকে এগোবো।
এ বিষয়ে কথা বলতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এবং সিনিয়র সচিবকে কল করা হলেও পাওয়া যায়নি।
এমএম/এসএসএইচ