সাইফুলের ছোট্ট মেয়েটি জানে তার বাবা গুম হয়েছে
প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর বা ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্সের (ডিজিএফআই) বিশেষ ঘরের বন্দিশালা থেকে গতকাল মঙ্গলবার (৬ আগস্ট) মুক্তি পেয়েছেন জামায়াত ইসলামের সাবেক দুই নেতার ছেলে। এই দুই বন্দির মুক্তিতে গতকাল এবং আজ সকাল থেকে ওই ঘরের সামনে প্রায় ৫০০ পরিবার গুম হওয়া স্বজনের ছবি নিয়ে সন্ধান চাইছেন। ছবি নিয়ে কেউ সন্ধান চাইছেন বাবার, কেউ ভাইয়ের, কেউ বা আবার শ্বশুরের। দীর্ঘদিন ধরে স্বজন হারানোর চাপা কষ্ট যেন এই মানুষগুলোকে ক্ষতবিক্ষত করছে প্রতিনিয়ত।
বুধবার (৭ আগস্ট) দুপুরে হঠাৎ খবর ছড়িয়ে পড়ল ওই বিশেষ বন্দিশালা থেকে সবাইকে মুক্ত করা হচ্ছে। এমন খবর পেয়ে ঢাকা পোস্ট ওই বন্দিশালার সামনে হাজির হয়। যদিও কাউকে সেখান থেকে মুক্ত হতে দেখা যায়নি। তবে গুম হওয়া ব্যক্তিকে ফিরে পেতে ওই বন্দিশালার সামনে স্বজনদের আহাজারি দেখা গেছে। এ সময় “মায়ের ডাক” নামে একটি সংগঠন গুম হওয়া সবার নাম ও স্বজনদের মোবাইল নম্বর তালিকাভুক্ত করে দিয়েছে ডিজিএফআইকে।
আরও পড়ুন
এর আগে গত সোমবার রাতে কর্নেল সামসের নেতৃত্বে ২০-২৫ জন সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনরা রাজধানীর ক্যান্টনমেন্টের কচুক্ষেত এলাকায় অবস্থান নেন।
তারা গণমাধ্যমকে জানান, ডিজিএফআইয়ের ওই ঘরে অনেক মানুষকে অন্যায়ভাবে বন্দি করে রাখা হয়েছে। বন্দিদের ছাড়িয়ে নিতে আমরা অবস্থান নিয়েছি। তাদের অক্ষত অবস্থায় হস্তান্তর না করা পর্যন্ত আমরা ফিরব না। বন্দিদের মুক্তি না দেওয়া পর্যন্ত আমাদের অবস্থান চলবে। আমাদের সঙ্গে গুম হওয়া স্বজনদের সংগঠন মায়ের ডাকও যোগ দেয়। মুক্তির জন্য জন্য চাপ প্রয়োগের এক পর্যায়ে মুক্ত হওয়ার সংবাদ পাওয়া যায়। গত সোমবার বন্দিশালা থেকে মুক্ত হওয়ার পরই গতকাল মঙ্গলবার ও আজ বুধবার কচুক্ষেতে বিভিন্ন সময় গুম হওয়াদের স্বজনরা অবস্থান নেন।
বাবাকে ফিরে পেতে এক বুক আশায় ফারুকের মেয়ে
রাজধানীর কচুক্ষেতে আজকে অবস্থান নেয় ২০১২ সালে গুম হওয়া বিএনপির রাজনীতিবিদ ফারুক হোসেন টিটুর মেয়ে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, টঙ্গীর নতুন বাজার রেলগেট থেকে ২০১২ সালে ফারুক হোসেনকে তুলে নিয়ে আসে আইনশৃঙ্খলা পরিচয় দেওয়া সদস্যরা। অর্থাৎ গুম হন তিনি। সাদা পোশাক পরিহিত কয়েকজন লোকজন তুলে নিয়ে যায় তাকে। তার গুম হওয়ার পর থানায় জিডিসহ র্যাব-১ এ আবেদন করেছিল পরিবার। এখন এক বুক আশায় ছবি নিয়ে আয়না ঘরের সামনে বাবার সন্ধান চাইতে এসেছি আমরা।
স্বামীকে ফিরে পেলে ঢাকা ছেড়ে চলে যাবেন ফারুকের স্ত্রী
ফারুক হোসেনের স্ত্রী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার স্বামীকে ফিরে পেলে প্রয়োজনে আমরা ঢাকা ছেড়ে চলে যাব। তারপরও আমার স্বামীকে পেতে চাই। থানায় জিডি করার পর মামলা করেছি। যা বর্তমানে সিআইডির কাছে আছে। তারা আমাদের সঠিক কোনো তথ্য দিতে পারেনি। তাদের কাছ থেকে আমরা কোনো সঠিক খোঁজ পাচ্ছি না। আমরা আগে থেকেই জানি এখানে এই ঘর আছে এবং আমার স্বামী এখানেই আছে।
তিনি বলেন, আমার তিনটা মেয়ে। আমার স্বামী নিখোঁজের পর তিনটা মেয়েকে অনেক কষ্ট করে মানুষ করেছি। গত ১২ বছর ধরে তিন মেয়েকে নিয়ে আমি অনেক কষ্ট করছি। আমার স্বামীর উপরই আমাদের পরিবার চলত।
হাউমাউ করে কাঁদলেন ফারুকের ভাই
ফারুক হোসেন টিটুর ছোট ভাই কাঁদতে কাঁদতে বলেন, কী অপরাধ করেছে আমার ভাই? আমার ভাই কোনো অপরাধ করেনি। আমার ভাই কারো সঙ্গে মারামারি-ঝগড়া করেনি। ভাই শুধু বিএনপির রাজনীতিতে যাইত, আর কিছু না। ২০১২ সালে আমাদের বাড়ি দখল করেছে। আমাকে এবং আমার মাকে মামলা দিয়ে জেলখানায় নিয়ে গেছে। ওই সময় আমাদের কাছ থেকে শুধু শুধু ২০ লাখ টাকা জরিমানা নিয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতারা বলেছে, আমরা নাকি ডাকাতি করেছি। ডাকাতির বিষয়ে আমি যখন স্বীকার যাইনি, তখন আমাকে মেরে ডাকাতির কথা বলতে বাধ্য করিয়েছিল।
স্বামীর সন্ধানে টঙ্গী থেকে কচুক্ষেত সুজনের স্ত্রী
সুজন নামে এক বিএনপি নেতার স্ত্রীও খবর শুনে স্বামীকে নিতে টঙ্গী থেকে ছুটে এসেছেন কচুক্ষেতে। তিনি বলেন, গত ছয় বছর ধরে আমার স্বামী নিখোঁজ আছেন। সুজনের নিখোঁজের পর থেকেই আমার দুই ছেলেকে নিয়ে খুব কষ্টে জীবন-যাপন করছি। সবাইকে ছাড়া হচ্ছে এমন খবর শুনেই আমি এখানে এসেছি।
সুজনের বোন বলেন, আমার ভাইকে পাওয়ার আশায় এখানে এসেছি। র্যাব পরিচয়ে সাদা পোশাকে আমার ভাইকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে আসে। আজকে এখানে আসার পর মায়ের ডাক নামে সংগঠনের লোকজন আমার ভাইয়ের নাম ও আমাদের মোবাইল নম্বর নিয়ে ওই ঘরের ভেতরে গেছেন।
চাচ্চু তুমি বার বার আসো, বাবা আসে না কেন প্রশ্ন করে খায়রুলের সন্তানরা
বিএনপির আরেক কর্মী শেখ খায়রুল হাসান টিটুর ছোট ভাই বলেন, আমার ভাই ২০১৫ সাল থেকে নিখোঁজ রয়েছে। আমার বড় ভাইকে এখনও পাইনি। এই ঘরেই আছে আমার ভাই। এ ঘর থেকে যেহেতু দুইজন উদ্ধার হয়েছে, সেহেতু আমার ভাই এই ঘরেই আছে। আমার ভাইয়ের দুইটা বাচ্চা আছে। ওদের বাবা বিদেশে আছে এই বলে বাচ্চা দুইটাকে আমরা বুঝ দিয়ে রেখেছি। আমি বিদেশ থেকে বার বার আসি যাই তখন ভাইয়ের বাচ্চারা প্রশ্ন করে চাচ্চু তুমি বার বার আসছ কিন্তু আমার বাবা আসে না কেন? এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারি না কখনই।
রাতের মধ্যে মুক্তি না হলে বৃহস্পতিবার ঢাবিতে অবস্থান
তিনি বলেন, গত দুইদিন ধরে আমরা এখানে আসছি। আজকে প্রায় ৫০০ এর মতো পরিবার এখানে এসেছে। মায়ের ডাক সংগঠনের মাধ্যমে সবার তালিকা হয়েছে। আজকে রাতে সেনা প্রধানের সঙ্গে এ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হবে। রাতের মধ্যে এই বিষয়টির সমাধান না হলে আগামীকাল আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান করব।
ছেলে ফিরবেন বলে সারারাত কাঁদছেন মা : নিখোঁজ ইকবালের ভাই
আগারগাঁও থেকে মো. ইকবাল হোসেন নামে এক ব্যবসায়ীর ছোট মো. ডালিম হোসেন ছবি নিয়ে খোঁজ করতে এসেছেন নিজের বড় ভাইয়ের। তিনি বলেন, ২০১১ সালের ডিসেম্বরে আমার বড় ভাই নিখোঁজ হন। ওই ঘর থেকে নাকি মানুষ বের হচ্ছে, এজন্য ভাইয়ের খোঁজে এখানে এসেছি। ভাইয়ের সন্ধান পেতে র্যাব হেডকোয়ার্টার, পুলিশ সদর দপ্তরে কাগজপত্র দেওয়া হয়েছিল। দেশের নাগরিক হিসেবে আমার ভাই যেই অবস্থায়ই থাকুক না কেন, আমরা সন্ধান চাই। ভাইয়ের জন্য আমার মা এখনও সারারাত কান্না করে এবং ছেলের আশায় থাকে।
সেনা কর্মকর্তা সুলতান মাহমুদের নিখোঁজের পর থেকেই মানসিক প্রতিবন্ধী স্ত্রী-সন্তান
সুলতান মাহমুদ নামে এক সেনা কর্মকর্তার মেয়ের জামাইও ছবি নিয়ে শ্বশুরের খোঁজ পেতে ছুটে এসেছেন কচুক্ষেতে। সুলতান মাহমুদের মেয়ের জামাই বলেন, আমার শ্বশুর ২০১৫ সালের জুলাই মাসে বাসা থেকে বের হয়ে আর ফেরেননি। এ বিষয়ে আমরা ক্যান্টনমেন্ট থানায় একটি জিডি করেছি। তৎকালীন সময়ে আমরা বাইরের কোন থানায় জিডি এবং পত্রিকায় ও সোশ্যাল মিডিয়ায়ও এই খবর দিতে পারিনি। কারণ সেনাবাহিনীর লোকেরা আমাদের নিষেধ করেছিল। আমাদের একটাই চাওয়া, আমরা উনাকে ফেরত পেতে চাই। আমর শ্বশুর নিখোঁজের পর থেকেই তার একমাত্র ছেলে মানসিক প্রতিবন্ধী হয়ে গেছে। সে ঘর থেকে আর বের হয় না।
ছোট মেয়ে মায়ামও জানে তার বাবা গুম হয়েছে
কুমিল্লার দাউদকান্দি থেকে গুম হওয়া আরেক ব্যক্তি সাইফুল ইসলাম। ছোট্ট মেয়েকে নিয়েই স্বামীর খোঁজে এসেছেন ওই ঘরের সামনে। সাইফুল ইসলামের ছোট মেয়ে মায়ামকে তার বাবার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে জানায়, আমার বাবা গুম হয়েছে।
সাইফুল ইসলামের স্ত্রী জানান, আমার স্বামীকে ফিরে পেতে এখানে এসেছি। ২০২০ সালে আমার তিনি গুম হয়েছিলেন। আমার স্বামী বিএনপির রাজনীতি করতেন। এজন্যই গুম হয়েছেন। গত চার বছর অনেক কষ্ট হয়েছে, ফিরে পেলে আর রাজনীতি করতে দেব না।
গত সোমবার ৮ বছর পর কথিত সেই বন্দিশালা থেকে মুক্ত হন সাবেক সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (বরখাস্ত) আবদুল্লাহিল আমান আযমী ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আহমাদ বিন কাসেম (আরমান)।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী তাদের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে পোস্ট দিয়ে আবদুল্লাহিল আমান আযমী ও আহমাদ বিন কাসেমের মুক্ত হওয়ার তথ্য নিশ্চিত করে।
আবদুল্লাহিল আমান আযমী জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর প্রয়াত গোলাম আযমের ছেলে। আর আহমাদ বিন কাসেম একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের সাবেক কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাসেম আলীর ছেলে। ২০১৬ সালের ৯ আগস্ট আহমদ বিন কাসেমকে (আরমান) মিরপুর ডিওএইচএস থেকে এবং এর কয়েকদিন পর ২৩ আগস্ট আবদুল্লাহিল আমান আযমীকে গুম করা হয় বলে তাদের পরিবারের অভিযোগ।
এসআর/এসকেডি