স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে ইভিএম চায় ইসি
বর্তমানে একটি ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনও (ইভিএম) শতভাগ ত্রুটিহীন নেই। এর মধ্যেই সিটি কর্পোরেশনসহ স্থানীয় সরকারের সব নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করতে চায় নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
ইসি কর্মকর্তারা জানান, হাতে থাকা সচল মেশিনগুলো দিয়েই স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো সম্পন্ন করতে চায় কমিশন। সামনে ঢাকার দুই সিটি ভোটও হতে পারে ইভিএমে। কিন্তু শতভাগ ত্রুটিহীন মেশিন নেই একটিও। এ অবস্থায় ইভিএমে দক্ষ কারিগরি লোকবল তৈরির প্রতি জোর দেওয়া উচিত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তবে গত ৩০ জুন দেশসেরা প্রযুক্তিবিদদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত ইসির এক সভায় যন্ত্রটির কারিগরি উন্নয়নকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।
একজন নির্বাচন কমিশনার বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, আমাদের বর্তমান যে মেশিনগুলো আছে এগুলোর ওজন অনেক বেশি। ওজন কমানোর কথা হয়েছে বৈঠকে। এ ছাড়া কারিগরি উন্নয়ন তথা ভিভিপ্যাট (ভোটার ভেরিফায়েবল পেপার অডিট ট্রেইল) যুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তাছাড়া এই মেশিনগুলোর ব্যয় অনেক বেশি। প্রায় দুই লাখ ৩৫ হাজার টাকা। এটা কীভাবে কমানো যায়, তা নিয়েও আলোচনা হয়েছে।
আরও পড়ুন
ইভিএমের সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান কেবল একটি, তা হলো বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি (বিএমটিএফ)। নতুন করে ইভিএম উৎপাদনে গেলে কার কাছ থেকে নেওয়া হবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত নয়। সিদ্ধান্ত হলে আমরা ওপেন সোর্সের মাধ্যমেও যেতে পারি।
বৈঠকের বিষয়ে ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ জানান, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এম কায়কোবাদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. হায়দার আলী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. মো. মাহফুজুল ইসলামের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক একটি বৈঠক হয়েছে। এতে ভিভিপ্যাট যুক্ত করা, ওজন কমানো ও ব্যয় কমানোর বিষয়ে আলোচনা হয়। পরে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে করণীয় নির্ধারণ করা হবে। এক্ষেত্রে স্টেকহোল্ডার বা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও বসতে পারে কমিশন। সবার মতামত পেলে ইভিএমের কারিগরি উন্নয়নে হাত দেবে ইসি।
এ নিয়ে ইসি সচিব শফিউল আজিম বলেন, আমরা ইভিএমকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে চাই। এজন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থার জন্য একটি ওয়্যারহাউজ তৈরি করতে জায়গা চাওয়া হয়েছে ঢাকার জেলা প্রশাসকের কাছে। সেখানে নিজস্ব টেকনিক্যাল টিম তৈরির করার পরিকল্পনা রয়েছে। কেননা, নির্বাচনে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো উচিত। আমরা সামনের সব স্থানীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করব।
জানা গেছে, এক-এগারো সরকারের সময়কার ড. এটিএম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন দেশের ভোট ব্যবস্থায় ইভিএমের ব্যবহার শুরু করে। সেসময় তারা বুয়েট থেকে ১২ হাজার টাকা ব্যয়ে মেশিন তৈরি করে নেয়। ওই কমিশনের ধারাবাহিকতায় পরে কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন কমিশনও ভোট যন্ত্রটি ব্যবহার করে। তবে ২০১৫ সালে রাজশাহী সিটি নির্বাচনে একটি মেশিন অচল হয়ে পড়ায় তা আর ব্যবহার উপযোগী করতে পারেনি রকিব কমিশন। পরে তারা বুয়েটের তৈরি স্বল্প মূলের ওই মেশিনগুলো পুড়িয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত ও উন্নত মানের ইভিএম তৈরির পরিকল্পনা রেখে যায়।
২০১৭ সালে কেএম নূরুল হুদার কমিশন এসে বুয়েটের তৈরি ইভিএমের চেয়ে প্রায় ২০ গুণ বেশি দামে মেশিন কেনার সিদ্ধান্ত নেয়। ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঠিক পূর্বে বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির (বিএমটিএফ) কাছ থেকে উন্নতমানের ইভিএম তৈরি করে নেন তারা। এতে মেশিন প্রতি ব্যয় হয় দুই লাখ ৩৫ হাজার টাকার মতো। হাতে নেওয়া হয় তিন হাজার ৮২৫ কোটি টাকার প্রকল্প।
সেই প্রকল্প থেকে দেড় লাখ ইভিএম কেনে রকিব কমিশন। প্রকল্পের সংরক্ষণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের ব্যবস্থা না থাকায় সেই উন্নত মানে ইভিএম মেয়াদ ১০ বছর হলেও পাঁচ বছর যেতে না যেতেই অকেজো হওয়া শুরু করে। কন্ট্রোল ও ব্যালট ইউনিট মিলে একটি সেট, যা একটি ইভিএম হিসেবে ধরা হয়।
কর্মকর্তারা বলছেন, ২০২৩ সালে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পূর্বে এসে প্রায় প্রতিটি সেটেই কোনো না কোনো সমস্যা দেখা দেয়। প্রায় ৪০ হাজারের মতো মেশিন ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ে। অবশিষ্ট এক লাখ ১০ হাজার মেশিনের অধিকাংশগুলোতে ধরা পড়ে নানা ধরনের ত্রুটি। কিন্তু মেরামতের জন্য ছিল না নতুন কোনো অর্থের জোগান। ফলশ্রুতিতে হাজার হাজার কোটি টাকার ইভিএম অচল হয়ে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দেয়। অকেজো মেশিন মেরামত, সংরক্ষণ প্রভৃতির জন্য সাড়ে ১২শ কোটি টাকার প্রস্তাব দিলে বৈশ্বিক অর্থ সংকটের কারণ দেখিয়ে সরকার সেটি নাকচ করে দেয়। বর্তমানে অকেজো ইভিএমের সংখ্যা আরও বেড়েছে।
ইভিএম প্রকল্প পরিচালক কর্নেল সৈয়দ রাকিবুল হাসান বলেন, বর্তমানে এক লাখ ১০ হাজার মেশিন ব্যবহার অনুপযোগী। আর ৪০ হাজারের মতো মেশিন নির্বাচনে ব্যবহার করা যাচ্ছে। তবে শতভাগ ত্রুটিমুক্ত মেশিন একটিও নেই। সব মেশিনেই কোনো না কোনো সমস্যা আছে। তবে সেগুলো সারিয়ে নির্বাচনে ব্যবহারযোগ্য।
তিনি বলেন, আসল কথা হলো দক্ষ লোকবলের অভাব। আমাদের প্রকল্প থাকলেও সেখানে দক্ষ কারিগরি লোকবল নেই যারা ছোটখাটো সমস্যা হলে সমাধান করতে পারে। আগেও যে ইভিএম ছিল তখনো কারিগরি লোকবল নিয়ে ভাবনা হয়নি। এখনো নেই। বৈঠকে বিশেষজ্ঞরা প্রয়োজনীয় লোকবল তৈরির ওপর জোর দিয়েছেন। ভিভিপ্যাট যুক্ত করা যেতে পারে।
গত ৩০ জুন ইভিএম প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে। তবে পরিকল্পনা কমিশনে ব্যয় না বাড়িয়ে কেবল প্রকল্পের মেয়াদ এক বছর বাড়ানোর জন্য প্রস্তাব দিয়েছে ইসি। এক বছর মেয়াদ বাড়বে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এসআর/এসএসএইচ