আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে দফায় দফায় দাবি পরিবর্তনের কারণ কী?
কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সজাগ থাকার আহ্বান জানিয়েছেন তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত। তিনি অভিযোগ করেছেন, কিছু মানুষ সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের আবেগকে ব্যবহার করে তাদের বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা করছে। এ জায়গায় তাদের সচেতন ও সজাগ থাকতে হবে।
শনিবার বিকেলে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে সমসাময়িক বিষয়ে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রতিমন্ত্রী এসব কথা বলেন। প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রতিমন্ত্রী একটি লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন। পাশাপাশি লিখিত বক্তব্যের বাইরেও কথা বলেন।
প্রতিমন্ত্রী প্রশ্ন রেখে বলেন, আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে দফায় দফায় দাবি পরিবর্তনের কারণ কী? বিষয়টি আমি পরিষ্কার করছি। রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ- নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ ও আইন সভা। এই তিনটি অঙ্গ কীভাবে কাজ করে তা না জেনেই আন্দোলনকারীরা ইচ্ছা মতো তাদের দাবি পরিবর্তন করে যাচ্ছে। কিন্তু কেন?
‘প্রথমে আন্দোলনকারীদের দাবি ছিল, হাইকোর্ট বিভাগের আদেশে সরকারের জারি করা যে পরিপত্র বাতিল করা হয়েছিল তা পুনর্বহাল করা। এটি পুনর্বহাল করার ক্ষমতা শুধু বিচার বিভাগেরই আছে। কাজেই ধরে নেওয়া যায় সেই দাবি ছিল বিচার বিভাগের কাছে। আমরা সবাই জানি, হাইকোর্টের আদেশ রাস্তায় আন্দোলন করে পরিবর্তন করা যায় না। এটি পরিবর্তনের একমাত্র উপায় সর্বোচ্চ আদালতের আপিল বিভাগে হাইকোর্টের আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে আপিল করা।’
প্রতিমন্ত্রী বলেন, হাইকোর্ট বিভাগের আদেশের বিরুদ্ধে সরকারপক্ষ যখন সর্বোচ্চ আদালতে আবেদন করে এবং আইনি লড়াই শুরু করে, তখন সরকারের অবস্থান এবং আন্দোলনকারীদের অবস্থান একই হয়ে যায়। আন্দোলনকারীরা তাদের পক্ষে আইনজীবী নিয়োগ দিয়ে সরকারে সাথে পক্ষভুক্তও হয়। অথচ, আন্দোলনকারীরা আবার তাদের দাবি পরিবর্তন করে। এবার তারা দাবি করে, ‘সরকারকে কমিশন গঠন করে কোটা ব্যবস্থার সংস্কার করতে হবে।’
‘অথচ আমরা জানি, হাইকোর্ট বিভাগের আদেশের বিরুদ্ধে সরকারপক্ষ যখন সর্বোচ্চ আদালতে আইনি লড়াই করছে সেই অবস্থায় কমিশন গঠন করে কোটা ব্যবস্থার সংস্কার করা বা সংস্কার করার ঘোষণা দেওয়ারও কোনো সুযোগ নেই। এর মধ্যে সরকারপক্ষের আইনজীবীরা সুপ্রিম কোর্ট থেকে চার সপ্তাহের জন্য স্থিতাবস্থা বা status quo নিয়ে আসতে সক্ষম হোন। সর্বোচ্চ আদালত বিষয়বস্তুর (subject matter) ওপর চার সপ্তাহের জন্য স্থিতাবস্থা (status quo) আদেশ দেওয়ার ফলে কোটা বিষয়ে সরকারের জারি করা পরিপত্র আবার পুনর্বহাল হয়ে যায়।’
মোহাম্মদ আলী আরাফাত বলেন, সর্বোচ্চ আদালতের আদেশে এও বলা হয় যে, The high court judgement will not remain in operation অর্থাৎ আন্দোলনকারীদের সর্বপ্রথম যে দাবি ছিল, ‘হাইকোর্ট বিভাগের আদেশে সরকারের জারি করা যে পরিপত্র বাতিল করা হয়েছিল তা পুনর্বহাল করা।’ সেই দাবি তো পুরোপুরি পূরণ হয়ে গেছে। বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়ে যায় যে, সরকারপক্ষের আইনজীবীরা আন্দোলনকারীদের দাবির পক্ষেই সর্বোচ্চ আদালতে আইনি লড়াই করছেন।
এদিকে, সর্বোচ্চ আদালতও আন্দোলনকারীদের আহ্বান জানিয়ে বলেছেন যে, তাদের বক্তব্য পেশ করার জন্য আদালতের দরজা সবসময় খোলা।
আন্দোলনকারীরা আবারও তাদের দাবি পরিবর্তন করে— উল্লেখ করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ তথা সরকার যখন আদালতে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মীমাংসার পথে এগোচ্ছে তখন আন্দোলনকারীরা আবারও তাদের দাবি পরিবর্তন করে। তারা বলা শুরু করে যে, বিচার বিভাগ নয়, নির্বাহী বিভাগের মাধ্যমে সমাধান চায়। অথচ সর্বোচ্চ আদালতের প্রক্রিয়া পুরোপুরি সমাপ্ত না করে সরকার এ বিষয়ে কোনো কিছুই করতে পারবে না। এ বিষয়ে কোনো ঘোষণাও দিতে পারবে না। এটি তো সবারই জানা।
‘সর্বশেষ যখন হাইকোর্ট বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ের আংশিক প্রকাশিত হয় এবং হাইকোর্ট বিভাগ, নির্বাহী বিভাগের প্রতি কার্যত কোটা সংস্কার করার পরামর্শ দেয়, তা সামনে আসার পর আন্দোলনকারীরা আবারও তাদের দাবি পরিবর্তন করে ফেলে। এখন তাদের দাবি আইনসভা অর্থাৎ সংসদের কাছে!’
‘কোটা বিষয়ে মূলত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ থেকে, আদালত কিংবা সংসদের বিষয় নয় এটি’— সংবাদ সম্মেলনে মন্তব্য করেন মোহাম্মদ আলী আরাফাত। তিনি বলেন, যেহেতু সরকারের জারি করা পরিপত্র হাইকোর্ট বাতিল করেছে এবং সরকার বিষয়টি নিয়ে সর্বোচ্চ আদালতে লড়ছে এবং আন্দোলনকারীরা তাদের পক্ষে আইনজীবী নিয়োগ দিয়ে সরকারের সাথে পক্ষভুক্তও হয়েছে, কাজেই সরকারকে অপেক্ষা করতে হচ্ছে আইনি প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার জন্য।
‘সরকারপক্ষের আইনজীবীরা সর্বোচ্চ আদালতে তাদের তর্ক উপস্থাপনেও বিষয়টি এনেছেন এবং আরও জোরালোভাবে আনবেন যে কোটা বিষয়ে নীতি বা পলিসি সিদ্ধান্ত নির্বাহী বিভাগেরই কাজ, আদালতের নয়।’
কাজেই সংসদে এ বিষয়ে আইন প্রণয়নের দাবি একেবারেই অজ্ঞতাপ্রসূত— মন্তব্য করেন তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী।
‘এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আন্দোলনকারীদের দাবি বারবার পরিবর্তন হচ্ছে কেন? একেকবার রাষ্ট্রের একেক অঙ্গের কাছে দাবি করা হচ্ছে কেন? এতে প্রমাণিত হয় তারা আদৌও পুরো বিষয় সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়।’
তিনি বলেন, সর্বোচ্চ আদালতের আদেশের মাধ্যমে সরকারি পরিপত্র আবারও পুনর্বহাল হওয়ার পর আন্দোলনকারীদের প্রাথমিক দাবি পূরণ হওয়া এবং তাদের মৌলিক দাবি ও সরকারের অবস্থান একই রকম প্রতীয়মান হওয়া সত্ত্বেও যারা বারবার দাবি পরিবর্তন করে বিভ্রান্তি তৈরি করছে এবং এখনও আন্দোলনের নামে জনদুর্ভোগ তৈরি করছে আমি মনে করি তারা কোটা পদ্ধতির সংস্কার চায় না, তাদের অন্য কোনো দুরভিসন্ধি আছে।
‘মেধা না কোটা; কোটা না মেধা; মেধা, মেধা। স্লোগানটি খুবই যৌক্তিক’ উল্লেখ করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমি এ স্লোগানের পক্ষে। অবশ্যই মেধা আগে। কিন্তু এই স্লোগানের মাধ্যমে যে বক্তব্য হাজির করা হচ্ছে সেখানে বিভ্রান্তি তৈরি করা হচ্ছে। কোটায় নিয়োগের ক্ষেত্রেও মেধাবীদের বিবেচনা করা হচ্ছে। একটা পর্যায় পর্যন্ত মেধার মাধ্যমে বাছাই করা হচ্ছে। কোটার বিপক্ষে যখন মেধাকে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে, এখানে অসত্য বলা হচ্ছে। কারণ, কোটার সুবিধা পাওয়ার জন্য মেধাতালিকায় যেতে হচ্ছে। যে কারণে পৃথিবীর সব দেশেই কোটা ব্যবস্থা আছে। এটা প্রয়োজন।
কোটা বৈষম্য তৈরি করে না। কোটার উদ্দেশ্য পিছিয়ে পড়া, অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর বৈষম্য নিরসন। সরকার বৈষম্যের নিরসন করে মেধার মূল্যায়ন করতে চেষ্টা করছে— মন্তব্য করেন প্রতিমন্ত্রী। বলেন, ‘সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরাও মেধার মূল্যায়ন চায়। এ স্পিরিটের সঙ্গে আমি একমত। কিন্তু মেধার মূল্যায়ন করতে গিয়ে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠী, যারা নিগৃহীত, বঞ্চনার শিকার, যারা এ দেশ তৈরি করেছেন সেই মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবার যাতে পিছিয়ে না যায় সেটিও খেয়াল রাখতে হবে। সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের পুরো বিষয়টি জানা ও বোঝার চেষ্টা করতে হবে। তাদের বুঝতে হবে, তাদের দাবি ও সরকারের অবস্থান একই জায়গায় মিলে গেছে। আন্দোলনকারীদের দাবির সঙ্গে সরকারের অবস্থান সংগতিপূর্ণ। কিন্তু কিছু মানুষ সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের আবেগকে ব্যবহার করে তাদের বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা করছে। এ জায়গায় তাদের সচেতন ও সজাগ থাকতে হবে।
এসএইচআর/এসকেডি