ভিডিও মামলার জন্য বিআরটিএর সার্ভারে প্রবেশাধিকার চায় ডিএমপি
সড়কে শৃঙ্খলা আনতে করোনা মহামারির আগে ‘ভিডিও মামলা’ কার্যক্রম শুরু করেছিল ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ। কিন্তু নানা জটিলতার কারণে কার্যক্রমটি বেশিদূর এগোয়নি। ফলে গুরুত্বপূর্ণ সড়কে গাড়ি পার্কিং, উল্টো পথে যান চলাচলসহ নানামাত্রিক অনিয়মের কারণে রাজধানীর যানজট আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এ অবস্থায় ভিডিও মামলার কার্যক্রম পুনরায় চালুর উদ্যোগ নিয়েছে ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ।
এরই অংশ হিসেবে গত ১৩ জুন ঢাকার সব ট্রাফিক বিভাগকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। নির্দেশনার পর গত ২০ দিনে নানা অপরাধের ভিডিও ডিএমপির আটটি ট্রাফিক বিভাগের ট্রাফিক সার্জেন্টরা সংগ্রহ করলেও নানা জটিলতায় মামলা দেওয়া সম্ভব হয়নি।
ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ বলছে, ভিডিও মামলার ক্ষেত্রে বেশ কিছু সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন তারা। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বিআরটিএ কর্তৃক গাড়ির নম্বরের বিপরীতে মালিকানা ও চালকের তথ্য যাচাই কার্যক্রম। একেকটি ভিডিও মামলার জন্য বার বার বিআরটিএয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হচ্ছে ট্রাফিক বিভাগকে।
ট্রাফিক পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, ভিডিও মামলার কার্যক্রম চালাতে হলে বিআরটিএ সার্ভারের একসেস দরকার। কিন্তু সেখানে নেই তাদের প্রবেশাধিকার। সেটার জন্য পুলিশ সদর দপ্তর, আন্তঃমন্ত্রণালয় পর্যায়ে আলোচনা চলছে।
আরও পড়ুন
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মনিবুর রহমান স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে ট্রাফিক-রমনা, ট্রাফিক-মতিঝিল, ট্রাফিক-ওয়ারী, ট্রাফিক-লালবাগ, ট্রাফিক-তেজগাঁও, ট্রাফিক-মিরপুর, ট্রাফিক-গুলশান ও ট্রাফিক-উত্তরা বিভাগের উপ-কমিশনারকে (ডিসি) ডিএমপির ই-ট্রাফিক প্রসিকিউশন সিস্টেমে ভিডিও প্রসিকিউশন এবং ড্রাইভিং লাইসেন্সের বিপরীতে প্রসিকিউশন প্রদান প্রসঙ্গে নতুন নির্দেশনা দেওয়া হয়।
এতে বলা হয়, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগে ই-ট্রাফিক প্রসিকিউশন সিস্টেমে স্ব-স্ব ট্রাফিক বিভাগের ক্যামেরায় ধারণকৃত ভিডিও ফুটেজ ও ছবির বিপরীতে প্রসিকিউশন প্রদানের জন্য ডিএমপি কমিশনার নির্দেশনা প্রদান করেছেন। সেই নির্দেশনার আলোকে ই-ট্রাফিক সফটওয়্যার ভিডিও প্রসিকিউশন অ্যান্ট্রি এবং ভিডিও প্রসিকিউশন ভিউ নামে দুটি ট্যাব সংযুক্ত করা হয়েছে। ওই দুটি ট্যাবে ইনপুট করা তথ্যের ভিত্তিতে প্রসিকিউশন সংক্রান্ত চিঠি স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রিন্ট হবে।
চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, ডিএমপি অধ্যাদেশ ১০২ ধারা অনুযায়ী প্রসিকিউশন যানবাহনের মালিক/চালক এর হাজিরকরণ এবং সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ ও সড়ক পরিবহন বিধিমালা-২০২২ মোতাবেক "কর্তৃপক্ষ মোটরযান ও ড্রাইভিং লাইসেন্স সংক্রান্ত অপরাধের জন্য ডিজিটাল পদ্ধতিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মামলা দায়ের ও নিষ্পত্তি করার ব্যবস্থা রয়েছে।
নির্দেশনার আলোকে পজ ডিভাইজে ড্রাইভিং লাইসেন্সের বিপরীতে প্রসিকিউশনের ব্যবস্থা রয়েছে। এ অবস্থায়, ডিএমপির ই-ট্রাফিক প্রসিকিউশন সিস্টেমে ভিডিও প্রসিকিউশন এবং ড্রাইভিং লাইসেন্সের বিপরীতে প্রসিকিউশন প্রদানের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া হয়।
ওই চিঠির নির্দেশনা অনুযায়ী, ভিডিও প্রসিকিউশনের ক্ষেত্রে সিসিটিভি ফুটেজ, ক্যামেরায় ধারণকৃত ভিডিও, বডিওর্ন ক্যামেরার ফুটেজ এবং অন্যান্য উৎস হতে প্রাপ্ত ভিডিও ফুটেজ যথোপযুক্ত প্রমাণাদি ভিডিও প্রসিকিউশন প্রদানে ব্যবহার করা যাবে। ধারণ করা ভিডিও বিশ্লেষণ করে তারপর হবে স্বয়ংক্রিয় মামলা। আর এই জায়গায় বাধার সম্মুখীন হচ্ছে ট্রাফিক বিভাগগুলো। যাচাই-বাছাই করতে দরকার হচ্ছে গাড়ির মালিকের নাম, যোগাযোগের নম্বর ও ঠিকানা। সেটি যাচাইয়ে প্রয়োজন হচ্ছে বিআরটিএয়ের সার্ভারের তথ্য। কিন্তু সেখানে প্রবেশাধিকার নেই ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের।
নির্দেশনার পর গত ২০ দিনে ভিডিও প্রসিকিউশনের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে যোগাযোগ করা হলে রমনা ট্রাফিক বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. জয়নুল আবেদীন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভিডিও মামলার কার্যক্রম শুরু করেছি। ইতোমধ্যে আমাদের অফিসে একটি সেল খোলা হয়েছে। সদর দপ্তরের নির্দেশনা মোতাবেক রমনা বিভাগের চারটি জোনকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আমরা লজিস্টিক সাপোর্টও পেয়েছি। তবে কিছু প্রক্রিয়া বাকি আছে। এ কারণে আমরা এখনো পুরোপুরি শুরু করতে পারিনি।
কী পরিমাণ মামলা হয়েছে সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে রাজি হননি তিনি।
অন্যদিকে গুলশান ট্রাফিক বিভাগের উপ-কমিশনার(ডিসি) আব্দুল মোমেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের এলাকায়ও ভিডিও মামলার কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
আরও পড়ুন
এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে ডিএমপি সদর দপ্তরে যোগাযোগের অনুরোধ জানান তিনি।
ভিডিও মামলার নির্দেশনার পর কী ধরনের বাধা বা অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছেন ট্রাফিক সদস্যরা? এমন প্রশ্নের জবাবে মতিঝিল ট্রাফিক বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ মইনুল হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভিডিও প্রসিকিউশনের উদ্দেশ্যই হচ্ছে মানুষকে আরও সজাগ ও সক্রিয় করা। ঢাকা শহরে পার্কিং ব্যবস্থা তো একটা ভয়াবহ সমস্যা। আর পার্কিং নেই বলে রাস্তায় গাড়ি পার্কিং করাটাও তো কোনো সমাধান নয়।
তিনি বলেন, আমাদের প্রতিটি টিমকে ব্রিফ করা আছে যে, যে সার্জেন্ট ভিডিও মামলা দেবেন তিনি যেন বিবেচকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে মামলার জন্য ভিডিও বা ছবিটা তোলেন। তাতে যিনি অপরাধ করেছেন তিনি অন্তত কিছু বলতে পারবেন না। আর অন্যের গাড়ি নিয়ে বের হওয়া তো আইনসিদ্ধ নয়। আমরা তো গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা দেব।
আরও পড়ুন
মইনুল হোসেন বলেন, যখন গাড়ির নম্বরটা পাচ্ছি ভুয়া তখন তো বিআরটিএর সহযোগিতা নিয়েও সেই অর্থে কিছু করার থাকে না। তখন আমরা আরও বেশি অনুসন্ধান করি। আমরা এখন পর্যন্ত ৩ শতাধিক ভিডিও মামলার তথ্য সংগ্রহ করেছি। এক এক করে সব পাঠাব।
ভবনে পার্কিং স্পেস থাকার পর সড়কে পার্কিং করে রাখার বিষয়ে তিনি বলেন, আমার এলাকায় ১৫-২০টি জায়গায় অন স্ট্রিট পার্কিং সুবিধা আছে। কিন্তু এর বাইরে সড়কে পার্ক করলে ভিডিও মামলার অধীনে আনা হবে। এছাড়া আমরা বাণিজ্যিক এলাকা হিসেবে মতিঝিলে বিভিন্ন ভবন মালিককে অনুরোধ করছি, পার্কিং সুবিধার সর্বোচ্চটা যেন ব্যবহার করা হয়। পার্কিং স্পেস যেন ভাড়া দেওয়া না হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএমপির একটি ট্রাফিক বিভাগের উপ-কমিশনার ঢাকা পোস্টকে বলেন, কিছু জটিলতা আছে। অনেক সময় যানবাহনের কাগজপত্র ভুয়া, ভুয়া ঠিকানা থাকে। সেগুলো খুঁজে বের করা কঠিন হয়ে যায়। আবার ভিডিও মামলার সিদ্ধান্ত হলে তার ডকুমেন্ট গাড়ির মালিককে কীভাবে পাঠানো হবে, এসব ব্যাপারে সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি। অর্থাৎ পুরোপুরি এটা শুরু করা যায়নি। অনেক কিছু পেন্ডিং আছে। আপনি খোঁজ নেন জানতে পারবেন। কেউই ভিডিও মামলা দিতে পারেনি। ফাইন করা বা মামলার বিপরীতে ডাকাডাকি শুরু হয়নি।
অন স্ট্রিট পার্কিংয়ে গাড়ি রাখলে অসুবিধা নেই। কিন্তু অবৈধ পার্কিং হলে মামলা হবে। অনেক ক্ষেত্রে সেটা হয়ে যাচ্ছে। এটা নিয়ে প্রায়ই বিভিন্ন মার্কেট, বাণিজ্যিক ভবন ও বড় আবাসিক ভবন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ঝামেলা হচ্ছে। আসলে সচেতনতার বিকল্প নেই। অনেক ভবন তো সচেতনভাবে লিখে রাখছে অতিথিদের গাড়ি বাইরে রাখুন। বাইরে কই রাখবে? এই সচেতনতা আসলে নাগরিকদের বেশি দরকার।
এ ব্যাপারে ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (ট্রাফিক উত্তর) আবু রায়হান মুহাম্মদ সালেহ্ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা ভিডিও মামলা কার্যক্রম শুরু করেছি। রাস্তার যে পরিস্থিতি আর আইন লঙ্ঘনের যে হিড়িক সে অনুযায়ী ভিডিও মামলা দিতে গেলে চলতি মামলার পরিমাণের চেয়ে ১০-১৫ গুণ বেড়ে যাবে মামলার সংখ্যা। তাই সার্জেন্টদের বলা হয়েছে, সময়, বাস্তবতা, আইন লঙ্ঘনের মাত্রা বিবেচনায় ভিডিও মামলার ডকুমেন্ট সংগ্রহ করবেন।
তিনি বলেন, যিনি বা যে সার্জেন্ট ভিডিও করবেন, তিনিই কিন্তু মামলা করতে পারবেন না। সেগুলো যাবে ডিসি অফিসে। ডিসির কার্যালয়ের সেল সেটা বিশ্লেষণ করবে। এরপর চিঠি ইস্যু করবে। ধরেন ৫০টা ভিডিও যদি বিশ্লেষণ করা হয়, এর বিপরীতে হয়ত ৫/১০টা মামলা হবে। বাকিগুলো হয়ত হবে না। আবার গাড়ির মালিক বা চালকও আত্মপক্ষও সমর্থনের সুযোগ পাবেন।
আরও পড়ুন
আবু রায়হান মুহাম্মদ সালেহ্ বলেন, মামলা শুধু তাদের ক্ষেত্রেই হবে যারা অবৈধ পার্কিং করে উধাও হয়ে গেছেন দীর্ঘ সময়, যে কারণে যানজট সৃষ্টি হয়েছে। চালক বা গাড়ির মালিকের তাৎক্ষণিক খোঁজ না মিললে ভিডিও ধরে মামলা হবে। অথবা ট্রাফিক সিগন্যাল অমান্য করে হঠাৎ করে টান দিয়ে বের হয়ে অন্য লেন ঢুকে পড়েছেন কিংবা রং রুট বা উল্টা পথে চলেছেন।
তিনি বলেন, ঢাকায় শুধু ২২ লাখ রেজিস্টার্ড গাড়ি চলে। এর বাইরে অনিবন্ধিত গাড়ি আছে। ঢাকার বাইরে থেকেও আসে। সব গাড়ি রাস্তায় নামলে ট্রাফিক শৃঙ্খলা রক্ষা করাটা কঠিন হয়ে যায়। সচেতনতার বিকল্প নেই। সঙ্গত কারণে এই ভিডিও মামলার কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু ভিডিও মামলার কার্যক্রম পরিচালনায় বেশ কিছু সমস্যাও আছে।
সমস্যা সম্পর্কে আবু রায়হান মুহাম্মদ সালেহ্ বলেন, যে গাড়ির বিপরীতে মামলা দেব সেটার মালিকের তথ্য লাগবে। সেটার জন্য বিআরটিএর দ্বারস্থ হতে হয়। অর্থাৎ প্রতি ভিডিও মামলার জন্য আলাদা করে বিআরটিএর সহযোগিতায় তথ্য নিতে হয়। এটা একটা ভয়াবহ জটিলতা। এজন্য আমরা বিআরটিএর সার্ভারের একসেস চেয়েছি। সেটা নিয়ে পুলিশ সদর দপ্তর ও আন্তঃমন্ত্রণালয় কাজ করছে। আশা করি, সহসা এটার সমাধান হবে।
তিনি বলেন,মামলার সিদ্ধান্ত হলে মালিক বা চালকের ঠিকানায় কোন পদ্ধতিতে আমরা ডকুমেন্ট পাঠাব, কীভাবে পাঠাব, সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো নির্দেশনা নেই। অভিযুক্ত ব্যক্তি তো অস্বীকারও করতে পারেন অথবা চিঠির জবাবেরও মেয়াদ থাকবে। সেজন্য আমরা ডাক বিভাগের সঙ্গে বৈঠক করেছি। ডাক বিভাগ মামলার নথি পাঠালে সেটার রিসিভ কপি সংগ্রহে রাখবেন। ওই চিঠি যেন ট্রেস করা যায় সেটারও ব্যবস্থা রাখা। আবার সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ ও সড়ক পরিবহন বিধিমালা-২০২২ মোতাবেক মামলাটা সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। সেজন্য জনবলকে ভিডিও মামলা পদ্ধতি সম্পর্কে যেমন এক্সপার্ট হতে হবে, তেমনি আইন ও বিধি সম্পর্কেও এক্সপার্ট হতে হবে। সামগ্রিক বিবেচনায় এই ভিডিও মামলা কার্যক্রম শুরু হতে আরও সময় লাগবে। আমাদের পাঁচ শতাধিক ভিডিও মামলার ডকুমেন্ট সংগ্রহ করেছি। সমস্যাগুলো সমাধান হয়ে গেলে একটা একটা করে বিশ্লেষণ করে মামলা দায়ের করা হবে।
ডিএমপি সদর দপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক-অ্যাডমিন অ্যান্ড রিসার্চ) ঢাকা রোড সেফটি প্রজেক্টের প্রজেক্ট ম্যানেজার মো. জাহাঙ্গীর আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঢাকা শহরে ৩৪০টা ইন্টার সেকশন। এর মধ্যে ৮০টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, ১১০টা গুরুত্বপূর্ণ আর বাকিগুলো সাধারণ। ট্রাফিক সদস্যরা সেখানে কাজ করছেন। ভিডিও মামলার কার্যক্রম পরিচালনায় বেশ কিছু সমস্যা হচ্ছে। সেগুলো সমাধানের চেষ্টাও চলছে। আপাতত ভিডিও সংগ্রহ করা হলেও মামলা হয়নি একটিও।
জেইউ/এসকেডি