৯ বছর পর সমাপ্ত হলো স্বপ্নের পদ্মা সেতু প্রকল্পের পুরো কাজ
পদ্মার বুকে তৈরি হওয়া সেতু দিয়ে প্রতিদিন পারাপার হন বহু মানুষ। দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন এনে দেওয়া এই সেতু এখন একটি পর্যটন স্থানও। আর্থিক, প্রকৌশল এবং রাজনৈতিক ত্রিমুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে ২০২২ সালে দীর্ঘতম সেতুটি উদ্বোধন করার সঙ্গে সঙ্গে বহুদিনের স্বপ্ন পূরণ হয় বাংলাদেশের। এ সেতুর জন্য বহুকাল অপেক্ষায় ছিল পদ্মার দুই পারের মানুষসহ সমগ্র দেশবাসী।
২০২২ সালের ২৫ জুন পদ্মা সেতু দিয়ে সড়কপথে বাংলাদেশে যোগাযোগের নতুন অধ্যায় শুরু হয়। এরপর ২০২৩ সালে সালে চালু করা হয় রেলপথ। এবার সব প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে স্বপ্নের এ সেতুর প্রকল্পের কাজের সমাপনী ঘোষণা করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আজ (শুক্রবার) দুপুর ৩টায় মাওয়া উত্তর থানা এলাকায় এক সুধী সমাবেশের মধ্য দিয়ে সেতু প্রকল্পের কাজ পুরোপুরি সমাপ্ত ঘোষণা করা হবে। দেশের দীর্ঘতম এ সেতুর তৈরিতে অনেক বাধা-বিপত্তি পার করতে হয়েছে। এ সেতু প্রকল্প পুরোটাই হয়েছে বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে।
বিশ্ব ব্যাংকসহ চারটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের ঋণের ওপর ভর করে ২০১১ সালের জানুয়ারিতে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প চূড়ান্ত করে আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু নানা অনিয়ম আর দুর্নীতির কথা বলে এ প্রকল্প থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় সংস্থাগুলো। পরে বঙ্গবন্ধুকন্যা সিদ্ধান্ত নেন নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু করবেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০১৪ সালের নভেম্বরের শেষের দিকে সেতুর কাজ শুরু হয়।
মূলত ২০১২ সালে পদ্মা সেতু নির্মাণে প্রচুর দুর্নীতি হচ্ছে বলে বিশ্বব্যাংক অভিযোগ করে যদিও বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু নির্মাণে ১.২ বিলিয়ন মার্কিনি ডলার সাহায্য দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
দুর্নীতির সাথে জড়িত হিসেবে সন্দেহজনক সব সরকারি কর্মকর্তাদের অবিলম্বে ছুটিতে না পাঠালে বিশ্বব্যাংক সব সাহায্য বন্ধ করার হুমকিও দেয়। বিব্রত বাংলাদেশ সরকার সাথে সাথেই ‘সন্দেহজনক’ সব সরকারি কর্মকর্তাদের ছুটিতে পাঠালেও বিশ্বব্যাংক প্রতিশ্রুত ১.২ বিলিয়ন ডলার সাহায্য ফিরিয়ে নেয়।
আরও পড়ুন
পাঁচ বছর পর কানাডার আদালতের রায়ে পদ্মা সেতুর সাথে জড়িত সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ গ্রহণের সব অভিযোগই মিথ্যা প্রমাণিত হয় এবং নির্মাণ সহযোগী কোম্পানি এস,এন,সি, লাভালিনের তিন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাদেরও পূর্বের ‘ঘুষ প্রদানের অভিযোগ’ থেকে মুক্ত দেওয়া হয়।
এককথায় অসীম ক্ষমতাশালী বিশ্বব্যাংকের সাথে ‘পদ্মা সেতু’ প্রশ্নে বাংলাদেশের বিজয়ও অনেকটা দাভিদ ও গলিয়াথের লড়াইকেই মনে করিয়ে দেয়।
সাত বছরের নির্মাণ কাজ শেষে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতু গত ২৫ জুন উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরদিন ২৬ জুন রোববার সকালে যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয় পদ্মার বিশাল জলরাশির উপর নির্মিত সেতুটি। যেটি দক্ষিণ জনপদের ২১ জেলার সঙ্গে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত করে।
পদ্মা সেতুর কারণে বদলে গেছে গোপালগঞ্জের চিত্র
পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর থেকে এ জেলার মানুষ অর্থনৈতিকভাবে আরও সমৃদ্ধশালী হচ্ছে। সহজ হয়েছে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের সঙ্গে গোপালগঞ্জ জেলার যোগাযোগ ব্যবস্থা। পিছিয়ে পড়া এই জেলা ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আরও মনোযোগ বাড়িয়েছে, গড়ে উঠছে নতুন নতুন শিল্প কলকারখানা। অর্থনীতির চাকা ঘোরার পাশাপাশি বাড়ছে বেকারদের কর্মসংস্থান।
পদ্মা সেতু শুধু যোগাযোগব্যবস্থা সহজ করছে না, এতে শিক্ষা, কৃষি, মৎস্য, জরুরি স্বাস্থ্যসেবা ও শিল্প পর্যটনসহ বেশ কিছু খাতে অর্থনৈতিক উপযোগও সৃষ্টি হচ্ছে।
বদলে দিয়েছে বাগেরহাটের অর্থনীতি-জীবনযাত্রা
পদ্মা সেতু উন্মুক্ত হওয়ার পর পাল্টে গেছে দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতির চিত্র, মানুষের জীবনযাত্রার ধরন। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার মধ্যে অন্যতম বাগেরহাট।
এই জেলায় বেড়েছে পর্যটক, কর্মসংস্থান। এছাড়া মোংলা বন্দর দিয়ে গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানি হয়েছে, কৃষি খাতেও এসেছে আমূল পরিবর্তন। কৃষকের ফসল পচে যায় না আর দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া কিংবা শরীয়তপুর-জাজিরা ঘাটে। অসুস্থ ব্যক্তিদের নিয়ে আর অপেক্ষা করতে হয় না ফেরির জন্য। এই পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর থেকে স্বস্তির হাসিতে হাসছে সাধারণ মানুষ।
মাদারীপুরে গড়ে উঠেছে অসংখ্য মিল-কারখানা
শিল্প বাণিজ্যে অভাবনীয় পরিবর্তন এসেছে মাদারীপুর জেলায়। যে জেলার মানুষদের কাজের জন্য যেত হতো রাজধানীতে। তারা এখন যোগাযোগ ব্যবস্থায় উন্নতি হওয়ার ফলে নিজ জেলায় কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারছেন। এসব কিছুর মূলে রয়েছে পদ্মা বহুমূখী সেতু। জেলায় বাণিজ্যিকভাবে গড়ে উঠেছে অসংখ্য মিল ও কারখানা যা এ দক্ষিণ অঞ্চলে শিল্প ও বাণিজ্যের অপার সম্ভাবনার নতুন দুয়ার খুলেছে।
২০২২ সালের ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর বদলে গেছে মাদারীপুরের অর্থনীতির চিত্র। এখানে মিল কারখানাসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক কারখানা হয়েছে। এ অঞ্চলে পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর থেকে গবাদি পশুর খামার, হাঁস মুরগির খামার, আইসক্রিম ফ্যাক্টরি, মিল কারখানা, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, উন্নতমানের বেসরকারি হাসপাতাল এবং স্কুল-মাদরাসা নির্মাণ হচ্ছে।
এদিকে পদ্মা সেতু চালুর পর মাদারীপুর জেলাজুড়ে ৮০ থেকে ৯০টির মতো গড়ে উঠেছে রাইস মিল। ১০ থেকে ২০টির মতো কল-কারখানা গড়ে উঠেছে, ১৫০ থেকে ২০০টির মতো গড়ে উঠেছে বেসরকারি হাসপাতালসহ ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ৩০০ থেকে ৫০০টির মতো গড়ে উঠেছে গরু-ছাগলসহ হাস-মুরগির খামার, ৪০ থেকে ৫০ জনের মতো হয়েছে নতুন উদ্যোক্তা।
পদ্মা সেতুতে ১৫০০ কোটি টাকা টোল আদায়ের মাইলফলক
এদিকে পদ্মা সেতু চালুর পর ২২ মাসে দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি টোল আদায় করা হয়েছে। গত ২৭ এপ্রিল রাত ১২টায় এ টোল আদায়ের মাইলফলক অর্জিত হয়েছে।
সেতু কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, চলতি মাসের ৯ এপ্রিল ঈদুল ফিতরের ছুটিতে পদ্মা সেতুতে একদিনে সর্বোচ্চ ৪ কোটি ৮৯ লাখ ৯৪ হাজার ৭০০ টাকা টোল আদায় হয়েছে। ওই দিন দুই প্রান্ত দিয়ে ৪৫ হাজার ২০৪টি গাড়ি পারাপার হয়।
পদ্মা সেতুর সমাপনী অনুষ্ঠান আজ : ব্যয় ৫ কোটির বেশি
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে ৫ জুলাই (শুক্রবার) পদ্মা বহুমুখী সেতুর সমাপনী অনুষ্ঠান হবে। এজন্য ব্যয় ধরা হয়েছে পাঁচ কোটি টাকার উপরে।
এ প্রসঙ্গে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সমন্বয় ও সংস্কার সচিব মো. মাহমুদুল হোসাইন খান সাংবাদিকদের জানান, আমরা সবাই জানি ২০২২ সালের ২৫ জুন আমাদের গর্বের, অহংকারের পদ্মা সেতু যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। এই পদ্মা বহুমুখী সেতুর নির্মাণের মেয়াদ ২০২৪ সালের ৩০ জুন শেষ হয়েছে। এই সমাপ্তি উপলক্ষ্যে মাওয়া প্রান্তে একটা সুধী সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। এই সুধী সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী থাকার সম্মতি জ্ঞাপন করেছেন।
তিনি আরও বলেন, গত দুই বছরে পদ্মা সেতু দিয়ে ১ কোটি ২৭ লাখ যানবাহন চলাচল করেছে। ২৯ জুন পর্যন্ত রাজস্ব আদায় হয়েছে ১ হাজার ৬৬১ কোটি টাকা। প্রতিদিন গড়ে যান চলাচল করেছে প্রায় ১৯ হাজার। প্রতিদিন গড়ে টোল আদায় হয়েছে ২ কোটি ৩০ লাখ টাকা।
পদ্মা সেতুর আদ্যোপ্যান্ত
পদ্মা সেতুর প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা হয় বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে ১৯৯৮-১৯৯৯ সময়ে। ২০০৩-০৫ সময়ে নিজস্ব অর্থায়নে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা সম্পন্ন করে জাপানের জাইকা। ২০০৬ সালে ভূমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন ও পরিবেশ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে পরিকল্পনা করা হয় বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে। ২০০৯-১১ সময়ে বিস্তারিত নকশা প্রণয়ন করা হয়। নিউজিল্যান্ডভিত্তিক মনসেল এইকম সেতুর পূর্ণাঙ্গ নকশা তৈরি করে। জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু হয়। এর জন্য অর্থায়ন করে এডিবি ও বাংলাদেশ সরকার।
২০১২ সালের জুনে বিশ্বব্যাংক তাদের ঋণ বাতিল করে। একই বছরের জুলাইয়ে বাংলাদেশ সরকার নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। ২০১৪ সালের ১৭ জুন মূল সেতু নির্মাণ কাজের জন্য চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি হয়। ওই বছরের ২৬ নভেম্বর সেতুর মূল নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুন্সিগঞ্জের মাওয়ায় বহুল প্রত্যাশিত পদ্মা সেতুর কাজ উদ্বোধন করেন।
এরপর ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর সেতুর প্রথম স্প্যান বসানো হয়। ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর শেষ স্প্যান বসানো হয়। আর ২০২২ সালের ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরের দিন ২৬ জুন পদ্মা সেতু দিয়ে যানচলাচল শুরু হয়।
পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। মূল সেতুর কাজ করেছে চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড। মূল সেতুর দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। এর অ্যাপ্রোচ সড়ক ১২ দশমিক ১১৭ কিলোমিটার। ভায়াডাক্ট ৩ দশমিক ১৪৮ কিলোমিটার (সড়ক) এবং ৫৩২ মিটার (রেল)।
পদ্মা সেতু সংলগ্ন নদী শাসন কাজের উদ্দেশ্যে চূড়ান্ত দরপত্র গ্রহণ করা হয় ২০১৪ সালের ১৯ জুন। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সুপারিশে ওই বছরের ১০ সেপ্টেম্বর সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্পের নদী শাসন কাজের জন্য চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিনোহাইড্রো করপোরেশনকে নিয়োগ সংক্রান্ত প্রস্তাবটি অনুমোদিত হয়।
প্রস্তাবটি অনুমোদনের পর সিনোহাইড্রো কর্পোরেশনের সঙ্গে ২০১৪ সালের ১০ নভেম্বর ৪৮ মাসের মধ্যে নির্মাণ কাজ সম্পন্নের লক্ষ্যে চুক্তিপত্র সই হয়। যার চুক্তিমূল্য ৮ হাজার ৭০৭ কোটি ৮১ লাখ ৪১ হাজার ৪৪৬ টাকা। পরে কয়েক দফায় বাড়ানো হয় সময়। এই কাজ তদারকির জন্য কন্সট্রাকশন সুপারভিশন কনসালটেন্ট হিসেবে কোরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে কর্পোরেশন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস নিয়োজিত রয়েছে।
পদ্মা সেতু দিয়ে যানবাহান চলাচল শুরু হওয়ার পর গত বছরের সেপ্টেম্বরে পদ্মা বহুমুখী সেতুর নদী শাসনের ব্যয় ৮৭৭ কোটি ৫৩ লাখ ৫১ হাজার ৫৫৩ টাকা বাড়ানো হয়। এতে ভ্যাট ও ট্যাক্সসহ পদ্মা সেতুর নদী শাসনের ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৯ হাজার ৫৮৫ কোটি ৩৪ লাখ ৯৩ হাজার টাকা। এখন দ্বিতীয় দফায় পদ্মা সেতুর নদী শাসনের ব্যয় ২৪৯ কোটি ৪২ লাখ ৫২ হাজার ৩৪৯ টাকা বাড়ানো হলো। এতে মোট ব্যয় বেড়ে দাঁড়ালো ৯ হাজার ৮৩৪ কোটি ৭৭ লাখ ৪৫ হাজার ৩৪৯ টাকা।
এমজে