ভাড়াটিয়ারা অসহায়
মাসের আজ ৪ তারিখ, বাসার মালিক এসে বলে গেছেন আগামী ৭ তারিখের মধ্যে বাসা ভাড়া পরিশোধ করতে। কিন্তু আমার কাছে তো ভাড়া পরিশোধের টাকা নেই। করোনাকালে সবার আয়-রোজগার কম হওয়ায় কারও কাছ থেকে ধার নেওয়ার তেমন সুযোগ নেই। গত মাসের বাড়ি ভাড়াও কিছুটা বাকি আছে। তাই বাসার মালিক বলেছেন, এবার সঠিক সময়ে বাসা ভাড়া দিতে না পারলে বাসা ছেড়ে দিতে।
কথাগুলো বলছিলেন রাজধানীর বাড্ডা এলাকার একটি কাপড়ের দোকানের কর্মচারী জাহিদুর রহমান। লকডাউন বা সরকার আরোপিত বিধিনিষেধের কারণে প্রথম অবস্থায় দোকান বন্ধ থাকায় তিনি তার পরিপূর্ণ বেতন পাননি। এরই মধ্যে শুরু হয়েছে নতুন মাস। বাসা ভাড়া পরিশোধ করতে জাহিদুর রহমান তাই পরিচিতদের কাছে টাকা ধার চাচ্ছেন। যাদের কাছে ধার চাচ্ছেন তারাও আছেন সমস্যায়। এখন বাসা ভাড়া পরিশোধের চিন্তায় অস্থির জাহিদুর।
জাহিদুর রহমান বলেন, চলছে রমজান মাস। সংযমের মাসে লাগাম ছিঁড়েছে পণ্যের দাম। সামান্য যা জমানো টাকা ছিল সব শেষ। লকডাউনের কারণে দোকান বন্ধ থাকায় পুরো বেতন পাইনি। সামনে ঈদ আসছে, এখন কী খাব, আর কীভাবে চলব এই নিয়েই দুঃশ্চিন্তায় আছি।
হাতে কোনো টাকা নেই। এরমধ্যে নতুন মাসের বাসা ভাড়া পরিশোধের সময় এসে গেছে জানিয়ে তিনি বলেন, এখন কীভাবে বাসা ভাড়া পরিশোধ করব সেই টেনশনেই ঘুমাতে পারি না। বাসার মালিক বলেছেন, সময়মতো টাকা দিতে না পারলে বাসা ছেড়ে দিতে হবে।
এ সমস্যা শুধু জাহিদুর রহমানের না। লকডাউনে কর্মহীন হয়ে পড়া বা আয় রোজগার কম হওয়া রাজধানীর নিম্ন ও মধ্যআয়ের বেশিরভাগ মানুষেরই। করোনা প্রাদুর্ভাবের পর থেকে দেশের প্রত্যেকটি খাত চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আবার অনেক প্রতিষ্ঠান টিকে থাকতে শ্রমিক ছাঁটাইসহ নানামুখী কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কমেছে সাধারণ মানুষের আয়। মহামারির এ সময়ে দেশে নতুন করে আরও দেড় কোটি মানুষ দরিদ্র হয়েছে বলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) যৌথ গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।
গত ১৭ এপ্রিল আয়োজিত ওয়েবিনারে সিপিডির গবেষণা বিষয়ক পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম এসব তথ্য উপস্থাপন করেন। গবেষণাপত্রে খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, করোনা দুর্যোগের সময় ৩ শতাংশ শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। শহর অঞ্চলে ইনফরমাল ইকোনোমি থেকে ৬.৭৮ শতাংশ মানুষ কর্মসংস্থান হারিয়েছেন। এছাড়া উচ্চ পর্যায়েও অনেক মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাকরি হারিয়েছেন এসএমই ও ইনফরমাল সেক্টর থেকে।
রাজধানীতে চলাচলকারী ভেক্টর বাসে হেল্পার হিসেবে কাজ করেন শহিদুল ইসলাম। সরকার আরোপিত বিধিনিষেধের কারণে গণপরিবহন বাস চলাচল করছে না। বেশ কিছুদিন ধরে, এ অবস্থায় তিনি পুরোপুরি বেকার অবস্থায় আছেন। তিনি বলেন, কাজ করলে বেতন, না করলে নেই- এই অবস্থার মধ্যে লকডাউন শুরু হওয়ায় মোটামুটি বেকার অবস্থায় আছি। কোনো ধরনের আয়-রোজগার নেই। খেয়ে, না খেয়ে পরিবার নিয়ে কোনোমতে দিন কাটাচ্ছি। এর মধ্যে নতুন মাস শুরু হয়েছে, বাসা মালিক মাসের ভাড়া চাচ্ছে। কিন্তু কীভাবে ভাড়া পরিশোধ করব তার কোনো দিক খুঁজে পাচ্ছি না। হাতে কোনো টাকা নেই, আমার মতো যারা বেকার অবস্থায় আছে, তারা খাচ্ছে কী, চলছে কীভাবে তা নিয়ে কারও কোনো মাথা ব্যথা নেই। আমাদের জন্যও কোনো বাসা মালিকই বাসা ভাড়া মওকুফ করা তো দূরের কথা সামান্য ভাড়াও কমায়নি। বেকার থেকে এই নতুন মাসে কীভাবে বাসা ভাড়া পরিশোধ করব তা জানি না। এদিকে বাসার মালিক জানিয়েছে ভাড়া দিতে না পারলে বাসা ছেড়ে দিতে হবে।
তিনি বলেন, ঘরে এক সন্তান আর স্ত্রী রয়েছে। গ্রামের বাড়িতেও টাকা পাঠাতে হয়। এ অবস্থায় কী করব, কীভাবে চলব তার কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছি না।
ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত ২৫ বছরে রাজধানীতে বাড়িভাড়া বেড়েছে প্রায় ৪০০ শতাংশ। একই সময়ে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে ২০০ শতাংশ। অর্থাৎ এ সময়ে নিত্যপণ্যের দামের তুলনায় বাড়িভাড়া বৃদ্ধির হার দ্বিগুণ।
সংগঠনটির অন্য এক পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকার ২৭ শতাংশ ভাড়াটিয়া আয়ের প্রায় ৩০ শতাংশ, ৫৭ শতাংশ ভাড়াটিয়া প্রায় ৫০ শতাংশ, ১২ শতাংশ ভাড়াটিয়া আয়ের প্রায় ৭৫ শতাংশ টাকা ব্যয় করেন তাদের বাসা ভাড়া পরিশোধে।
বেকার, ভাগ্যান্বেষী, বিদ্যান্বেষীসহ নানা শ্রেণির মানুষের ‘স্বপ্ন গড়ার শহর’ এই ঢাকা। সেজন্য দিন দিন এই নগরে মানুষ বাড়ছিল জ্যামিতিক হারে। কিন্তু গত বছর মার্চে দেশে করোনাভাইরাস হানা দেওয়ার পর সেই মানুষদের মধ্যে অনেকের স্বপ্ন ভাঙতে শুরু করে। সেসময় আয় রোজগার কমে এমনকি কর্ম হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েন নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের অনেক মানুষ। সে সময়ের হোঁচট খাওয়া এসব মানুষ যখন নানাভাবে পরিশ্রম করে কেবল ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে তখনই আবার এলো করোনা।
লকডাউনে কর্ম হারিয়ে, আয়ের পথ বন্ধ হয়ে এখন অনেকেই ফের হতদরিদ্র হয়ে পড়েছেন। এরমধ্যে বাড়ি ভাড়া পরিশোধের চিন্তায় অনেকেই দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। প্রায় ১ হাজার ৪৬৩ দশমিক ৬০ বর্গকিলোমিটারের এই ঢাকায় বাস করতে হয় প্রায় দুই কোটি মানুষকে। তাই মানুষকে উচ্চ ভাড়ায়, বলতে গেলে বেতনের বা আয়ের সিংহভাগ টাকা দিয়ে ভাড়া বাসায় থাকতে হয় তাদের। এখানে অতিরিক্ত বাসা ভাড়ার খড়্গ মানুষকে অর্থনৈতিক নির্যাতনের মুখে ফেলছে প্রতিনিয়ত।
রাজধানীর মিরপুর শেওড়াপাড়া এলাকার এক বাড়ির মালিক নাসির আহমেদ বলেন, বাসা বানানোর জন্য লোন করে, ধারদেনা করে, সারা জীবনের আয় দিয়ে অথবা অন্য কোনো সম্পদ বিক্রি করে একজন বাড়িওয়ালা তার স্বপ্নের একটি বাড়ি নির্মাণ করে। তার আয়ের উৎস এই বাড়িটিই। এছাড়া পরিষেবার নানান বিল, সংস্কারকাজ প্রতিনিয়তই লেগে থাকে। এখানকার আয় দিয়েই তার সংসার চলে, তাহলে একজন বাড়ির মালিক কীভাবে তার ভাড়াটিয়াদের জন্য মাসিক ভাড়ায় ছাড় দেবে? আর এলাকা অনুযায়ী অন্যান্য বাড়ির সঙ্গে তুলনা করে বাড়ি ভাড়ার পরিমাণ নির্ধারণ হয়। সেখানে তুলনামূলক কম ভাড়া নেওয়ার সুযোগ থাকে না। সেক্ষেত্রেও সমিতির অন্য সদস্যদের তোপের মুখে পড়তে হয়। সব মিলিয়ে বাড়ির মালিকরাও কিন্তু ভালো নেই।
এ বিষয়ে ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি মো. বাহারানে সুলতান বাহার ঢাকা পোস্টকে বলেন, লকডাউনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দোকান ও কর্ম হারিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ভাড়াটিয়াদের দোকান ভাড়া ও বাড়ি ভাড়া মওকুফে দাবি সরকার ও বাড়িওয়ালাদের কাছে বারবার আমরা জানিয়ে আসছি। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হচ্ছে না। বাড়ির মালিকরা কতটা নির্দয় হলে এই অবস্থায় ভাড়াটিয়াদের কোনো ধরনের ছাড় না দিয়ে থাকতে পারে সেটা আমাদের প্রশ্ন। গত বছর লকডাউনের ফলে কী রকম মানবিক সংকট সৃষ্টি হয়েছিল তা আমরা সকলে দেখেছি। সেই লকডাউনে অনেক চাকরি হারিয়ে এখনও চাকরি পাননি। অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। আগের লকডাউনের ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার আগেই পুনরায় লকডাউনের ফলে দেশের নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণি নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। ঢাকাসহ সারাদেশের ভাড়াটিয়ারা আজ নির্যাতিত-নিপীড়িত। তবুও কিছুই না মেনে বাড়ির মালিকরা যা ইচ্ছে তাই করছেন।
তিনি বলেন, ভাড়াটিয়াদের চরম দুর্দশা বিবেচনা করে বাড়ি মালিকদের সহৃদয়শীল হওয়া উচিত। করোনাকালে অনেকে চাকরি ও কাজ হারিয়ে নিজ এলাকায় চলে গিয়েছিল। তাদের অনেকে ফের ফিরে এসেছে। তাদের অনেকেই অল্প আয়ের কাজ করে কোনোভাবে দিন কাটাচ্ছে, অনেকে বাড়ি ভাড়া পরিশোধ করতে চাপে পড়ে যাচ্ছেন। এই অবস্থায় বাড়ির মালিকরা ভাড়াটিয়াদের বাড়ি ও দোকান ভাড়ার জন্য চাপ দিয়ে টাকার জন্য নানা হয়রানি করছেন। বাড়ি ছেড়ে দেওয়ারও হুমকিও দিচ্ছেন। এ বিষয়ে সকলেরই একটু মানবিক হওয়া উচিত। অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো আমাদের সবার নৈতিক দায়িত্ব।
সাধারণ নাগরিক পরিষদের আহ্বায়ক মহিউদ্দিন আহমেদ এ বিষয়ে ঢাকা পোস্টকে বলেন, মানুষ কতটা নির্দয় হলে এ অবস্থায় নিম্ন আয়ের ভাড়াটিয়াদের এভাবে চাপ প্রয়োগ করতে পারে এটা ভেবে আমরা বিস্মিত হই। অসহায় মানুষরা কর্ম হারিয়ে, আয়ের পথ হারিয়া অমানবিক জীবন যাপন করছে, তাদের হাতে টাকা নেই অথচ বাড়ির মালিকরা কোনো ছাড়ই দিচ্ছে না। আমরা সকলেই যদি নিজ নিজ জায়গা থেকে মানবিক বা ছাড় দেওয়ার মানসিকতা তৈরি করতে না পারি, তাহলে এই সঙ্কট আরও বাড়বে। ভাড়াটিয়ারও আরও বেশি অসহায় হয়ে পড়বে। অনেকেই উপায়ন্তর না পেয়ে এই শহর ছেড়ে যেতে বাধ্য হবে। আমাদের কাছে এমনও অভিযোগ আছে, এই সময়ও অনেক বাড়ির মালিকরা বাসা ভাড়া বৃদ্ধি জন্য ভাড়াটিয়াদের জানিয়েছে। কতটা অমানবিক হলে এমন করা যায়। এমনিতেই ঢাকা শহরে মানুষদের বেতনের বা আয়ের সিংহভাগই দিয়ে দিতে হয়ে বাড়ি ভাড়া পরিশোধেই। কিন্তু এই বিপদের সময় ঢাকা শহরের বাড়ি মালিকরা সামান্য ছাড় দেওয়ার মানসিকতা সৃষ্টি হলেই ভাড়াটিয়ারা তাদের জীবন-জীবিকার সংগ্রাম চালিয়ে যেতে পারে। প্রতিটি বাড়ির মালিকের কাছে আমাদের আবেদন, তারা যেন এই মহামারির সময় কিছুটা হলেও মানবিকতার পরিচয় দেন।
এএসএস/এইচকে