বাস কাউন্টারে মায়ের আকস্মিক মৃত্যুতে কান্না থামছিল না শিশুর
রাজধানীর টেকনিক্যাল মোড়ে শাহজাদপুর পরিবহনের কাউন্টারে এক নারীর আকস্মিক মৃত্যু হয়। সেই নারীর সঙ্গে ছিল তার ছোট শিশুকন্যা। মায়ের মৃত্যুতে কিছু বুঝে উঠতে না পেরে মরদেহের পাশে বসে কাঁদতে থাকে সে। পরে মুহূর্তেই এ সংক্রান্ত একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়।
রোববার (১৬ জুন) রাত পৌনে আটটার দিকে হৃদয়বিদারক এই ঘটনা ঘটে।
মূূলত, সৈয়দ রিয়াদ নামে একজন তার ফেসবুকে এ সংক্রান্ত একটি পোস্ট দেন। পোস্টে তিনি লেখেন, ‘নিয়তি এমন নির্মম কেন বলতে পারেন? নিজের মেয়েদের মুখ ভেসে উঠছে বারবার! তার নিষ্পাপ চেহারার দিকে তাকিয়ে বুক কেঁপে উঠছে, আহা আমার আপনার কন্যার যদি এমন হয়? ঢাকার টেকনিক্যাল মোড়ে শাহজাদপুর ট্রাভেলসের
কাউন্টারে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে এই মেয়েটির মা মারা যায়। মেয়েটির নাম ইশা, আর তার বোনের নাম তিশা। মেয়েটি বলছে তার বাবার নাম কামাল, চাচার নাম জিসান, বাড়ি পাবনায়। দ্রুত শেয়ার করে মেয়েটির আপনজনকে খুঁজে পেতে সহযোগিতা করুন প্লিজ। আমাদের রিপোর্টার ভাইয়েরা চাটমোহর পরিচিত কেউ থাকলে ফোন করেন একটু। সহ্য করা যাচ্ছে না। বুক ফেটে যাচ্ছে।’
আরও পড়ুন
ফেসবুকে দেওয়া পোস্টে সাংবাদিক জাকিয়া আহমেদ লেখেন, ‘কাল থেকে সবাই এই ঘটনায় উদ্বিগ্ন ছিলেন, এখনো অনেকেই আছেন। আমি রাত আড়াইটায় এটা দেখার পর প্রথমে বাস কাউন্টার যাই, গিয়ে শুনি দারুসসালাম থানায় আছে মেয়েটি। থানায় যাই এরপর। সেখানেই গিয়েই দেখতে পাই মেয়েটার চারপাশে চিপসসহ আরও কিছু খাবার, কিন্তু মেয়েটা ঘুমিয়ে আছে। থানার ডিউটি অফিসার তার নিজের স্ট্যান্ডফ্যান সোফার দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছেন। মেয়েটার দায়িত্বে ছিলেন এসআই সুমীসহ আরও একজন ফিমেল কন্সটেলেবল।’
‘পুলিশের যে গ্রুপটি বাস কাউন্টার থেকে ওদের নিয়ে এসেছেন, তাদের একজন জানালেন, মেয়েটার মায়ের মুখ চাদর দিয়ে ঢেকে দেবার পরেও মেয়েটা চাদর সরিয়ে দিচ্ছিল বারবার, ঢাকতে দিচ্ছিল না। আর চাদর সরিয়েই সে হাতে থাকা পানির বোতল থেকে পানি নিয়ে মায়ের মুখে ছিটিয়ে দিচ্ছিল, মায়ের বুক ছাড়া সরতে চাচ্ছিল না।
থানায় নিয়ে আসার পরেও ফ্লোরে গড়াগড়ি দিয়ে মায়ের জন্য কাঁদছিল, কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী মায়ের পোস্ট মর্টেম করার জন্য তাকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছিল। আমি পৌঁছানোর কিছুক্ষণ আগেই অনেক কষ্টে তাকে ঘুম পাড়ানো হয়েছে। মায়ের সাথে থাকা কয়েকটি নম্বরে থানা থেকে যোগাযোগ করা হলে সেগুলো বন্ধ পাওয়া যায়।’
‘ডিউটি অফিসার আমাকে বললেন, কাল (আজ) খোঁজ করা হবে সব জায়গায় আরও ভালো করে। মেয়েটা তাদের কিছুই জানাতে পারেনি, কারণ সে ভয়াবহভাবে ট্রমাটাইজড ছিল। আমি প্রায় এক ঘণ্টার মতো থেকে চলে আসি, বলে এসেছিলাম খোজ পেলে বা না পেলেও আমাকে জানাতে। কিছুক্ষণ আগে জানলাম, মেয়েটার খালা এসেছেন থানায়, এখন পুলিশ ভেরিফিকেশনসহ অন্যান্য প্রক্রিয়া শেষ করে মেয়েটাকে হ্যান্ডওভার করে দেবেন তারা। আল্লাহ ওর সহায় হোন।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাস কাউন্টারে মারা যাওয়া ওই নারীর নাম রুনা আক্তার। তার বাড়ি পাবনার ভাঙ্গুড়া থানা এলাকায়। রুনা আক্তার তার ছোট মেয়ে ইশাকে নিয়ে রাজধানীর হাজারীবাগ এলাকার একটি বস্তিতে বসবাস করতেন। রুনা আক্তারের স্বামী নেই। গতকাল রোববার সন্ধ্যায় রুনা আক্তার রাজধানীর টেকনিক্যাল মোড়ে শাহজাদপুর পরিবহনের কাউন্টারের যান। ঈদ উপলক্ষ্যে ভাঙ্গুড়ায় মায়ের বাড়িতে যাওয়ার উদ্দেশে মেয়ে ইশাকে নিয়ে বাস কাউন্টারে যান। রাত সাড়ে ৮টায় তাদের বাস পাবনার উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়ার কথা ছিল।
আরও জানা যায়, রাত পৌনে ৮টার দিকে রুনা আক্তার মেয়ে ইশাকে চেয়ারে বসিয়ে বাস কাউন্টারের বাথরুমে যান। বাথরুমে যাওয়ার পর দীর্ঘ সময় পার হয়ে গেলেও রুনা আক্তার বের হননি। রুনা আক্তার বের না হওয়ায় বাথরুমের দরজার সামনে ইশা কান্না করতে থাকে। ইশার কান্না দেখে কাউন্টারের লোকজন বাথরুমের দরজার এসে ধাক্কা দিতে থাকেন। এতেও রুনা আক্তারের সাড়া না পেয়ে কাউন্টারের লোকজন দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে দেখতে পান রুনা আক্তার মৃত অবস্থায় বাথরুমে পড়ে রয়েছেন। কাউন্টারের লোকজন রুনার মরদেহ বাথরুম থেকে বের করে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) দারুস সালাম থানা পুলিশকে খবর দেন। খবরে পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে আসে।
এ বিষয়ে দারুস সালাম থানা সূত্রে জানা যায়, খবর পেয়ে নারী পুলিশ সদস্যসহ পুলিশের একটি দল ঘটনাস্থলে আসে।
এর মধ্যেই মায়ের মরদেহের পাশে বসে ইশার কান্না করার ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। ভাইরাল হওয়া ছবি দৃষ্টিগোচর হলে রুনা আক্তারের বড় মেয়ে তিশা ও বড় বোন প্রথমে টেকনিক্যালের শাহজাদপুর বাস কাউন্টারে আসেন। পরে সেখান থেকে দারুস সালাম থানায় যান। রুনা আক্তারের বড় মেয়ে তিশা রাজধানীর মিরপুর ৬০ ফিট এলাকায় স্বামীকে নিয়ে থাকেন। আর রুনা আক্তারের বড় বোন রূপনগর ইস্টার্ন হাউজিং এলাকায় থাকেন।
এ বিষয়ে দারুসসালাম থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, খবর পেয়ে গতকাল রাতে পুলিশের একটি দল ঘটনাস্থলে যায়। পরে রুনা আক্তারের মরদেহের সুরতহাল করে ময়নাতদন্তের জন্য শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, রুনা আক্তার স্ট্রোক করে মৃত্যুবরণ করেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ ঘটনার ছবি ভাইরাল হলে তা দেখতে পান রুনা আক্তারের বড় বোন ও তার বড় মেয়ে। রুনা আক্তার রাজধানীর হাজারীবাগ বস্তিতে ছোট মেয়েকে নিয়ে থাকতেন। তার বোন থাকে রূপনগর ইস্টার্ন হাউসিং এলাকায় থেকে এসেছেন। আর বড় মেয়ে মিরপুর ৬০ ফিট এলাকা থেকে আসেন। ইশা এখন তার পরিবারের কাছে আছে।
তিনি বলেন, রুনা আক্তার হাজারীবাগ বস্তি এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে রয়েছেন। তার স্বামী নেই। গত দীর্ঘ সময় ধরে রুনা আক্তারের যোগাযোগ ছিল না তার বোন এবং মায়ের সঙ্গে। কিন্তু গতকাল রুনা আক্তার তার বোন এবং মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। তাদের জানান যে, ঈদ উপলক্ষ্যে ছোট মেয়ে ইশাকে নিয়ে পাবনার বাড়িতে যাচ্ছেন। পরে টেকনিক্যাল মোড়ের শাহজাদপুর পরিবহনের বাস কাউন্টারে ইশাকে নিয়ে যান রুনা আক্তার। রোববার রাত পৌনে আটটার দিকে রুনা বাস কাউন্টারের বাথরুমে যান। পরে সেখান থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে কাউন্টার কর্তৃপক্ষ। ঘটনায় একটি ইউডি (আনন্যাচারাল ডেথ) মামলা দায়ের হয়েছে।
এমএসি/কেএ