বাজেটে শিশুদের জন্য বিনিয়োগে প্রাধান্য দেওয়ার পরামর্শ
আসন্ন বাজেটে শিশুদের জন্য বিনিয়োগকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে শিশুদের নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সেভ দ্য চিলড্রেন। একইসঙ্গে সংস্থাটি চলমান জাতীয় বাজেট বরাদ্দ ও বাস্তবায়নের বিশ্লেষণ এবং অংশীজনের মতামতের ভিত্তিতে সরকার এবং নীতিনির্ধারকদের বিবেচনার জন্য শিশুকেন্দ্রিক ৮ দফা সুপারিশগুলো তুলে ধরেছে।
বুধবার (৫ জুন) সেভ দ্য চিলড্রেনের জনসংযোগ বিভাগ থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব সুপারিশ তুলে ধরা হয়।
এতে বলা হয়, যে কোনো দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন নির্ভর করে তার মানব সম্পদের উন্নয়নে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার উপর। এক্ষেত্রে জাতীয় বাজেট একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশে জাতীয় বাজেটের যথাযথ প্রণয়ন এবং প্রয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশের ৬ কোটিরও বেশি শিশুর উন্নয়নে কাজ করা সম্ভব। সরকারি দলের এবারের নির্বাচনী ইশতেহারে, দেশের প্রান্তিক শিশুদের উন্নয়নে সরকার স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং শিশু কেন্দ্রিক উদ্যোগের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র চিহ্নিত করেছে এবং শিশু সুরক্ষা নিশ্চিতকরণে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম উল্লেখ করেছে।
আরও পড়ুন
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সেভ দ্য চিলড্রেন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আমরা বাংলাদেশ সরকারের শিশুকেন্দ্রিক কার্যক্রমগুলোকে সমর্থন জানাই এবং এর ব্যাপ্তি সম্প্রসারণে, কার্যকর বাস্তবায়নে ও নতুন উদ্যোগ গ্রহণে সার্বিক সহযোগিতায় প্রস্তুত।
শিশুকেন্দ্রিক সুপারিশগুলো হলো-
» বাজেটে শিশু প্রতিবেদন যুক্ত করা : জাতীয় বাজেটে শিশুদের জন্য আলাদা বাজেট প্রতিবেদন যুক্ত করা, যাতে করে সংশ্লিষ্ট অংশীজনেরা এই শিশু সম্পর্কিত বাজেট বরাদ্দ ও বাস্তবায়ন সম্পর্কে অবগত থাকতে পারে। এর ফলে শিশুর উন্নয়নে সরকারের আন্তরিকতা ও দায়বদ্ধতা প্রকাশ পাবে।
» শিশু সম্পর্কিত আর্থিক কৌশল প্রণয়ন : বর্তমান আর্থিক পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকার শিশু-বান্ধব কার্যক্রমগুলো বাস্তবায়নের জন্য একটি শিশু বিষয়ক আর্থিক কৌশল প্রণয়ন করতে পারে। এই কৌশল বাস্তবায়নের মাধ্যমে শিশুদের জরুরি প্রয়োজন প্রতিপালনে কিংবা আর্থিক সংকট মোকাবেলায় জরুরি তহবিল গঠন ও কার্যক্রম বাস্তবায়নে সহায়ক হবে।
» শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের বাজেট বাস্তবায়ন : বাজেট বাস্তবায়নে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সম্পর্কিত মন্ত্রণালয় ও এদের অধিদপ্তরগুলো বেশ কিছু বছর ধরেই তাদের জন্য নির্ধারিত বাজেট ব্যবহার করতে পারছে না, যার ফলে শিশু বিষয়ক অনেক উদ্যোগ পিছিয়ে পড়ছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বিভিন্ন খাতে ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে বাজেটের যথাক্রমে ৭৬% এবং ৬১% ব্যয় করেছে, যেখানে সরকারের গড় বাজেট বাস্তবায়ন ছিল ৮৩%। ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে এই খাতের জন্য বরাদ্দ আছে ১১.৪%।
সেভ দ্য চিলড্রেন মনে করে, ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে অষ্টম পাঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুযায়ী উন্নয়ন বাজেটের কমপক্ষে ১৭% শিক্ষা খাতে বরাদ্দ করা ও এর সুষ্ঠু বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা গ্রহণ প্রয়োজন। একইভাবে, স্বাস্থ্য খাতে মোট বাজেটের অন্তত ১১% বরাদ্দ করা জরুরি।
উল্লেখ্য যে, ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে বাজেটের মাত্র ৬.২% এ খাতের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছিল। শিশু কেন্দ্রিক পরিষেবাগুলো সমন্বয় করা ও সেবা-প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে একটি পৃথক শিশু অধিদপ্তরের প্রয়োজনীয়তা এখন সময়ের দাবি।
» শিশু-বান্ধব সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি : সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি কিভাবে আরও শিশু-বান্ধব করা যায় এবং শিশু উন্নয়নে কাজে লাগানো যায়, সে বিষয়ে এই বাজেটে পরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন। শিশুরা যাতে এই কর্মসূচিগুলোর সরাসরি উপকার পেতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। সরকার যেমন প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের প্রোফাইল তৈরি করেছে, তার আদলে অন্য শিশুদের; যেমন, স্কুল-বহির্ভূত শিশু, প্রতিবন্ধী শিশু এবং দুর্গম অঞ্চলের শিশুদের তালিকাভুক্ত করা উচিৎ। এর ফলে উপযুক্ত শিশুরা তাদের চাহিদার ভিত্তিতে বিভিন্ন কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত হতে পারে এবং সুবিধাগুলো পেতে পারে।
» শিশুর উপর জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলা : জলবায়ু সংক্রান্ত যে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব রয়েছে তা মোকাবিলায় শিশুদের সমস্যা চিহ্নিত করে আলাদা বরাদ্দ রাখা জরুরি। কারণ শিশুরাই জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাব দ্বারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং এর প্রভাব সারা জীবন বয়ে বেড়ায়৷ এই বাজেটের আওতায় শহর এলাকার দরিদ্র শিশুর উপর জলবায়ুর প্রভাবগুলো চিহ্নিত করে তা মোকাবিলায় বাজেটে বরাদ্দ রাখা জরুরি।
» পুষ্টি বিবেচনায় খাদ্যে বৈচিত্র্য আনা : সাম্প্রতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে, পুষ্টি-সংক্রান্ত কর্মসূচিতে সরকারের আরও বিনিয়োগ প্রয়োজন। এছাড়াও, দরিদ্র পরিবারের শিশুরা যাতে প্রয়োজনীয় পুষ্টি ও সেবার আওতায় আসতে পারে, সেদিক বিবেচনা করে শিশুর প্রারম্ভিক যত্ন এবং উন্নয়ন কর্মসূচিগুলোর লক্ষ্যমাত্রা এবং তহবিল বরাদ্দ করা প্রয়োজন।
» শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যে মনোনিবেশ করা : প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, কমিউনিটি পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা, এবং শিশুদের জন্য কমিউনিটি-ভিত্তিক মানসিক স্বাস্থ্য এবং মনোসামাজিক সহায়তা প্রোগ্রামগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ নির্ধারণ করা জরুরি৷
» প্রান্তিক শিশুর সহায়তায় লোকবল নিয়োগ : কমিউনিটি পর্যায়ে শিক্ষক, শিশু সুরক্ষা কর্মী, শিশু বিশেষজ্ঞ, নার্স, চিকিৎসক এবং যারা শিশু-সম্পর্কিত পরিষেবায় নিয়োজিত আছেনে তাদের সংখ্যা চাহিদা অনুযায়ী যৌক্তিক করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, যারা প্রান্তিক অঞ্চলে কর্মরত আছেন, তাদের উপযুক্ত প্রণোদনা ও কাজের স্বীকৃতি দেওয়া জরুরি।
এসব প্রসঙ্গে সেভ দ্য চিলড্রেন বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর সুমন সেনগুপ্ত বলেন, আমরা শিশু বিষয়ক সকল সরকারি কার্যক্রমে সরকারকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য উপবৃত্তি কর্মসূচিগুলো প্রসারিত করে, স্টেম শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে এবং শিশুর দক্ষতা-বৃদ্ধির কর্মসূচিকে প্রাধান্য দিয়ে এ সংক্রান্ত সুযোগ বৃদ্ধিতে সরকার বাজেট বরাদ্দ দিতে পারে।
তিনি বলেন, কোনো উদ্যোগ তখনই সফল হয় যখন কর্মসূচিটি চাহিদার ভিত্তিতে পরিকল্পনা করা হয় এবং এর সকল স্তরে অংশীজনের সমর্থন ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যায়। আমাদের এমন কিছু শিশুকেন্দ্রিক কার্যক্রম গ্রহণ করা উচিত যেগুলো পথশিশু, দুস্থ ও অনাথ শিশুর আশ্রয়ণ নিশ্চিতকরণ, অটিস্টিক শিশুদের জন্য সহায়তা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য-বিমার প্রচলন, শিশু শ্রমের নিরসন, কন্যা শিশুর প্রতি বৈষম্য প্রতিরোধ, শিশু সুরক্ষা বৃদ্ধি এবং কিশোর গ্যাং প্রতিরোধে সহায়ক ও কার্যকর হয়।
টিআই/এমএসএ