শুধু গ্রেপ্তারে উগ্রবাদ দমন সম্ভব নয়
পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের প্রধান অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মো. মনিরুল ইসলাম বলেছেন, সন্ত্রাসবাদ বা উগ্রবাদ বৈশ্বিক সমস্যা। শুধু গ্রেপ্তার করে বা জেলখানায় রেখে এটা দমন করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে সমাজের বিভিন্ন পেশার মানুষের বিশেষ করে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের একটা বিরাট দায়িত্ব এবং ভূমিকা রয়েছে।
ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) উদ্যোগে সন্ত্রাসবাদ ও উগ্রবাদবিরোধী জনসচেতনতামূলক পথনাটক ‘এসো ফিরি আলোর পথে’ এর প্রদর্শনী শুক্রবার (৩১ মে) রাতে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই প্রদর্শনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন সাবেক এ সিটিটিসির চৌকষ কর্মকর্তা।
মনিরুল ইসলাম বলেন, আজ থেকে ২৫ বছর আগে আমাদের কবি শামসুর রহমানকে যখন বাসায় ঢুকে হত্যার চেষ্টা চালানো হয়, যশোরে উদীচি নাট্যমঞ্চে যখন বোমা হামলা হয় এবং তারপর বিভিন্ন সিনেমা হল, সার্কাস প্যান্ডেলসহ বিভিন্ন জায়গায়, পহেলা বৈশাখে রমনার বটমূলে যে হামলা হয়, তখন চিন্তা করতাম এ হামলার কারণটা কী? বুঝতে পারছিলাম না, যারা হামলা করছিল তারা কেন মনে করছিল তারা জিহাদ করছে, ইসলাম কায়েম করছে। পরে যখন সন্ত্রাসবাদ বিষয়ে কাজ করা শুরু করলাম তখন বুঝলাম যারা এ ধরনের স্বপ্ন বিক্রি করে তারা ধুরন্দর।
তিনি বলেন, সন্ত্রাসবাদ বা উগ্রবাদ দমন করার জন্য অন্যান্য কার্যক্রমের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডও আমরা বেছে নিয়েছি। তারই অংশ হিসেবে আজকের এই নাটকটি মঞ্চস্থ হলো যেখানে নাটক ছোট কিন্তু মেসেজ অনেকগুলো। কীভাবে হতাশাগ্রস্থ তরুণদের মগজ ধোলাই করা হচ্ছে, সেটি এই নাটকে দেখানো হয়েছে।
সভাপতির বক্তব্যে ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের সংস্কৃতির শিকড় অনেক গভীরে এবং পুরানো। এই দেশে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সকলে আমরা একসাথে বসবাস করি। সন্ধ্যা বেলায় একদিকে উলুধ্বনি দেয়া হয় মন্দিরে, পাশেই আযান দেয়া হয় মসজিদে। একজন মন্দিরে যায়, একজন যায় মসজিদে। এভাবেই আমাদের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। আমাদের উৎসব, পূজাপার্বণ সব কিছু সকল ধর্মবর্ণ একসাথে মিলেমিশে উদযাপন করি। সেই দেশে আমরা দেখেছি উগ্রবাদ, জঙ্গিবাদের কালো থাবা। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিশেষ করে উদীচির অনুষ্ঠানে, ছায়ানটের অনুষ্ঠানে, এক সাথে দেশের ৬৩ জেলায় বোমা হামলা হয়েছে। বাংলা ভাই আব্দুর রহমানের যুগ ছিল। শেষ পর্যন্ত আমরা নিজেরাই আক্রান্ত হয়েছি ২০১৬ সালে হলি আর্টিজান হামলায়। এরপর থেকেই এই প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়।
ডিএমপি কমিশনার বলেন, উগ্রবাদ ও জঙ্গিবাদকে রুখে দেওয়ার জন্য সারা বিশ্বে বাংলাদেশ রোল মডেল। কেবল বাংলাদেশ নয়, আমেরিকা বা ইউরোপে যারা এগুলো নিয়ে কাজ করে, তারাও বাংলাদেশে যারা জঙ্গিবাদ বা সন্ত্রাসবাদ বিরোধী কাজ করেন, গবেষণা করেন, তাদের শরণাপন্ন হন... তাদের দেশে কীভাবে জঙ্গিবাদ মোকাবেলা করা যায় সেজন্য। এটি নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য গর্বের।
তিনি আরও বলেন, আমাদের যে উদ্দেশ্য সেটা সিটিটিসির মাধ্যমে, অ্যান্টিটেরোরিজমের মাধ্যমে, পুলিশিংয়ের মাধ্যমে নয়, আজকের নাটকের মাধ্যমে সেটি তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। আমরা নাটকে লক্ষ্য করেছি, পারিবারিক বন্ধন কিছুটা ঢিলে হয়ে যাচ্ছে। বাঙালি সংস্কৃতির যে আবহ সেটি সেভাবে থাকছে না। আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে বাঙালির সংস্কৃতির কাছে ফিরে যেতে হবে। বাঙালি সংস্কৃতি দিয়েই উগ্রবাদ, জঙ্গিবাদের মতো অপসংস্কৃতিকে রুখে দিতে চাই- এটি হোক আমাদের আজকের স্লোগান।
‘এসো ফিরি আলোর পথে’ নাটকে উপস্থাপন করা হয়েছে কীভাবে উগ্রবাদের উস্কানিদাতা বা জঙ্গি সংগ্রহকারীরা বিভিন্ন সংগঠনের নাম ধারণ করে ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে মানুষকে বিপথগামী করে, উগ্রবাদের দিকে ধাবিত হওয়া ব্যক্তির আচরণে কী কী পরিবর্তন ঘটে, উগ্রবাদে জড়িত হওয়ার ক্ষেত্রে কারা ঝুঁকিতে রয়েছে এবং উগ্রবাদ প্রতিরোধে করণীয় কী হতে পারে। ধর্মের আংশিক বা ভুল ব্যাখ্যার বিপরীতে ধর্মের সঠিক ব্যাখ্যা এবং প্রকৃত ধর্মীয় আচরণ কী হওয়া উচিত, সে সম্পর্কেও নাটকটিতে তুলে ধরা হয়েছে।
আরও পড়ুন
পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়াভিত্তিক নাট্যচর্চার রীতি প্রয়োগ করা হয়েছে নাটকটিতে। প্রদর্শনীতে উপস্থিত দর্শক নাটকের সাথে সরাসরি যুক্ত হতে পারছেন, তার গুরুত্বপূর্ণ মতামত দিতে পারছেন, এমনকি নাট্য প্রবাহে যুক্ত হয়ে কখনো কখনো হয়ে উঠেছেন নাটকের অভিনেতা। এ ছাড়াও নাটক চলাকালীন গুরুত্বপূর্ণ মতামত প্রদান করে নাটককের গতি বা গল্পের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন উপস্থিত দর্শকরা। এভাবেই অভিনেতা ও দর্শকের মধ্যে কথোপকথন, যোগাযোগ এবং পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে নাটকটি এগিয়ে যায়, ফলে দর্শক নিজেকে নাটকের অংশ মনে করেন।
নাটকটির সার্বিক তত্ত্বাবধায়নে ছিলেন সিটিটিসিএর অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান। জায়েদ জুলহাসের রচনায় নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছেন ডিএমপির গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার খন্দকার রবিউল আরাফাত লেনিন। পরিবেশনায় ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নাট্য সংসদের সদস্যবৃন্দ।
জেইউ/এনএফ