পঞ্চাশোর্ধ্বদের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি আশানুরূপ নয়
করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন নেওয়ার পর শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। যা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পরও গুরুতর অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি কমায়। তবে বাংলাদেশে টিকা নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে যাদের বয়স ৫০ এর বেশি তাদের শরীরে ভ্যাকসিন নেওয়ার পরও আশানুরূপভাবে অ্যান্টিবডি তৈরি হচ্ছে না। এজন্য টিকা নেওয়ার পরও করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর তাদের মৃত্যুঝুঁকি থেকে যাচ্ছে।
সম্প্রতি শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় প্রাপ্ত প্রাথমিক ফলে এ তথ্য জানা গেছে। গবেষণাটি পরিচালনা করছেন ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আশরাফুল হক ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রেজিস্ট্রার (মেডিসিন বিভাগ) ডা. ফরহাদ উদ্দিন চৌধুরী। এ দুই চিকিৎসক শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে টিকা নিতে আসা প্রায় সাড়ে ৪শ মানুষের ওপর এ গবেষণাটি পরিচালনা করছেন। গবেষণাটি এখনো চলামান আছে। দ্রুত শেষ করে প্রতিবেদন আকারে প্রকাশের কথা জানিয়েছেন তারা।
ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপকালে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আশরাফুল হক বলেন, করোনার ভ্যাকসিন নিলে করোনা হবে না বিষয়টি এমন নয়। প্রত্যেকটি মানুষের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা অ্যান্টিবডি থাকে। যখন কোনো ভাইরাস আমাদের শরীরে প্রবেশ করে তখন আমাদের শরীরের অ্যান্টিবডি তাদের মেরে ফেলার চেষ্টা করে। যখন অ্যান্টিবডি কাজ করে না তখন আমাদের শরীরে বয়স অনুযায়ী মৃদু (মাইল্ড) সংক্রমণ, মাঝারি (মডারেট) সংক্রমণ ও তীব্র (সিভিআর) সংক্রমণের উপসর্গ দেখা দেয়। যাদের শরীরে মাইল্ড লক্ষণ দেখা দেয় তাদের কিছুই হচ্ছে না। যাদের মডারেট লক্ষণ দেখা দেয় তাদের মাথা ব্যথা, তীব্র কাশি হয়। সিভিআর লক্ষণে অক্সিজেন লেভেল কমে যাওয়ায় শ্বাসতন্ত্রের ক্ষতি হয়। এজন্য রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়।
তিনি বলেন, করোনার ভ্যাকসিন নেওয়ার উদ্দেশ্য হলো শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি করা, যাতে শরীরে ভাইরাসটি প্রবেশ করলেও কাবু করতে না পারে। যাদের ভ্যাকসিন নেওয়ার পরেও শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরির হার কম তাদের শরীরে বিভিন্ন উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হচ্ছে।
এমন কোনো ভ্যাকসিন এখন পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি যা শরীরে প্রয়োগ করলে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকবে না। এখন পর্যন্ত যেসব ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়েছে সেগুলোর মূল কাজ হচ্ছে করোনাভাইরাসের কার্যকারিতা নষ্ট করে ফেলা।
ডা. মোহাম্মদ আশরাফুল হক জানান, সরকার গত ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ফ্রন্টলাইনারদের প্রথম ডোজ ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু করে। তখন থেকে ৩৫০ জন মানুষের ওপর এ গবেষণা করেছি। এতে দেখা গেছে ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী মানুষের শরীরের অনুপাত অনুযায়ী অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে। তাদের সুস্থ হওয়ার হারও বেশি। কিন্তু যাদের বয়স ৫০ বছরের ঊর্ধ্বে তাদের শরীরে অ্যান্টিবডি সেভাবে তৈরি হচ্ছে না। তাই তারা বেশি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন এবং মারা যাচ্ছেন। করোনা আক্রান্ত হওয়ার পর যারা সুস্থ হয়েছেন তাদের শরীরে বয়স অনুযায়ী অ্যান্টিবডির অপটিক্যাল ডেনসিটি (ওডি) দেখা হয়। সে অনুযায়ী, সুস্থ হওয়া রোগীর কাছ থেকে প্লাজমা নিয়ে অ্যান্টিবডি ডেনসিটি দেখে অসুস্থ রোগীদের প্লাজমা থেরাপি দেওয়া হয়।
দ্বিতীয় ডোজ ভ্যাকসিন নেওয়া শুরু হয় ৮ এপ্রিল থেকে। সেখান থেকে আরও ৮০ জনকে এ গবেষণায় যুক্ত করা হয়। এদের মধ্যে প্রথম ডোজ নেওয়া অনেকেরই করোনা হয়েছে। তার মানে, ভ্যাকসিন নেওয়ার পরেও তাদের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়নি। আর যাদের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে তারা আক্রান্ত হলেও তীব্রতা ছিল কম।
এ চিকিৎসক বলেন, ভ্যাকসিন নেওয়ার পর একজন মানুষের শরীরে কতটুকু অ্যান্টিবডি তৈরি হচ্ছে তা দেখা হয় অ্যালাইজা মেশিনের মাধ্যমে। অপটিক্যাল ডেনসিটির (ওডি) মাধ্যমে অ্যান্টিবডির ঘনত্ব পরিমাণ করা হয়। যাদের অ্যান্টিবডির ঘনত্ব ২ দশমিক ৬০ ও মাত্রা ৬ এর উপরে থাকবে তাদের অ্যান্টিবডি করোনা আক্রান্ত রোগীদের জন্য ওষুধ হিসেবে কাজ করে। করোনা আক্রান্ত গুরুতর রোগীকে তাদের অ্যান্টিবডি নিয়ে প্লাজমা থেরাপি দিলে ভালো সাড়া পাওয়া যায়।
ভ্যাকসিনের মূল কাজ হচ্ছে শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি করা। যাতে এ ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করলেও যেন রোগীকে হাসপাতালে যেতে না হয়। তীব্রতা কম থাকে। এমন কোনো ভ্যকসিন এখন পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি যা শরীরে প্রয়োগ করলে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকবে না। এখন পর্যন্ত যেসব ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়েছে সেগুলোর মূল কাজ হচ্ছে করোনাভাইরাসের কার্যকারিতা নষ্ট করে ফেলা। আমাদের গবেষণা এখনও চলমান। দ্রুত শেষ করে প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হবে।
প্রথম ডোজ নেওয়ার কতদিন পরে শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয় এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. আশরাফুল হক বলেন, এটা আসলে আমাদের গবেষণায় আসছে না। এই গবেষণা করা খুবই ব্যয়বহুল, রাষ্ট্রীয়ভাবে করা যেতে পারে। সাধারণত করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পরে যতটুকু অ্যান্টিবডি তৈরি হয় তার সমপরিমাণ অথবা তার চেয়ে বেশি অ্যান্টিবডি টিকা নেওয়া ব্যক্তিদের শরীরে পাওয়া যাচ্ছে।
ডা. আশরাফুল হক জানান, দ্বিতীয় ডোজ আমাদের শরীরে বুস্টার হিসেবে কাজ করে এবং ১ম ডোজ থেকে ২য় ডোজে অ্যান্টিবডি বেশি তৈরি হচ্ছে। ফ্রন্ট লাইনার যারা ১ম ও ২য় ডোজ নিয়েছেন অথচ করোনায় আক্রান্ত হননি তাদের পরীক্ষা করলে এ বিষয়ে আরও ভালো ফল পাওয়া যাবে।
এসএএ/এসকেডি/জেএস