‘মন্ত্রী হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে আমার কাছে কষ্ট লাগে’
সম্প্রতি ‘মোটরযানের গতিসীমা সংক্রান্ত নির্দেশিকা, ২০২৪’ জারি করে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। এ নিয়ে দেশজুড়ে নানা আলোচনা চলছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণগুলোর দিকে মনোযোগ না দিয়ে বিআরটিএ লেগেছে ‘গতি’র পেছনে! তাও অবাস্তব নির্দেশনা।
এ অবস্থার মধ্যেই দীর্ঘ পৌনে ৬ বছর পর আজ (বুধবার) অনুষ্ঠিত হলো সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা পরিষদের সভা। এতে অংশ নেন স্বয়ং সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ সড়ক পরিবহন সংশ্লিষ্ট সব স্টেক হোল্ডার। দিনভর নীতি-নির্ধারণী মহলের এ সভার দিকে নজর ছিল সবার।
সড়ককে যানজটমুক্ত করা, দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ এবং পরিবহনের শৃঙ্খলা ফেরানোর উপায় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয় গুরুত্বপূর্ণ এই সভায়। সড়ক পরিবহনের সঙ্গে সম্পৃক্ত স্টেকহোল্ডাররা নতুন করে অনেক প্রস্তাব দিয়েছেন সভায়, এর মধ্যে কয়েকটি ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।
বুধবার (১৫ মে) রাজধানীর বনানীতে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) সদর কার্যালয়ে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়। সর্বশেষ সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা পরিষদের ৪২তম সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০১৮ সালের ২৭ আগস্ট। এর ৫ বছর ৮ মাস ১৯ দিন পর আজ অনুষ্ঠিত হলো ৪৩তম সভা!
এই ঈদে আগের ঈদের চেয়ে বেশি এবং সবচেয়ে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এগুলো তো মন্ত্রী হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে আমার কাছে কষ্ট লাগে। এই বছরের চাইতে আগামী বছর দুর্ঘটনা কম হবে, এটাই তো হওয়া উচিত। না হলে আমরা টিম হিসেবে কাজ করছি কেন? আপনারা ডিজিটালাইজেশন করেছেন, নানা কিছু করে ফেলেছেন। এগুলোর তো কোনো রেজাল্ট পাচ্ছি না।
সকাল সাড়ে ১০টায় বিআরটিএ ভবনে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীর কার্যালয়ের সভাকক্ষে সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও মন্ত্রী দেরিতে আসায় সভা শুরু হয় প্রায় সাড়ে ১১টার দিকে। সভাকক্ষের প্রতিটি চেয়ারে ছিলেন স্টেকহোল্ডার ও নীতি-নির্ধারকরা। বিভিন্ন মিডিয়ার সংবাদকর্মীরাও সভায় উপস্থিত ছিলেন।
ফিটনেসবিহীন গাড়ি নিয়ে ক্ষোভ মন্ত্রীর
সভার শুরুতে একটি ছোট প্রেজেন্টেশন দেন বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার। তার উপস্থাপনা শেষ হতেই সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘৪৩ বছরের পুরোনো গাড়ি কীভাবে রাস্তায় চলে? এতদিন বিআরটিএ কি নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়েছিল?’
এ সময় কথা বলার চেষ্টা করেন বিআরটিএ চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার। তখন ওবায়দুল কাদের আরও উচ্চস্বরে বলে ওঠেন, ‘৪৩ বছর, ফোর্টি থ্রি ইয়ার্স... চট্টগ্রামে যে গাড়ি এক্সিডেন্ট করেছে, তার বয়স ৪৩ বছর। সেটা কি আপনাদের নজরে আসে না?’
বিআরটিএ চেয়ারম্যানকে উদ্দেশ্য করে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘প্রতিনিয়ত আমাকে এগুলোর জন্য কথা শুনতে হয়। এই ঈদে, ঈদের আগের চেয়ে পরে বেশি এবং সবচেয়ে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এগুলো তো মন্ত্রী হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে আমার কাছে কষ্ট লাগে। এই বছরের চাইতে আগামী বছর দুর্ঘটনা কম হবে, এটাই তো হওয়া উচিত। না হলে আমরা টিম হিসেবে কাজ করছি কেন? আপনারা ডিজিটালাইজেশন করেছেন, নানা কিছু করে ফেলেছেন। আসলে এগুলোর তো কোনো রেজাল্ট পাচ্ছি না। রেজাল্ট না পেলে এগুলো করে কী লাভ? কথা তো শুনতে হয় আমাকে। বিআরটিএ’র চেয়ারম্যানকে তো কেউ কিছু বলে না।’
আরও পড়ুন
মন্ত্রীর মুখে এসব শুনে বিআরটিএ চেয়ারম্যানকে অনেকটা চুপসে যেতে দেখা যায়। পরিস্থিতি সামাল দেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী। তিনি মন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আমাদের এমন কোনো দিন নাই ৬৪ জেলায় ম্যাজিস্ট্রেটরা তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে না। ফিটনেসবিহীন গাড়িগুলো যখন রাস্তায় নামছে, আমরা সেগুলোকে ধরছি। কিন্তু পুলিশের সমস্যা হচ্ছে, তাদের গাড়ি নিয়ে রাখার জায়গা নেই।’
এ সময় মন্ত্রী বলেন, ‘তাহলে ফোর্টি থ্রি ইয়ার্স বছরের গাড়ি কীভাবে রাস্তায় চলে?’ তখন সড়ক সচিব বলেন, ‘এই গাড়িগুলো তারা লুকিয়ে রাখে। শুক্র ও শনিবার তারা এসব গাড়ি বের করে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ঈদের সময় হাইওয়ে পুলিশ আমাদের কাছ থেকে অনুমতি নিয়েছে। ওই সময় এত বেশি মানুষ ছিল যে তারা আমাকে বলল— ফিটনেসবিহীন গাড়ি তারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। তখন আর কোনো উপায়ও ছিল না। এর মধ্যেই ফিটনেসবিহীন গাড়িগুলো রঙ করে সড়কে বের হয়ে গেছে। গত ঈদে বিআরটিসি ৭০০ বাস দিয়েছে, তারপরও ফিটনেসবিহীন গাড়ি সড়কে চলেছে। কারণ, শহর থেকে যাত্রী পাঠানোর আর কোনো উপায় ছিল না।’
মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ির সমস্যা সমাধানে হচ্ছে স্ক্র্যাপ নীতিমালা
মন্ত্রী ও বিআরটিএ চেয়ারম্যানের পর কথা গড়ায় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি শাজাহান খানের টেবিলে। প্রায় ২৫ মিনিটের মতো কথা বলেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘যে সকল গাড়ি মেয়াদোত্তীর্ণ, সেসব গাড়ি ডাম্পিং করে কোনো লাভ নেই। এগুলোকে স্ক্র্যাপ করে ফেলতে হবে। মালিকরা যদি এট স্ক্র্যাপ না করেন, তাহলে আপনি (সড়ক সচিব) সেটা কোনো মেশিন দিয়ে চাপ দিয়ে রাখবেন। যাতে ডাম্পিংয়ের সমস্যাটা না হয়।’
জবাবে সড়ক সচিব বলেন, ‘আমরা স্ক্র্যাপ নীতিমালা করছি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আরেকটু বসব। আপডেট করার কিছু বিষয় আছে। এটা নিয়ে আমরা কাজ করছি।’
একদিনেই পরীক্ষা-রেজাল্ট, টাকা জমার এক মাসের মধ্যে ড্রাইভিং লাইসেন্স
শাজাহান খান বিআরটিএ চেয়ারম্যানের কাছে জানতে চান, ‘এখন পর্যন্ত আপনারা কতগুলো ড্রাইভিং লাইসেন্স দিতে পারননি?’ জবাবে বিআরটিএ চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমাদের এখন পর্যন্ত তিন লাখ ৭৯ হাজারের মতো ড্রাইভিং লাইসেন্স পেন্ডিং আছে। প্রতিদিন আমাদের আট হাজার কার্ড প্রিন্ট করার সক্ষমতা আছে।’
তখন শাজাহান খান বলেন, ‘আমার জানামতে কমপক্ষে ৭-৮ লাখ ড্রাইভিং লাইসেন্স এখনো পেন্ডিং আছে।’
এ সময় সড়ক সচিব বলেন, ‘এখন লাইসেন্সের কাগজের জন্য বিআরটিএতে আসতে হয় না। আমরা একদিনে পরীক্ষা নিয়ে দিনে দিনে রেজাল্ট দিয়ে দিই। তারপর যেদিন টাকা জমা হচ্ছে তার এক মাসের মধ্যে আমি ওই গ্রাহকের মোবাইলে লাইসেন্স পাঠিয়ে দিচ্ছি।’
যানবাহনের বীমা ঐচ্ছিক রাখার প্রস্তাব
পরিবহন নেতা শাজাহান খান সড়ক পরিবহন মন্ত্রীর কাছে প্রস্তাব রেখে বলেন, ‘দুর্ঘটনা ঘটলে শুধু চালককে দোষারোপ করা হয়। সেটি না করে এবং পুলিশের রিপোর্টের উপর ভিত্তি না করে আপনাদেরও রিসার্চ করে কারণ অনুসন্ধান করা উচিত, আসলে কী কারণে দুর্ঘটনা হয়েছিল।’
যানবাহনের বীমা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘নীতিমালা সব জায়গায় ঠিক আছে। তবে একটা জায়গায় লেখা আছে যাত্রী বা যানবাহনের; এই যাত্রী বা শব্দটা বাদ দিতে হবে। না হলে যাত্রীদের বীমা, বীমা কোম্পানির হাতে চলে যাবে। এই জায়গা থেকে আমাদেরকে রক্ষা করতে হবে। দ্বিতীয় কথা হলো, মোটরযান বীমা অপশনাল ছিল। এখন যে আইনটা করা হয়েছে, সেখানে যদি মোটরযান বীমা না করে তাহলে তাকে তিন হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে। আমার তো মনে হয় সচিব সাহেব (সড়ক) আপনার গাড়িকেও তিন হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে।’
জবাবে সড়ক সচিব বলেন, ‘গাড়ির বীমা প্রসঙ্গে সব মন্ত্রী একমত পোষণ করেছেন।’ তখন শাজাহান খান সচিবকে জিজ্ঞেস করেন, ‘গাড়ির স্টেকহোল্ডাররা কী বলে, সেটা কি শুনেছেন? এই আইন তাহলে কার জন্য? আইন কি সব মন্ত্রীদের জন্য?’
বীমা কোম্পানিকে কেন মোটা তাজা করছেন— প্রশ্ন রেখে শাজাহান খান বলেন, ‘ধরেন, আপনার গাড়ি পুরাতন হয়ে গেছে। একটা নির্দিষ্ট বছর পর বীমা কোম্পানিও আর ইন্স্যুরেন্স করে না। অথচ আপনি আইনে বলে দিলেন, মোটরগাড়িতে থার্ড পার্টি বীমা করা না থাকলে তিন হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে। গাড়ি তো আপনার পুরাতন। আপনি চাইলে তিন হাজার টাকা খরচ করে গাড়ি আবার নতুন বানিয়ে ফেলতে পারেন। তাহলে এটা কোনো আইন হলো? বিষয়টা অপশনাল থাকা উচিত। আমার গাড়িতে আমি বীমা করতেও পারি, নাও করতে পারি। আমার গাড়ি যদি এখন এক্সিডেন্ট হয়, তাহলে তো বীমা কোম্পানি আমাকে টাকা দেবে না। আবার বীমা না থাকলে আপনার তিন হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে। আপনি কেন এই বীমা কোম্পানিকে মোটাতাজা করছেন? এর আগেও কিন্তু আমরা আপনাদের হিসাব দিয়েছি, প্রতি বছর বীমা কোম্পানি ২৫০ থেকে ৩০০ কোটি টাকা নেয়। কিন্তু এক টাকাও ফেরত দেয় না।’
‘আজকে মন্ত্রী মহোদয়ের কাছে প্রস্তাব দিচ্ছি, এটা বাদ দিয়ে ২০১৮-তে যেটা অপশনাল ছিল। সেটা আপনি অপশনাল রাখবেন।’ এই কথা বলে শেষ করেন শাজাহান খান।
পুলিশের জন্য নতুন ডিভাইসের প্রস্তাব
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘সড়কে ক্যামেরাগুলো সামনে থেকে লাগানো থাকে। কিন্তু মোটরসাইকেলের পেছনে নম্বর প্লেট থাকায় সেগুলো ডিটেক্ট করা সম্ভব হয় না। তাই আমাদের প্রস্তাব থাকবে মোটরসাইকেলের নাম্বার প্লেট পেছনে থাকুক, কিন্তু কোনো না কোনো ম্যাকানিজমে রেজিস্ট্রেশন নম্বরের একটা অংশ সামনে থাকতে হবে।’
ড্রাইভিং লাইসেন্সের ডাটাবেজের সঙ্গে রেজিস্ট্রেশনের ডাটাবেজের কোন সংযোগ নেই জানিয়ে এই সিনিয়র সচিব প্রস্তাব বলেন, ‘গাড়ির ফিটনেস না থাকলে সেটির অপরাধ হচ্ছে মালিকের। কিন্তু যখন ট্রাফিক রুল ভায়োলেট হয়, তখন অপরাধ কিন্তু ড্রাইভারের। মালিক কিন্তু জানে না কী হয়েছে রাস্তায়। কিন্তু মামলা মালিকের বিরুদ্ধে হচ্ছে। এজন্য বিআরটিএ একটা অ্যাপস করেছে। কোন গাড়ি, কে চালাচ্ছে যদি ওই অ্যাপসের মাধ্যমে ট্র্যাক করা হয়, তাহলে এই অপরাধটা কমে যাবে। সহজে ড্রাইভারকে আইডেন্টিফাই করা যাবে। ড্রাইভিং লাইসেন্স থেকে তার পয়েন্ট কাটা যাবে। যেহেতু এটা তার জীবন-জীবিকা, তাই সেই কাজটা কখনো করবে না।’
এ সময় পুলিশকে একটি ডিভাইস দেওয়ার প্রস্তাব দেন সিনিয়র সচিব। তিনি বলেন, ‘আমরা পুলিশকে একটা ডিভাইস দিতে পারি। সেই ডিভাইসের মাধ্যমে গাড়ি স্ক্যান করে যেন বুঝতে পারে এই গাড়ির ফিটনেস আছে কি নেই। ফলে কোনো গাড়িকে অযথা দাঁড় করাতে হবে না। এর মাধ্যমে ফিটনেসবিহীন গাড়িগুলোকে আমরা আস্তে আস্তে আলাদা করতে পারব। যখন একটি বাস যাত্রী নিয়ে রাস্তায় নেমে যায়, তখন এটা স্টপ করা খুবই কঠিন। আমাদেরকে শুরু থেকেই এই কাজটা করতে হবে।’
থ্রি-হুইলার নিয়ে বিআরটিএ চেয়ারম্যান ও সড়ক সচিবকে দোষারোপ
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোস্তফা কামাল বলেন, ‘মহাসড়কে উল্টো দিকে গাড়ি চলে। আমি কিছু জায়গার কথা বলেও দিয়েছি। বিশেষ করে থ্রি-হুইলারগুলো উল্টো দিকে বেশি চলে। দুর্ঘটনার সবচেয়ে প্রধান কারণ এটি, আমি নিজে দেখেছি। আমি সড়ক সচিব ও বিআরটিএর চেয়ারম্যানকেও বলেছি। তারা কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেননি।’
হর্ন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা এখানে এসি রুমের মধ্যে বসে আছি। তারপরও আপনি শুনতে পাচ্ছেন হর্নের আওয়াজ। আপনি বিভিন্ন দেশে যান, অন্যান্য সচিবরাও বিভিন্ন দেশে যান। আপনারা নিশ্চয়ই এত হর্নের আওয়াজ কোথাও শুনেন না। আমার মনে হয়, এই জায়গায় একটু শক্তভাবে ধরা দরকার। হর্নটা বন্ধ করে দিলে খুব বেশি অসুবিধা হবে না। আমার মনে হয় না গাড়িতে হর্ন দরকার আছে।’
জবাবে সড়ক সচিব বলেন, ‘পুলিশকে হর্নের বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া আছে।’ তখন আবার নৌপরিবহন সিনিয়র সচিব বলেন, ‘এটা পার্সোনালি নিও না। সবকিছু মুখে বলে সমাধান দিও না। আমি অনুরোধ করছি।’
ফিটনেসবিহীন গাড়ির দায় বিআরটিএ’কেও নিতে হবে
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, ‘দেশে ট্রাক-বাসের সংখ্যা হলো সাড়ে চার লাখ। সাড়ে তিন লাখ ট্রাক, এক লাখ বাস। আর পত্রিকায় আসে সাড়ে ছয় লাখের বেশি গাড়ির ফিটনেস নেই। জানি না এটা বিআরটিএ’র পক্ষ থেকে কীভাবে বলা হয়? সবাই বলে ঢাকা শহরে ১৪ হাজার বাস চলে। কিন্তু আমি জানি ঢাকা শহরে মাত্র চার হাজার বাস চলে। যত অভিযোগ হয়, সব অভিযোগ আমাদের দিকেই আসে। ৪৩ বছর পর্যন্ত একটা গাড়ি কীভাবে চলল? এর জন্য কি দায়ী শুধু পরিবহন মালিক নাকি কর্তৃপক্ষ? আমি মনে করি, ৪৩ বছর চলার এই দায় কর্তৃপক্ষের নিতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘ফিটনেসবিহীন গাড়িকে স্ক্র্যাপ করা হোক। তাহলে অন্য মালিকরা সতর্ক হবে। ঢাকা শহরের ৬০ শতাংশ বাসের মালিক গ্যারেজে মিস্ত্রি ও পরিবহনের কাজ করে। ফিটনেসবিহীন গাড়ি বন্ধের বিষয়ে মালিক সমিতি সব সময় সহায়তার জন্য প্রস্তুত। শুধু মালিক সমিতির একা বললেই হবে না, সবার একসঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতে হবে।’
রোড ট্যাক্স চায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নুর তাপস বলেন, ‘ঢাকা শহরে প্রতিদিন অসংখ্য গাড়ি আসে এবং সেই গাড়ির জন্য সড়কের ক্ষতি হয়। সড়ক রক্ষণাবেক্ষণে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ টাকা সিটি কর্পোরেশনের ব্যয় হয়। আগে সিটি কর্পোরেশনকে রোড ট্যাক্স দেওয়া হতো। ৯০ দশকের পরে সেটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেটা এখন সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ আদায় করে। আমাদের ওখান থেকে অংশ দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেটা এখন পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। ইতোমধ্যে আমরা চেয়ারম্যান বরাবর চিঠি দিয়েছি। মন্ত্রী মহোদয়ের কাছে অনুরোধ— আপনি যেন বিষয়টা সুরাহা করে দেন।’
তিনি বলেন, ‘যেসব গাড়ি ঢাকা শহরে আসে সেটার জন্য রাস্তার সংস্কার করতে যে টাকা খরচ হয় তার জন্য রোড ট্যাক্স থেকে আমাদেরকে যেন একটা অংশ দেওয়া হয়। আমরা পুরোটা চাচ্ছি না। বাৎসরিক যদি আমাদেরকে এ টাকাটা দেওয়া হয়, তবে আমরা উপকৃত হব।’
গাড়ি ডাম্পিংয়ের জায়গা ফ্রিতে দেওয়ার প্রস্তাব জানিয়ে মেয়র বলেন, ‘ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ৮১ একর জায়গা রয়েছে মাতুয়াইল ভাগাড়ে। যেখানে আমরা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করে থাকি। সেখানে পর্যাপ্ত জায়গা দেব এবং বিনামূল্যে ডাম্পিং করার সুযোগ দেব। তবে যে গাড়ি একবার ধরা হবে, সেটা বাজেয়াপ্ত করা হবে। সেই গাড়ি মালিকের কাছে ফেরত দেওয়ার কোনো সুযোগ থাকবে না। বাজেয়াপ্ত করে সিটি কর্পোরেশনকে হস্তান্তর করা হবে। সিটি কর্পোরেশন সেটাকে স্ক্র্যাপ আকারে হোক আর যেভাবে হোক, সেটাকে ধ্বংস করবে।’
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘সিদ্ধান্তে আসা দরকার যে ঢাকায় ইজি বা অটোরিকশা চলবে না। এটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।’
সমস্যা সমাধানে নিয়মিত সভা চান কাদের
সবশেষ সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘সভাটি মাঝে মধ্যে করা দরকার। উপদেষ্টা পরিষদের সভার আগে কিন্তু আমরা সড়কের নিরাপত্তা পরিষদের সভা করেছি। এসব মিটিংগুলো নিয়মিতভাবে হলে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিতে পারি। সমাধানের পথ খুঁজতে পারি।’
তিনি বলেন, ‘পদ্মা সেতু থেকে সরে যাওয়ার পর আমরা বিশ্ব ব্যাংকের কোনো প্রকল্প গ্রহণ করিনি। প্রধানমন্ত্রীও কিন্তু বলেছেন তাদের টাকার আর কোনো দরকার নেই। তারা কিন্তু বারবার আমাদের প্রস্তাব দিচ্ছেন বিভিন্ন প্রজেক্টের। শেষে আমরা একটা প্রস্তাবে রাজি হয়েছি, সেটা হচ্ছে নিরাপদ সড়ক। সড়কে নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিশ্ব ব্যাংকের এই প্রস্তাবটা আমরা প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি নিয়ে গ্রহণ করেছি। এই প্রকল্পের জন্য ২০৯ কোটি টাকা পাওয়া গেছে।’
মন্ত্রী আরও বলেন, ‘সভা থেকে আমরা একটা সিদ্ধান্ত নিতেই পারি— ঢাকা শহরে মোটরসাইকেলে দুই যাত্রীর হেলমেট ব্যবহার করাতে যে কৌশল অবলম্বন করেছি, এভাবে সারা বাংলাদেশে ‘নো হেলমেট নো ফুয়েল’ এই নীতি যদি নিতে পারি তাহলে এখানে একটা সুফল আসবে। আর এখানে ফিটনেসবিহীন গাড়ি স্ক্র্যাপ করার যে সিদ্ধান্ত, যে প্রস্তাব এসেছে সেটা আমরা সমর্থন করতে পারি এবং এই প্রস্তাব সমর্থন করলাম। বিআরটিএর জনবলের জন্য আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি। দেশে এখন যে অবস্থা, বলতে গেলে সারা বিশ্বেই এখন রণক্ষেত্র।’
হাইওয়েতে মোটরসাইকেলকে নতুন উপদ্রব বলে মনে করছেন ওবায়দুল কাদের। সভায় তিনি বলেন, ‘ইদানীং হাইওয়েতে মোটরসাইকেল নতুন উপদ্রব। দেখা যাচ্ছে হাইওয়েতে মোটরসাইকেল ও তিন চাকার যানবাহন বেশি চলছে। এগুলোর জন্য সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা হচ্ছে। এখন দুর্ঘটনা কম মনে হলেও ক্যাজুয়ালিটি বেশি হচ্ছে। একটা বাসের সঙ্গে যদি মোটরসাইকেলের সংঘর্ষ হয়, সে মোটরসাইকেলের দুজনেই নিহত হন। ইজিবাইকেও ৯ থেকে ১০ জন থাকে। ড্রাইভারসহ সবার মৃত্যু ঘটে। ক্যাজুয়ালিটি বেশি হলেও দুর্ঘটনা কমে গেছে। আমরা যে স্পিড লিমিট করেছি, সেটা কাজে আসবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের এই মুহূর্তে অনেক প্রকল্প আছে, অনেক প্রস্তাব আছে। যেগুলো বাস্তবায়নে আর্থিক অসুবিধা অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে। নতুন কোনো প্রকল্প আমাদের এখন নেওয়া উচিত নয়, চলমান যে প্রকল্পগুলো আছে, সেগুলো এই মুহূর্তে শেষ করাটাই আমাদের টার্গেট।’
পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের নিয়ে যে সভা সেটি করা দরকার। বিআরটিএ চেয়ারম্যান সচিবের সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা করবেন। সম্ভব হলে আমি সেখানে উপস্থিত থাকব বলেও উল্লেখ করেন মন্ত্রী।
বাইরে ফিটফাট ভেতরে সদরঘাট— এমন অবস্থা চান না মন্ত্রী
গাড়ির ফিটনেসই মূল উদ্দেশ্য উল্লেখ করে সড়ক পরিবহন মন্ত্রী বলেন, ‘ঢাকা শহরের পরিবহন দৃষ্টিনন্দন করার যে প্রস্তাব এসেছে, তা আমাদের মূল উদ্দেশ্য নয়। আমাদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ফিটনেস। ফিটনেসটা আগে তারপর দৃষ্টিনন্দন। এ বিষয়ে মালিকদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। আমরা যেহেতু মিটিং করেছি। সময়সীমাটা আরেকটু বাড়িয়ে দেব। এটা জুন পর্যন্ত নেওয়া যেতে পারে। বাইরে ফিটফাট ভেতরে সদরঘাট— করে তো কোনো লাভ নেই। তারা রং লাগিয়ে দেয় আবার বৃষ্টি হলে সেই রং চলে যায়।’
সড়ক সচিবকে নির্দেশনা দিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘ব্যাটারিচালিত কোনো গাড়ি যেন ঢাকা সিটিতে না চলে। আমরা তো নীতিমালায় ২২টি মহাসড়কের কথা বলেছি। যেগুলোতে করেছেন, সেগুলো কার্যকর করতে হবে। ২২ মহাসড়ক এবং ঢাকা সিটির বাস্তবতা ভিন্ন। এই সিটিতে যেন ব্যাটারি না চলে, এই ব্যাপারে শুধু নিষেধাজ্ঞা নয়; এগুলো যেন তুলতে না পারে সেই ব্যবস্থা নিতে হবে।’
গাড়িতে হুটার একেবারে নিষিদ্ধ
পরিবহনমন্ত্রী বলেছেন, ‘হর্ন একটা সমস্যা। এখন থেকে ১০ বছর আগে আমার প্রটেকশন গাড়িতে হুটার বাজানো বন্ধ করেছি। আমার কোনো গাড়িতে হুটার বাজানো হয় না কোন অবস্থাতেই। ঢাকায়ও হয় না, ঢাকার বাইরেও হয় না। আমার মনে হয়, হুটার বাজানো বন্ধ করার সিদ্ধান্তটা আমরা নিতে পারি। জরুরি সেবা ছাড়া হুটার বাজানো একেবারেই নিষিদ্ধ।’
সর্বশেষ মন্ত্রী বলেন, ‘দুই থেকে তিনটা সিদ্ধান্ত নিয়ে কার্যকর করা উচিত। বেশি সিদ্ধান্ত নিয়ে সেটি কার্যকর করা গেল না, সেই সিদ্ধান্তের তো দরকার নেই। এখন দুই-তিনটা ভালো প্রস্তাব নিয়েছি। এগুলো আমাদের কার্যকর করতে হবে।’
এমএইচএন/এমজে