রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন : সহসাই হচ্ছে না ত্রিপক্ষীয় বৈঠক
কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদেরকে তাদের নিজ ভূমি মিয়ানমারে পাঠাতে মরিয়া বাংলাদেশ। এ নিয়ে ঢাকার পক্ষ থেকে অব্যাহত প্রচেষ্টা চালানো হলেও বিভিন্ন কারণে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া গতি পাচ্ছে না। যার ফলে ক্রমশ বেড়েই চলেছে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অবস্থানের সময়।
মাস দুয়েক আগে মিয়ানমারের নির্বাচন শেষে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের জন্য ঢাকাকে প্রস্তুত থাকার কথা বলেছিল চীন। কিন্তু নির্বাচন শেষে দেড় মাসের মত হতে চললেও বেইজিং বা ইয়াঙ্গুনের পক্ষ থেকে আর কোনো খবর আসেনি।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, মিয়ানমারের সরকার গঠনের আগে চীনের উদ্যোগে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হওয়ার সম্ভাবনাতো নেই, বরং দেশটির সরকার গঠনের পর বৈঠকের জন্য আরও কত সময় লাগে সেটাই দেখার বিষয়। তবে এরমধ্যে চীনের পক্ষ থেকে কোনো চিঠি না পেলেও বৈঠকের জন্য চীনকে তাগাদা দেওয়া হবে বলে জানান কর্মকর্তারা।
গত ৮ নভেম্বর মিয়ানমারের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে পূর্ব অনুমেয় অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) আবার ক্ষমতায় আসে। স্টেট ও রিজিওনে মোট উন্মুক্ত ৬৬০ আসনের ৫০১টিতে জয়ী হয় সু চির এনএলডি। নভেম্বরে নির্বাচনের ফলাফল এলেও আগামী নতুন বছরের এপ্রিলে নতুন সরকার গঠন করবে দলটি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমাদের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা থাকলেও মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে টালবাহানা করেই যাচ্ছে। নভেম্বরে দেশটির নির্বাচন গেল, সরকার গঠন হবে এপ্রিলে। নতুন সরকার গঠন ছাড়া তাদের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথাও বলা যায় না। আমরা চাইব, চীন তাদের সরকার গঠনের পরপরই বৈঠকের আয়োজন করুক।’
চীনের উদ্যোগে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক নিয়ে কোনো অগ্রগতি আছে কি না জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের তারিখ এখনও চূড়ান্ত হয়নি। আমি জানি না কবে হবে? তবে আমরা দ্রুত প্রত্যাবাসন চাই। আমরা চাই রোহিঙ্গারা তাদের দেশে ফিরে যাক। যত তাড়াতাড়ি তারা (রোহিঙ্গারা) যাবে আমাদেরই মঙ্গল।’
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সর্বশেষ আলোচনা হয়েছিল গত জানুয়ারির শেষের দিকে। তারপর দেশটির সঙ্গে আর কোনো আলোচনায় যায়নি ঢাকা।
মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনার মাস খানেকের একটু বেশি সময় পরে চীনের উহানে নতুন করোনাভাইরাস দেখা দিলে বাংলাদেশসহ সারাবিশ্ব সেই ভাইরাস সামাল দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সেই করোনা ইস্যুতে প্রায় ছয় মাসের বেশি সময় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি চাপা পড়ে যায়। পরবর্তীতে গত সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়টি আবার জোরালোভাবে আলোচনায় নিয়ে আসে বাংলাদেশ।
ঢাকার কূটনৈতিক তৎপরতায় সর্বশেষ গত ২২ অক্টোবর চীনের পক্ষ থেকে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের বিষয়ে খবর আসে। সেদিন সন্ধ্যায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেনের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ করেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই।
ফোনালাপের আলোচ্য বিষয় ছিল প্রত্যাবাসন ইস্যু। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করতে তারা খুব দ্রুত আলোচনায় বসতে চান। এ নিয়ে দেশটির নির্বাচনের পর প্রথমে রাষ্ট্রদূত পর্যায়ে এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ, চীন ও মিয়ানমারের মন্ত্রী পর্যায়ের ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে মোমেনকে আশ্বস্ত করেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
শুধু তাই নয়, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে ঢাকায় জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা পর্যায়ের প্রস্তুতিমূলক ত্রিপক্ষীয় বৈঠক দ্রুত শুরু করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন ওয়াং ই।
টেলিফোন আলাপে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেনকে জানান, চীন রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ করছে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে কিভাবে রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ ভূমিতে ফেরত নেওয়া যায় সেজন্য মিয়ানমার কাজ করবে বলে চীনকে আশ্বস্ত করেছে।
গত ১২ অক্টোবর পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেনের সঙ্গে বৈঠক করেন চীনের ঢাকায় নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত লি জিমিং। বৈঠকে চীনা রাষ্ট্রদূত ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের জন্য ঢাকাকে আভাস দেন। বৈঠকে বসতে রাজি আছেন বলে জানিয়েছেন মোমেন। তবে সেখানে মিয়ানমারের নেতা সুচিকে উপস্থিত থাকতে হবে বলে তিনি সাফ জানিয়ে দেন।
এর আগে চীনের উদ্যোগে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হলেও তাতে কোনো ফল আসেনি বলে জানান সাংবাদিকদের জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন। তবে আবার চীনের পক্ষ থেকে বৈঠকের জন্য যে বার্তা আসে তাতে ইতিবাচক কিছু হওয়ার প্রত্যাশার কথাও ব্যক্ত করেন তিনি।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনে সেনা অভিযান শুরুর পর কয়েক মাসের মধ্যে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। আগে থেকে বাংলাদেশে ছিল আরও চার লাখ রোহিঙ্গা। আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে ২০১৭ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করলেও সেই প্রত্যাবাসন আজও শুরু হয়নি।
গত বছর দুই দফা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও রাখাইন রাজ্যের পরিবেশ নিয়ে শঙ্কার কথা তুলে ধরে ফিরতে রাজি হয়নি রোহিঙ্গারা।
এনআই/এমএইচএস