কেনাকাটায় পিপিআর লঙ্ঘন করছে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক
# টেন্ডার প্রক্রিয়া পিপিআর ২৯(৩) এর সুষ্পষ্ট লঙ্ঘন
# বিদ্যমান আইন মানতে নারাজ ব্যাংকের এমডি
# প্রাক-দরপত্র মিটিংয়ে আপত্তি জানালেও দেওয়া হয়নি সুযোগ
পণ্য কেনাকাটার ক্ষেত্রে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা না মানার অভিযোগ উঠেছে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের বিরুদ্ধে। বিধি না মেনে কম্পিউটার কেনার একটি কাজ সর্বনিম্ন দরদাতার পরিবর্তে প্রতিষ্ঠানটি সর্বোচ্চ দরদাতাকে দিয়েছে বলে অভিযোগ করেছে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।
তাদের অভিযোগ, টেন্ডার স্পেসিফিকেশনে পণ্য উৎপাদনকারী দেশের নাম উল্লেখ বাধ্যতামূলক করেছে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক। যা পিপিআর ২০০৮-এর বিধি-২৯ (৩) এর সুষ্পষ্ট লঙ্ঘন।
তবে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শেখ মো. জামিনুর রহমান এ অভিযোগ নাকচ করেছেন। তার দাবি— পিপিআর মেনেই টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে এবং কাজ দেওয়া হয়েছে।
সম্প্রতি অর্থ বিভাগের সচিব ড. খায়েরুজ্জামান মজুমদার ও বাংলাদেশ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অথরিটির (বিপিপিএ) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সোহেলের রহমান চৌধুরীর কাছে এ সংক্রান্ত একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছে তিন প্রতিষ্ঠান ফ্লোরা লিমিটেড, এসআইএমইসি সিস্টেম লিমিটেড এবং ওয়ালটন ডিজি-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড।
অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়, পিপিআর ২০০৮-এর বিধি-২৯ (৩) ও বাংলাদেশ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অথরিটি (বিপিএএ) লঙ্ঘন করে আইন বহির্ভূতভাবে ‘কান্ট্রিজ অব অরিজিন : ইউএসএ/ইউকে/ইইউ/এইউএস’ শর্তারোপ করার মাধ্যমে সর্বনিম্ন দরদাতাকে নন-রেসপনসিভ করে সর্বোচ্চ দরদাতা প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া হয়েছে। পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তার একক সিদ্ধান্তে এটি করেছেন। নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে ক্ষমতার অপব্যবহার করে একটি সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন যাবৎ পিপিআর আইন বহির্ভূত শর্ত দেওয়ার মাধ্যমে অতিরিক্ত মূল্যে মালামাল সরবরাহ করে যাচ্ছে।
লিখিত অভিযোগে আরও বলা হয়, দরপত্রে (টেন্ডার আইডি নং- ৮৯৭১৩৪) দেওয়া শর্তটির মাধ্যমে পিপিআর লঙ্ঘিত হয়েছে— উল্লেখ করে প্রাক-দরপত্র মিটিংয়ে আপত্তি জানায় অংশগ্রহণকারী একাধিক দরদাতা প্রতিষ্ঠান। এরপরও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিষয়টি আমলে নেননি। এমডির যোগসাজশে সিন্ডিকেটের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য এ ব্যাপারে কোনো ভ্রূক্ষেপ না করে দরপত্র কার্যক্রম চলমান রাখা হয় এবং পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী তাদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হয়।
বাংলাদেশ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অথরিটির কাছে দেওয়া অভিযোগে বলা হয়, গত বছরের ২ নভেম্বর পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক কম্পিউটার, ইউপিএস ও প্রিন্টার ক্রয়ের জন্য দরপত্র আহ্বান করে। পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা, ২০০৮ এর অংশ-৩ (বিনির্দেশ প্রস্তুতকরণ ও গোপনীয়তা রক্ষা) এ বিধি-২৯(৩) এ বলা হয়েছে— ‘কারিগরি বিনির্দেশে কোনো পণ্যের ট্রেডমার্ক বা পণ্যের ব্যবসায়িক নাম (ট্রেড নাম), পেটেন্ট, নকশা বা ধরন, নির্দিষ্ট উৎস দেশের নাম (কান্ট্রিজ অব অরিজিন), উৎপাদনকারী বা সেবা সরবরাহকারীর নাম সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা যাবে না’ এবং বিপিপিএ এর ২০২১ সালের ১৩ জুনের প্রজ্ঞাপনে তা বলা থাকলেও টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন প্রস্তুতের ক্ষেত্রে তা পরিপালন করা হয়নি। যা পিপিআরের স্পষ্ট লঙ্ঘন।
অভিযোগে আরও উল্লেখ করা হয়, পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের দেওয়া শর্তগুলো সংশোধনের জন্য নিয়মানুযায়ী ওয়ালটন ডিজি-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, আইসি প্রতিষ্ঠান ফ্লোরা লিমিটেড ও এসআইএমইসি সিস্টেম লিমিটেড প্রি-বিড মিটিংয়ের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সংশোধনীগুলোর জন্য ই-জিপির মাধ্যমে পত্র দাখিল করে। কিন্তু প্রি-বিড মিটিংয়ে উত্থাপিত সংশোধনীগুলোর বাস্তবায়ন না করেই দরপত্র কার্যক্রম চলমান রাখা হয়। এ ব্যাপারে পরবর্তীতে ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিতভাবে বিষয়টি জানানো হলেও কোনো ধরনের কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ না করে দরপত্রের কার্যক্রম চলমান রাখে। পিপিআর ও পিপিএ -এর স্পষ্ট লঙ্ঘন করার বিষয়টি অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে দৃশ্যমান হলেও কোনো এক অজানা কারণে এ ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি কর্তৃপক্ষ।
আরও পড়ুন
এ প্রসঙ্গে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শেখ মো. জামিনুর রহমান বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠানে গত ছয় বছর কোনো কম্পিউটার কেনা হয়নি। এজন্য কম্পিউটার ক্রয় করতে টেন্ডার আহ্বান করা হয়। এই টেন্ডারে পাঁচটি কোম্পানি অংশগ্রহণ করে। এর মধ্যে দুটি কোম্পানি টেন্ডার থেকে বেরিয়ে যায়। এই দুটি কোম্পানির মধ্যে একটা ছিল ফুনায়েন ফোরটেক আরেকটা ছিল ওয়ালটন। দুই কোম্পানি বেরিয়ে যাওয়ার পর টেন্ডারে টিকে থাকে স্টারটেক, গ্লোবাল ও স্মার্ট। এই তিন কোম্পানির কাছে ‘ম্যানুফেকচার অথরাইজড লেটার’ চাওয়া হয়। একটি কোম্পানি এ লেটার দিতে না পারায় তারা নন-রেসপনসিভ হয়। এরপর বাকি দুটি কোম্পানির মধ্যে আর্থিক মূল্যায়ন করা হয়। এই মূল্যায়নে যে সর্বনিম্ন দরদাতা হয়েছে তাকে কাজ দেওয়া হয়েছে।
‘পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা, ২০০৮ এর অংশ-৩ (বিনির্দেশ প্রস্তুতকরণ ও গোপনীয়তা রক্ষা) এ বিধি-২৯(৩) এ কারিগরি বিনির্দেশে কোনো পণ্যের ট্রেডমার্ক বা পণ্যের ব্যবসায়িক নাম (ট্রেড নাম), পেটেন্ট, নকশা বা ধরন, নির্দিষ্ট উৎস দেশের নাম (কান্ট্রিজ অব অরিজিন), উৎপাদনকারী বা সেবা সরবরাহকারীর নাম সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা যাবে না’ বলে বিধিতে উল্লেখ থাকলেও আপনারা তা উল্লেখ করেছেন- এই অভিযোগের বিষয়ে কী বলবেন?
জবাবে তিনি বলেন, টেন্ডার স্পেসিফিকেশনে ‘একটি দেশে’র নাম উল্লেখ করা যাবে না কিন্তু একাধিক দেশের নাম উল্লেখ করা যাবে। পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধি অনুযায়ী টেন্ডার স্পেসিফিকেশনে দেশের নাম ও পণ্যের নাম উল্লেখ করা যাবে।
তিনি যুক্তি দিয়ে বলেন, বাংলাদেশের সংবিধানও ১৭ বার পরিবর্তন করা হয়েছে। পিপিআরও পরিবর্তন করা হচ্ছে।
এমডি বলেন, এই টেন্ডার প্রসিডিউরের মধ্যে একটা প্রাক-দরপত্র আছে। প্রাক-দরপত্রেও তারা কোনো অভিযোগ দেয়নি। প্রাক-দরপত্রে অভিযোগের তো সুযোগ ছিল।
অর্থ বিভাগ ও বিপিপিএ-তে দেওয়া চিঠিতে প্রতিষ্ঠানগুলোর দাবি, আপত্তি থাকা সত্ত্বেও প্রাক-দরপত্র মিটিংয়ে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নির্দিষ্ট কোম্পানিকে কাজ দিতে দরপত্রের কার্যক্রম চলমান রাখেন।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে বাংলাদেশ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অথরিটির (বিপিপিএ) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সোহেলের রহমান চৌধুরীকে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।
এসআর/এমজে