সনদ বাণিজ্যে জড়িত বহু রাঘব-বোয়াল, শিগগিরই গ্রেপ্তার করবে ডিবি
কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সনদ জালিয়াতির ঘটনায় একের পর এক বেরিয়ে আসছে অনেক উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তার নাম। এ জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত আছেন সরকারের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরাও। শিগগিরই এসব রাঘব-বোয়ালদের গ্রেপ্তার করা হবে বলে জানিয়েছে ডিবি।
সনদ বাণিজ্যের ঘটনায় জড়িতদের মধ্যে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে আলোচিত নাম হলো কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. আলী আকবর খানের স্ত্রী সেহেলা পারভীন (৫৪)। ইতোমধ্যে তাকে গ্রেপ্তার করেছে ডিবি। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হয়েছে বোর্ড চেয়ারম্যান আলী আকবরকেও।
সোমবার (২২ এপ্রিল) এক সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান আলী আকবর খানকে গতকাল রোববার ওএসডি করা হয়েছে। আগামীকাল মঙ্গলবার তাকে ডিবি অফিসে ডাকা হয়েছে। এতে তার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে গ্রেপ্তার করা হবে। এছাড়া এ ঘটনায় যাদের নাম এসেছে পর্যায়ক্রমে সবাইকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
সনদ বাণিজ্যের ঘটনায় রাজধানীর মিরপুর মডেল থানায় মামলা হয়েছে। এই মামলায় এখন পর্যন্ত কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের কম্পিউটার সেলের সিস্টেম অ্যানালিস্ট একেএম শামসুজ্জামান, তার ব্যক্তিগত সহকারী ফয়সাল, কুষ্টিয়া গড়াই সার্ভে ইন্সটিটিউটের পরিচালক সানজিদা আক্তার কলি, কামরাঙ্গীরচর হিলফুল ফুজুল টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিএম কলেজের অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান ও ঢাকা টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের পরিচালক মো. মাকসুদুর রহমান ওরফে মামুনকে গ্রেপ্তার করেছে ডিবি লালবাগ বিভাগ।
ডিবি সূত্রে জানা যায়, গ্রেপ্তারদের পাশাপাশি জালিয়াতির সঙ্গে আরও বড় রাঘব-বোয়াল জড়িত আছেন। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালকসহ কমপক্ষে আরও ৩০ জন এই সনদ জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত থাকার তথ্য পেয়েছে ডিবি। তাদের বিষয়ে তথ্য যাচাই-বাছাই চলছে। তাদের তালিকা করে দ্রুত গ্রেপ্তার করা হবে।
এ বিষয়ে ডিবি লালবাগ বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মশিউর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, এই দুর্নীতির খনির ভেতরে আমরা ধীরে ধীরে প্রবেশ করছি। এখানে আমাদের আরও কাজ বাকি রয়েছে। এ ঘটনায় যারা জড়িত আছেন তাদের তালিকা করা হচ্ছে। যারাই এর সঙ্গে জড়িত আছেন তাদের সবাইকে দ্রুত গ্রেপ্তার করা হবে।
এখন পর্যন্ত যাদের নাম উঠে এসেছে
গ্রেপ্তার হওয়া ৬ জন ছাড়া সার্টিফিকেট জালিয়াতির সঙ্গে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের আরও তিন কর্মকর্তার নাম পাওয়া গেছে। তারা হলেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সিবিএ নেতা আব্দুল বাছের, রেজিস্ট্রেশন শাখার অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোগ্রামার মামুনুর রশীদ ও বোর্ডের উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক জাকারিয়া আব্বাস। তারা বিভিন্ন সময় বোর্ডের কম্পিউটার সেলের সিস্টেম অ্যানালিস্ট একেএম শামসুজ্জামানকে শিক্ষার্থীদের রেজাল্ট পরিবর্তন ও জাল সার্টিফিকেট তৈরি করার কথা বলতেন। তাদের দাবি অনুযায়ী শামসুজ্জামান সনদ তৈরি করে দিতেন এবং রেজাল্ট পরিবর্তন করে দিতেন। এজন্য তারা শামসুজ্জামানকে কোনো টাকা দিতেন না। একই বোর্ডের লোক হওয়ায় শামসুজ্জামান তাদের কাছে টাকা চাইতে সাহস পেতেন না।
আরও পড়ুন
তদন্ত সূত্রে আরও জানা যায়, বোর্ডের আরও অনেক কর্মকর্তা এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত আছেন। তাদের নাম জানার জন্য ডিবি তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে।
নাম উঠে আসছে দুদক কর্মকর্তাদেরও
সার্টিফিকেট দুর্নীতির সঙ্গে খোদ দুদক কর্মকর্তাদের নামও উঠে আসছে। দুদকের দুই উপ-পরিচালাক মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে সার্টিফিকেট জালিয়াতির মামলায় এই ঘটনার মূলহোতা শামসুজ্জামানকে অব্যাহতি দেন বলে জানতে পেরেছে ডিবি।
তদন্ত সূত্রে জানা যায়, শামসুজ্জামানের সার্টিফিকেট দুর্নীতি সংক্রান্ত একটি মামলা হয় দুদকে। দুদকের উপ-পরিচালক পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা মামলার তদন্তের জন্য শামসুজ্জামানকে ডাকেন। এরপর থেকে দুদকের ঐ কর্মকর্তাকে বিভিন্নভাবে ম্যানেজ করার চেষ্টা করেন শামসুজ্জামান। কিন্তু ম্যানেজ করতে না পেরে দুদকের উপ-পরিচালক পদমর্যাদার আরেক কর্মকর্তার দারস্থ হন শামসুজ্জামান। সেই কর্মকর্তা শামসুজ্জামানকে তার বাড্ডার বাসায় ডেকে নেন। তিনি শামসুজ্জামানকে বলেন, এখন যে কর্মকর্তার কাছে মামলার তদন্তভার আছে তাকে ম্যানেজ করা যাবে না। তাই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন করতে হবে। এর জন্য তাকে ৩০ লাখ টাকা দিতে হবে। শামসুজ্জামান ৩০ লাখ টাকার ডলার কিনে তাকে দেন। টাকা দেওয়ার পর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন করা হয়।
নতুন তদন্ত কর্মকর্তা হন দুদকের উপ-পরিচালক পদ মর্যাদার আরেকজন। তিনি প্রায় ১০ লাখ টাকা ঘুষ নিয়ে শামসুজ্জামানকে দুদকের মামলা থেকে অব্যাহতি দেন।
যেভাবে সংগ্রহ হতো সার্টিফিকেটের আসল কাগজ
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে প্রধান অভিযুক্ত শামসুজ্জামান জানান, কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সনদের কাগজ প্রতি বান্ডিলে ৫০০টি করে থাকে। বান্ডিল করা এসব কাগজ শামসুজ্জামান শিক্ষা বোর্ডের অফিস থেকে সংগ্রহ করতেন। তবে তার কাছে জাল সার্টিফিকেট তৈরির এত চাহিদা থাকত যে বোর্ড অফিসের কাগজ পর্যাপ্ত হতো না। কাগজের জোগান ঠিক রাখতে রাজধানীর পুরান ঢাকা ও রংপুরের একটি প্রেসের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাদেরকে আসলে কাগজের নমুনা দেখানোর পর তারা হুবহু সার্টিফিকেটের কাগজ তৈরি করে দিতেন শামসুজ্জামানকে।
শামসুজ্জামান প্রতিদিন অফিস শেষ করে বাসায় গিয়ে এসব কাগজ দিয়ে জাল সার্টিফিকেট তৈরি করতেন। সার্টিফিকেট প্রিন্ট করার কাজ করতেন তার ব্যক্তিগত সহকারী ফয়সাল। রাজধানীর পীরেরবাগ এলাকায় একটি বাসা ভাড়া নেওয়া হয়েছিল সার্টিফিকেট প্রিন্ট করার জন্য। সেখানে এসব জাল সার্টিফিকেট প্রিন্ট করতেন ফয়সাল। তারপর কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের ওয়েব সাইটে গিয়ে এসব জাল সার্টিফিকেট আপলোড করে দিতেন শামসুজ্জামান। আপলোড করার পর এসব সার্টিফিকেট বিশ্বের যেকোনো জায়গা থেকে ভেরিফাই করা যেত।
যেভাবে জাল সার্টিফিকেট তৈরির কলাকৌশল শেখেন শামসুজ্জামান
জিজ্ঞাসাবাদে শামসুজ্জামান জানান, তিনি ২০১৪ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত জাল সার্টিফিকেট তৈরি করা শেখেন। মোহাম্মদ শামসুল আলম নামে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের এক সিস্টেম অ্যানালিস্টের কাছ থেকে এই জালিয়াতি শেখেন তিনি। শামসুল আলম বিভিন্ন সময় ডিপ্লোমা পরীক্ষার সার্টিফিকেট জালিয়াতি করতেন। তিনিও শিক্ষার্থীদের কাছে জাল সার্টিফিকেট বিক্রি করতেন। ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পরীক্ষায় যেসব শিক্ষার্থীরা পাস করতে পারত না তাদের নম্বর বাড়িয়ে দিয়ে পাস করিয়ে দিতেন শামসুল হোক। তার কাছ থেকে শিখে শামসুজ্জামান এসএসসি ও ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পরীক্ষার্থীদের জাল সার্টিফিকেট বানানোসহ পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বর বাড়িয়ে দেওয়ার কাজ করতেন।
কত টাকায় বিক্রি হতো জাল সার্টিফিকেট?
ডিবি সূত্রে জানা যায়, শিক্ষার্থীরা প্রথমে দালালদের সঙ্গে যোগাযোগ করত। দালালরা শমসুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করত। সনদ প্রতি ৩০ হাজার থেকে শুরু করে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত নিতেন শামসুজ্জামান। এ ব্যাপারে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালকেরাও যোগাযোগ করতেন তার সঙ্গে। পরিচালকরা সার্টিফিকেট প্রতি ৩০-৫০ হাজার টাকা দিতেন। তারা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আরও মোটা অঙ্কের টাকা নিতেন। প্রায় ৩০ জনের মতো দালাল ও প্রতিষ্ঠান পরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে শামসুজ্জামানের। নরসিংদী, ময়মনসিংহ, খুলনা, দিনাজপুর, গাজীপুর, ঢাকা ও কিশোরগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার দালালরা ও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালকরা তার কাছ থেকে সার্টিফিকেট বানিয়ে নিতেন।
এমএসি/এমএ