আসছেন ব্রাজিলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ‘বাণিজ্যে’ চোখ দুই দেশের
দুদিনের সফরে রোববার (৭ এপ্রিল) ঢাকায় আসছেন ব্রাজিলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাউরো ভিয়েরা। তার সফরে দেশটির সঙ্গে কারিগরি সহযোগিতা সংক্রান্ত একটি চুক্তি সই করবে বাংলাদেশ। তবে বাংলাদেশের এবং ব্রাজিলের দুপক্ষেরই মূল ‘ফোকাস’ থাকবে বাণিজ্য সম্পর্ক বাড়ানোর ওপর।
বাংলাদেশের মানুষের কাছে ব্রাজিল মানেই ফুটবল হলেও দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রথম ঢাকা সফরে এ নিয়ে কোনো কর্মসূচি থাকছে না। তার দুদিনের সফরের পুরোটাই বাণিজ্যিক আলাপ-আলোচনায় কাটবে।
ব্রাজিল পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরকে কাজে লাগাতে ঢাকা বেশ কিছু এজেন্ডা হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- ব্রাজিলে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়া, ওষুধ রপ্তানি, ইথানল আমদানি বা দেশে ইথানল উৎপাদনে সহায়তা, সুনীল অর্থনীতির ক্ষেত্রে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরা ও সামুদ্রিক পর্যটনে সহায়তা।
আরও পড়ুন
অন্যদিকে ব্রাসিলিয়াও এ সফর থেকে লাভবান হতে চায়। তারা বাংলাদেশে গরুর মাংস রপ্তানি, ইথানল রপ্তানি, তুলার রপ্তানি বাড়ানো, পোলট্রি ও ফিশ ফিড বিক্রি করার প্রস্তাব দেবে বলে জানা গেছে।
তৈরি পোশাকে শুল্কমুক্ত সুবিধা চায় বাংলাদেশ
ব্রাজিলে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশকে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়। ব্রাজিলে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরে দেশটিতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকে রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা চাইবে জানিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ব্রাজিল থেকে প্রায় ৫০ কোটি ডলারের তুলা আমদানি করলেও ওই বাজারে আমরা কোনো শুল্কমুক্ত সুবিধা পাই না। বাংলাদেশকে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়। আমরা এই শুল্কটা দিতে চাই না। অথবা যে পরিমাণ তুলা আমদানি করা হয় সেটি দিয়ে যে কাপড় তৈরি হবে সেটি শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে। কিংবা তুলা আমদানির সমপরিমাণ পণ্যের ওপর শুল্কমুক্ত সুবিধা-- এরকম কিছু চাই আমরা।
ইথানল আমদানি বা উৎপাদনে সহায়তা
ভিয়েরার সফরে ইথানল সরবরাহের জন্য ব্রাজিলের সহযোগিতা চাইবে বাংলাদেশ। এ প্রসঙ্গে এ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তা বলেন, বায়ো-ফুয়েল বা ইথানল সরবরাহের জন্য ব্রাজিলের সহযোগিতা চাইবে বাংলাদেশ। ব্রাজিলের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফরের সময়ে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা হবে। আমরা তাদের কাছ থেকে ইথানল আমদানি করতে পারি। পাশাপাশি ইথানল উৎপাদনে যে প্রযুক্তি সে বিষয়ে তাদের সহযোগিতা চাইতে পারি।
এ কূটনীতিক বলেন, ইথানল একটি কার্যকর জ্বালানি এবং এমন শক্তি উৎপাদন করতে সক্ষম যা গাড়ি, জেনারেটর বা অন্য মেশিনে ব্যবহার করা যায়। ব্রাজিলে ভুট্টা ও আখ থেকে ইথানল তৈরি হয়। এটি ব্রাজিলের সব গাড়িতে এবং অন্যান্য মেশিনে ব্যবহার করা হয়। এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে এর খরচ প্রচলিত জ্বালানির অর্ধেক বা তারও কম এবং এটি অত্যন্ত কম পরিমাণে পরিবেশ দূষণ করে।
অন্যান্য যেসব সুবিধা চায় বাংলাদেশ
বাংলাদেশ সুনীল অর্থনীতির সুবিধা পেতেও ব্রাজিলের সহযোগিতা চাইবে জানিয়ে এ কর্মকর্তা বলেন, আমরা সুনীল অর্থনীতির ক্ষেত্রে তাদের সহযোগিতা বিশেষ করে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরা ও সামুদ্রিক পর্যটনে সহায়তা চাইতে পারি। আমরা কিন্তু আমাদের সমুদ্র সম্পদ আহরণ সেই অর্থে করতে পারছি না। আমরা ফিশিং-এর ক্ষেত্রে তাদের সহযোগিতা যেমন-ফিশিং টেকনোলজি ট্রান্সফার বা জয়েন্ট ভেঞ্চার হতে পারে। আমাদের চাওয়া, তারা এ খাতে বিনিয়োগ করুক।
এ কর্মকর্তা জানান, ব্রাজিল বড় একটি ব্যবসায়ীক প্রতিনিধিদল নিয়ে আসছে। ওই দলে পশুর খাদ্য তৈরি করে এমন ব্যবসায়ীক কোম্পানির লোকও আসবে। তাদের এক্সপার্ট আসবে আমাদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলতে। পশু খাদ্য তৈরি করার ক্ষেত্রে আমরা তাদের থেকে প্রযুক্তিগত সহযোগিতা চাইতে পারি।
৪৯৫ টাকা কেজি দরে গরুর মাংস দিতে চায় ব্রাজিল
বাংলাদেশে গরুর মাংস রপ্তানি করতে চায় ব্রাজিল। দেশটি ৪৯৫ টাকা কেজি দরে বাংলাদেশকে গরুর মাংস দিতে চায়। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট এক কূটনীতিক বলেন, ব্রাজিল ৪ থেকে ৫ ডলারের মধ্যে হালাল গরুর মাংস সরবরাহ করার প্রস্তাব করেছে। ব্রাজিলের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরে তারা এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দেবে। ব্রাজিলের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে যে ব্যবসায়ী দল আসবে তাদের মধ্যে কয়েকজন গরুর মাংস রপ্তানিকারকও থাকবেন।
তিনি বলেন, ব্রাজিল থেকে গরুর মাংস আনার ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই। তবে আমাদের প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় মনে করে, মাংস আমদানি করা হলে দেশীয় শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমরা গরুর মাংস ব্রাজিল থেকে আনব কি না সে সিদ্ধান্ত এ সফরে হবে বলে মনে হয় না।
এছাড়া ব্রাজিল বাংলাদেশে পোলট্রি ও ফিশ ফিড বিক্রি করার প্রস্তাব দেবে জানিয়ে এ কূটনীতিক বলেন, ব্রাজিল বাংলাদেশের পোলট্রি খাতে বিনিয়োগ করতে চায়। তারা চায় আমরা তাদের কাছ থেকে দুধেল গরু এবং মাংসের গরু নিয়ে আসি। তাদের গরুগুলো কমপক্ষে ৪০ লিটারের মতো দুধ দেয়। আর তারা চায় আমরা যেন তাদের কাছ থেকে পশু খাদ্য এবং মাছের খাদ্য কিনি।
এ কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশ ব্রাজিল থেকে প্রধানত সয়া, সয়াবিন তেল, তুলা ও চিনি আমদানি করে এবং এর পরিমাণ প্রায় ২৫০ কোটি ডলার। বাংলাদেশে প্রায় ৫০ কোটি ডলারের তুলা রপ্তানি করে ব্রাজিল। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরে দেশটি চাইবে বাংলাদেশ যেন তাদের কাছ থেকে আরও বেশি পরিমাণে তুলা নেয়।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ গত মঙ্গলবার তার দপ্তরে ব্রাজিলের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আসন্ন সফরটিকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে অভিহিত করেছেন।
তিনি বলেন, ব্রাজিলের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরে আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের পাশাপাশি বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়বে। ব্রাজিল থেকে আমরা ভোজ্য তেল ও অন্যান্য পণ্য আমদানি করি। দক্ষিণ আমেরিকায় আমাদের রপ্তানি অনেকটাই এখনো আন–এক্সপ্লোরড রয়ে গেছে। ব্রাজিল বড় দেশ, তাদের ক্রয়ক্ষমতাও বেশি। ফলে তাদের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক বৃদ্ধির ব্যাপক সুযোগ রয়েছে।
রোববার সকালে বড় একটি ব্যবসায়ীক প্রতিনিধিদল নিয়ে ঢাকায় আসবেন ব্রাজিলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এটি হবে প্রথম ব্রাজিলিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফর। বিমানবন্দরে তাকে স্বাগত জানাবেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন।
ব্রাজিলের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফরের প্রথম কর্মসূচি শুরু হবে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানানোর মধ্য দিয়ে। পরে তিনি বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটুর সঙ্গে বৈঠকে বসবেন। এরপর রোববার বিকেলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন ভিয়েরা। ওই বৈঠকে দুদেশের মধ্যে কারিগরি সহযোগিতা সংক্রান্ত চুক্তি সই হবে।
পরদিন সোমবার (৮ এপ্রিল) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন ব্রাজিলিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ওইদিনই ঢাকা ছেড়ে যাবেন তিনি।
এনআই/এমএসএ