কারাগারের বাইরের জীবন এত কঠিন কেন, জল্লাদ শাহজানের প্রশ্ন
কারাগারের বাইরে জীবন এত জটিল কেন– এমন প্রশ্ন করেছেন আলোচিত জল্লাদ শাহজাহান। সোমবার (১ এপ্রিল) জাতীয় প্রেস ক্লাবে নিজের জেল-পরবর্তী জীবনের অভিজ্ঞতা ও নানা প্রতারণার ঘটনা জানাতে সংবাদ সম্মেলনে এসে এ প্রশ্ন করেন তিনি।
জল্লাদ শাহজাহান বলেন, জীবন এত কঠিন হবে জানলে কারাগারেই থেকে যেতাম। জেল থেকে বের হয়ে নানাভাবে প্রতারিত হয়েছি। সাথী আক্তার নামের ২৩ বছরের একটি মেয়েকে বিয়ে করে প্রতারিত হয়েছি। মেয়েটি আমার সব টাকা আত্মসাৎ করে উল্টো আমার নামে মামলা দিয়েছে।
তিনি বলেন, জেল থেকে বেরিয়ে দেখছি, এ সমাজে চলতে গিয়ে প্রতারণার মধ্যে পড়তে হচ্ছে আমাকে। আমি কল্পনাও করতে পারিনি। বাইরের লোকের সম্পর্কে আমার এমন ধারণা ছিল না, তারা এতটুকু নির্দয় হতে পারে আমার জানা ছিল না। আমি জানতাম না এত প্রতারক বাংলাদেশে রয়েছে। আমি ২৩ বছর বয়সে জেলে গিয়েছি, ৪৪ বছর কারাভোগ শেষে এসে এক অন্যরকম দেশ দেখছি।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে শাহজাহান বলেন, মানুষের বেঁচে থাকার জন্য দরকার খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা। এগুলোর কোনোটিই আমি পাচ্ছি না। আমি আমার মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে আপনাদের সামনে উপস্থিত হয়েছি। আমার মা-বাবা নেই, দায়িত্ব নেওয়ার মতো ভাই-বোন নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিত্তবানদের কাছে আমার বিনীত অনুরোধ, আমাকে থাকার ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিন।
আরও পড়ুন
তিনি বলেন, আমি চরম অর্থনৈতিক সংকটে আছি। আমার কাজ করার মতো ক্ষমতা নেই, আয়-রোজগার নেই, অর্থের যোগানদাতা নেই, নিজের থাকার জায়গা নেই। ৪৪ বছর কারাভোগ শেষ করে এসে আমি এখন বাইরের মানুষদের বুঝতে পারছি না। যেখানেই যাচ্ছি প্রতারণার খপ্পরে পরছি। গত বছরের ২১ ডিসেম্বর বিয়ে করে সেখানেও সর্বস্বান্ত হয়েছি। বিয়ের কাবিন ৫ লাখ টাকা হলেও আমার কাছে থাকা ১০ লাখ টাকা স্ট্যাম্পে লিখিত দিয়ে আমার স্ত্রী সাথী আক্তার ফাতেমা ৫৩ দিনের মাথায় পালিয়ে গেল। পালিয়ে গিয়ে আমার নামে যৌতুকের মামলা দিল। আমি থানায় মামলা দিতে গেলেও বউয়ের নামে মামলা করা যায় না বলে আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। পরে আইনজীবীর সহযোগিতায় রোববার (৩১ মার্চ) আদালতে আমার স্ত্রী, শাশুড়িসহ ৬ জনের নামে মামলা করেছি।
জল্লাদ শাহজাহান বলেন, ৪৪ বছর কারাবন্দি থেকে বাইরে এসে নানা প্রতারণায় পড়ে মনে হচ্ছে কারাগারেই ভালো ছিলাম। কারাগারের বাইরের জীবন এত জটিল কেন? জীবন এত কঠিন হবে জানলে কারাগারেই থেকে যেতাম।
জেল থেকে বের হওয়ার পরের অভিজ্ঞতা জানিয়ে তিনি আরও বলেন, কারাগার থেকে বের হলে আমার ভাগিনা নজরুল আমাকে অটোরিকশা কিনে দেবে বলে আমার টাকা মেরে দেয়। এরপর অনেক কষ্টে একটা চায়ের দোকান দিই। আমার সঙ্গে যে ছেলেটি দোকানে সময় দিত, সে ৪ মাস আমার সঙ্গে থাকার পর দোকানে থাকা ৩০ হাজার টাকা ও মোবাইল চুরি করে নিয়ে যায়।
জল্লাদ শাহজাহান বলেন, আমি এখন উভয় সংকটে জীবনযাপন করছি। একে তো আমার অচল অর্থনৈতিক অবস্থা, অন্যদিকে একজন নারী আমার জীবনের শেষ জমানো টাকা নিয়ে পালিয়ে গিয়েছে এবং আমাকে যৌতুকের মামলা দিয়ে হয়রানি করছে। অথচ আমার কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা নেওয়ার সময় স্ট্যাম্পে লিখিত দিয়েছে, যার সব প্রমাণ আমার হাতে রয়েছে।
তিনি বলেন, ২০২৩ সালের ১৮ জুন কারামুক্তির পর আমি ঢাকার কেরাণীগঞ্জের গোলামবাজারে বসবাস শুরু করি। এরপর সেখানে একটি চায়ের দোকান দিয়ে কোনো মতো দিনযাপন করার চেষ্টা করি। একদিন সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে কেরাণীগঞ্জের কদমতলী থেকে কোনাখোলায় যাচ্ছিলাম। তখন গাড়ির ভেতরে আমি একটি ভ্যানিটি ব্যাগ খুঁজে পাই। ব্যাগের ভেতরে থাকা কাগজে লেখা ছিল একটি মোবাইল নম্বর। সেই নম্বরে ফোন করে আমি ভ্যানিটি ব্যাগের মালিককে ব্যাগ নিয়ে যেতে বলি। পরে ব্যাগের মালিক ২৩ বছর বয়সী সাথী আক্তার ফাতেমা নামের একটি মেয়ে তার বান্ধবীকে নিয়ে কেরাণীগঞ্জের গোলামবাজারে হাজির হয়। এরপর মেয়েটির মা শাহিনূর বেগমের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। মোবাইল ফোনে পরিচয়ের পর মেয়েটির সঙ্গে আমি বেশ কয়েকবার কথা বলি। একপর্যায়ে মেয়েটি ও তার মা জুরাইন থেকে কেরাণীগঞ্জের গোলামবাজারে চলে আসে। আমার বাসায় তিনি রান্নার কাজ নেন। পরিচয়ের দেড় মাস পর ২১ ডিসেম্বর মেয়েটির সঙ্গে পাঁচ লাখ টাকা দেনমোহরে আমার বিয়ে হয়।
জল্লাদ শাহজাহান বলেন, মেয়ে ও তার মা বিয়ের আগে নানা কৌশলে আমার কাছ থেকে দেড় লাখ টাকা নেয়। আর বিয়ের দিন ১০০ টাকার তিনটি স্ট্যাম্পে একটি অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করে আমার গোছানো আরও ১০ লাখ টাকা নেয়। বিয়ের প্রায় দুই মাসের মাথায় আমার স্ত্রী বাসায় থাকা আরও ৫ লাখ নগদ টাকা ও গহনা নিয়ে বাসা থেকে পালিয়ে যায়। আমি এ বিষয়ে অভিযোগ করতে গেলে থানা অভিযোগ নেয়নি। পরে জানতে পারি ১৫ ফেব্রুয়ারি সাথী আক্তার ফাতেমা আমার বিরুদ্ধে ঢাকার আদালতে যৌতুক নিরোধ আইনে নালিশি মামলা করেছে। মামলায় সে দাবি করেছে, বিয়ের যৌতুক হিসেবে আমাকে এক লাখ টাকার মালামাল দেয় তার পরিবার। পাশাপাশি নগদ ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। আমি নাকি তার থেকে তিন লাখ টাকা যৌতুক দাবি করেছি। অথচ সে আমার টাকা প্রতারণা করে নিয়ে গেছে, সেটার প্রমাণ আমার হাতে আছে। তাই এসব প্রমাণ নিয়ে আমি গতকাল রোববার আদালতে সাথী আক্তার ফাতেমাসহ ৬ জনের নামে মামলা করেছি। বিজ্ঞ আদালত মামলাটি পিবিআইকে তদন্ত করতে নির্দেশনা দিয়েছেন।
তিনি বলেন, কারাগার থেকে ছাড়া পাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে আমাকে পাঁচ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছিল। আর কারাগারে থাকা অবস্থায় বিভিন্ন শুভাকাঙ্ক্ষীর কাছ থেকে আশীর্বাদ হিসেবে পাওয়া টাকাসহ মোট ১৮ লাখ টাকা আমি সাহায্য হিসেবে পাই। সেই টাকা দিয়েই মূলত আমি বিয়ে করে এখন সর্বস্বান্ত হয়ে গেছি। আমি এখন কীভাবে বাঁচব, আমার জীবন কীভাবে চলবে, কোথায় থাকব কিছুই বুঝতে পারছি না। এখন খেয়ে না খেয়ে অনাহারে আমার জীবন চলছে।
এই জল্লাদ বলেন, আমি এখন দুই/তিন দিন পর ভাত খাই। কেউ আমাকে খাবার দিলে খাই, না দিলে না খেয়ে থাকি। আমার থাকার জায়গা নেই। তাই ফুটপাতে, গ্যারেজে বা কেউ সাময়িক আশ্রয় দিলে সেখানে থেকে খুব কষ্টে সময় পার করছি। আমি আমার উপজেলা চেয়ারম্যান, এমপির কাছে গিয়েছি কিন্তু কেউ আমাকে এক মুঠো ভাত দেয়নি, কাজ দেয়নি, সাহায্য-সহযোগিতা করেনি। এভাবে চলতে থাকলে আমার আত্মহত্যা করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।
জল্লাদ শাহজাহান বলেন, শেখের বেটির কাছে আমার চাওয়া, ঘৃণ্য অপরাধীদের ফাঁসি দেওয়ার পুরস্কার হিসেবে অমাকে একটি আবাসন ও জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত যেন চলতে পারি সেজন্য সহজ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিন। সমাজের বিত্তবানদের কাছেও আমার একই দাবি। আমার এ অসহায়ত্বের অবসান চাই। দয়া করে আমাকে বাঁচান।
এমএসি/এসএসএইচ