‘লোকোমাস্টার হিসেবে কাজ করা নারীর জন্য প্রতিকূল’
কু ঝিক ঝিক শব্দে মাঠঘাট পেরিয়ে এগিয়ে চলছে ট্রেন। চালকের আসনে বসে আছেন একজন নারী...
আজ থেকে ২০ বছর আগে বাংলাদেশ রেলওয়েতে এ দৃশ্য ছিল কাল্পনিক। এখন বাস্তব। কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরের মেয়ে ছালমা খাতুন।
অভাবী পরিবারের হাল ধরতে ২০০৪ সালে তিনি প্রথম নারী সহকারী লোকোমাস্টার হিসেবে বাংলাদেশ রেলওয়েতে যোগ দেন। ২ বছরের প্রশিক্ষণ শেষে লোকোমাস্টারের সঙ্গে লোহার তৈরি যন্ত্রাংশের দানব আকৃতির লোকোমোটিভ (ইঞ্জিন) নিয়ন্ত্রণের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন তিনি। নারীর জন্য প্রতিকূল পেশাটি তিনিই প্রথম জয় করেন এই বাংলাদেশে।
এইচএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পাশ করে রেলওয়েতে যোগ দেওয়া ছালমা খাতুন এখন ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা রুটে নিয়মিত যাত্রীবাহী ট্রেন চালাচ্ছেন। ট্রেন চালানোর পাশাপাশি নিজের পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন তিনি। ঢাকার কবি নজরুল সরকারি কলেজ থেকে অর্জন করেছেন স্নাতকোত্তর ডিগ্রী। বর্তমানে তিনি পদোন্নতি পেয়ে রেলওয়েতে লোকোমাস্টার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। একইসঙ্গে স্বামী ও দুই মেয়ের সংসারও সামলাচ্ছেন সমানতালে।
আরও পড়ুন
আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রথম নারী ট্রেনচালক ছালমা খাতুনের সঙ্গে কথা বলেছে ঢাকা পোস্ট।
ঢাকা পোস্ট : নারী হিসেবে বাংলাদেশ রেলওয়ের এই চ্যালেঞ্জিং পেশায় যোগদানের বিষয়টি কীভাবে মাথায় এলো?
ছালমা খাতুন : বাবা যতদিন সুস্থ ছিলেন বাবা-মা, ভাই-বোন মিলে ৭ জনের পরিবার খুব ভালোভাবেই চলছিল। তিনি অসুস্থ হওয়ার পর পরিবাবের ব্যয় নির্বাহ করাটা একটু মুশকিল হয়ে গিয়েছিল। তখন আমি এইচএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পাশ করেছি কেবল। এসময় একদিন আমার ভাই এসে জানাল রেলওয়েতে সার্কুলার হয়েছে, তুমি আবেদন করতে পার। তোমার তো এমন একটা চাকরির ইচ্ছে ছিল। পরে সেখানে আবেদন করলাম।
ঢাকা পোস্ট : স্কুলে পড়ার সময় কোন পেশায় যাওয়ার ইচ্ছে ছিল?
ছালমা খাতুন : আমি গ্রামের পরিবেশে বড় হয়েছি। তাই খুব বেশি প্রত্যাশা নিয়ে বড় হয়েছি এটা বলতে পারব না। তবে শুধু এটুকু জানতাম, আমি নিজে কিছু একটা করব। এই আকাঙ্খাটাই আমার সবচেয়ে বেশি ছিল। কারণ, গ্রামে এসএসসি/এইচএসসির পর মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায়। আমার আশপাশে কাজিন এবং সহপাঠী যারা ছিল তাদের সবারই প্রায় বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। তবে আমার তখন বিয়ে করার কোনো চিন্তা ছিল না। আমাকে কিছু একটা করতে হবে- সেটা ভাবনায় ছিল।
ঢাকা পোস্ট : আপনার বেড়ে ওঠা কোথায়? এখন কোথায় থাকছেন?
ছালমা খাতুন : আমার ছোটবেলার বেড়ে ওঠা গ্রামে। টাঙ্গাইল জেলার ভুয়াপুর থানার অর্জুনা গ্রামে আমাদের বাড়ি। জন্ম, শৈশব-কৈশোর থেকে শুরু করে এসএসসি পরীক্ষা দেওয়া পর্যন্ত আমি আমার ওই গ্রামেই ছিলাম। বর্তমানে আমি স্বামী-সন্তান নিয়ে শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনিতে থাকছি।
ঢাকা পোস্ট : পড়াশোনার পুরো অধ্যায় সম্পর্কে জানতে চাই।
ছালমা খাতুন : ভুয়াপুরের অর্জুনা মহসীন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে আমি এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছি ২০০০ সালে। কুমুদিনী সরকারি কলেজ থেকে ২০০২ সালে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছি। সেখানে আমি বিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা করেছিলাম। পরে সেখানেই আমি প্রাণিবিদ্যা বিষয়ে অনার্সে ভর্তি হই। ৪-৫ মাসের মতো সেখঅনে ক্লাস করেছি। এরপর আমার রেলওয়েতে চাকরি হয়ে যায়।
আরও পড়ুন
এরপর দুই বছর ট্রেনিং করি। সেই সময়টাতে আমার পড়াশোনা বন্ধ ছিল। এরও দুই-তিন বছর পর আমি ঢাকা টিএন্ডটি কলেজে বিএসএস-এ ভর্তি হই। সেখান থেকে বিএসএস পাশ করি। ঢাকা মডার্ন টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে বিএড করি। তারপর আমি কবি নজরুল সরকারি কলেজ থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করি। এগুলো সবই আমি করেছি চাকরিতে যোগদান করার পর।
ঢাকা পোস্ট : আপনি সহকারী লোকোমাস্টার হিসেবে কবে প্রথম ট্রেনে উঠেছিলেন?
ছালমা খাতুন : ট্রেনিং শেষ হওয়ার আগেই ২০০৫ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি লাকসাম থেকে নোয়াখালী রুটের একটি ট্রেনে আমি কাজ করেছিলাম। যেটার মাধ্যমে সবাই জানল বাংলাদেশ রেলওয়েতে একজন নারী সহকারী লোকোমাস্টার যোগ দিয়েছেন।
ঢাকা পোস্ট : সেদিনের অভিজ্ঞতাটা কেমন ছিল?
ছালমা খাতুন : অন্যান্য দিনের মতো সেদিন আমি ডিউটিতে গিয়েছিলাম। তারপর সেখানে আমাকে জানানো হলো আপনাকে ট্রেনে কাজ করতে হবে। তখন আমি বললাম, আমি তো সেকশন চিনি না। আর সেভাবে প্রিপারেশন নিয়েও আসিনি। তখন আমাকে বলা হলো, আপনি লোকোমাস্টারের সঙ্গে যাবেন, কোন অসুবিধা হবে না। তারপর আমি বললাম, ঠিক আছে। আসলে সেই অভিজ্ঞতাটা বলে বোঝানো যাবে না। ওইদিন আমি কিছুটা ভীত ছিলাম। পরবর্তীতে ট্রেনিং শেষে যোগদান করে সহকারী লোকোমাস্টার হিসেবে ট্রেন পরিচালনা করি।
ঢাকা পোস্ট : ট্রেন চালানোর প্রধান দায়িত্ব কবে পান, সেদিনের অভিজ্ঞতাটা একটু বলুন...
ছালমা খাতুন : সাড়ে ১৩ বছর সহকারী লোকোমাস্টার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আমি পদোন্নতি পেয়ে লোকোমাস্টার হই। এরপর ২০১৭ সালের ৯ সেপ্টেম্বর আমি প্রথম ট্রেন অপারেশনে যাই। সেটা ছিল ঢাকা-গাজীপুর-ঢাকা রুটের ডেমো ট্রেন। ঐদিন আমি প্রথম ট্রেন নিয়ে গিয়েছি। এটা আমার কাছে অন্যরকম একটা অভিজ্ঞতা ছিল। আমি টেনশনে সারারাত ঘুমাতে পারিনি। সকাল আটটায় ডিউটি শুরু হবে, দশটার সময় যাত্রীবাহী ট্রেন নিয়ে অপারেশনে যাব। কীভাবে ট্রেন অপারেশন করব, আমি কি নিয়ে যেতে পারব? ঠিক সময়ে আমি সেকশন ক্লিয়ার করতে পারব কি না, মানুষজনকে নিরাপদে পৌঁছাতে পারব কি না এগুলো ভাবতে ভাবতে আমি আর রাতে ঘুমাতে পারিনি। ওই ট্রেনে আমার সহকারী ছিলেন নজরুল ইসলাম।
ঢাকা পোস্ট : সরকারী লোকোমাস্টার পদে নারীদের মধ্যে আরও যারা আসতে চান, তাদের উদ্দেশ্যে কী বলবেন?
ছালমা খাতুন : যারা নতুন আসতে চায় তাদেরকে আমরা অবশ্যই স্বাগত জানাব। এটা অনেক চ্যালেঞ্জিং একটা পেশা। যেখানে ছেলেরাই মাঝেমধ্যে হিমশিম খেয়ে যায়। যদি কারও মনেপ্রাণে আগ্রহ থাকে, তবে এই পেশায় সে অবশ্যই ভালো করবে। কারণ এই পেশায় অনেক দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হয়। এই চাকরিটা নারীদের জন্য কিছুটা প্রতিকূল। ডিউটি শুরু হওয়ার পরে শেষ হবে কখন, সেটার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। এমনও অনেক দিন গেছে, আমি আজ সকালে বের হয়েছি, পরের দিন ভোর ৪টায় বাসায় ফিরেছি।
ঢাকা পোস্ট : সাপ্তাহিক ছুটির দিনে কী করে সময় কাটান?
ছালমা খাতুন : আমাদের কোনো সাপ্তাহিক ছুটির দিন নেই। ডিউটির ফাঁকে যতটুকু সময় থাকে, ততটুকুই আমার ছুটির সময়।
ঢাকা পোস্ট : আপনি বিয়ে করলেন কবে?
ছালমা খাতুন : আমি এই পেশায় যুক্ত হওয়ার অনেক পরে বিয়ে করেছি। ২০০৪ সালে এই পেশায় যুক্ত হয়েছি। এর ছয় বছর পর ২০১০ সালে আমার বিয়ে হয়েছে।
ঢাকা পোস্ট : নারী হয়ে ট্রেন চালাচ্ছেন, শশুর বাড়ি থেকে কোনো আপত্তি ছিল কি না?
ছালমা খাতুন : আমার শ্বশুরবাড়ি এবং নিজের বাড়ি কোথাও থেকেই কোনো আপত্তি ছিল না। বরং সবাই আমাকে আরও উৎসাহ দিয়েছেন, সাহস দিয়েছেন। আমার স্বামী ঢাকার জজ কোর্টে চাকরি করেন। উনি আমাকে সর্বোচ্চ সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছেন।
ঢাকা পোস্ট : আপনার সন্তান কয়টি?
ছালমা খাতুন : আমার দুই মেয়ে। বড় মেয়ের বয়স ১০ বছর, সে মতিঝিল আইডিয়ালে পড়ে। ছোট মেয়ের বয়স পাঁচ বছর।
ঢাকা পোস্ট : যেহেতু ছুটি থাকে না, পরিবারে সময় দেন কীভাবে?
ছালমা খাতুন : পরিবারকে সময় দেওয়াটা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা আসলে একদিন আগে জানতে পারি আগামীকাল কোথায় ডিউটি হবে। সেইভাবেই পরিবারকে সময় দেওয়া হয়।
ঢাকা পোস্ট : ঢাকা পোস্টকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
ছালমা খাতুন : ঢাকা পোস্টের জন্য শুভ কামনা।
/এমএইচএন/জেএস