১২ তলায় ১৩ রেস্টুরেন্ট! ধানমন্ডির ভোজনশালায় যত অনিয়ম
বেইলি রোড ট্র্যাজেডির পর রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা রেস্টুরেন্টগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে নানা আলোচনা চলছে। সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে অভিজাত এলাকা ধানমন্ডির ভোজনশালাগুলো নিয়ে। এই এলাকার প্রায় প্রতিটি অলিগলিতে রয়েছে ক্যাফে ও রেস্টুরেন্ট। কিছু ভবনের প্রতিটি ফ্লোরে রয়েছে রেস্তোরাঁ। এসব ভবনের প্রায় পুরোটাই কাচে ঘেরা। ফলে, বাইরে থেকে ভেতরে আলো-বাতাস ঢোকার কোনো ব্যবস্থা নেই। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে বা আগুন লাগলে কাচ ভাঙা ছাড়া ভেতরে পানি দেওয়ারও কোনো উপায় নেই।
ধানমন্ডির দুটি ভোজনশালা ভবনের একটি ‘রূপায়ন জেড আর প্লাজা’। ১২ তলা বিশিষ্ট এই ভবনে ১৩টি রেস্টুরেন্ট রয়েছে। এগুলো হচ্ছে— ধানমন্ডি কাবাব অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট, বাফেট লাউঞ্জ, অ্যালাউস, দ্য বাফেট এম্পায়ার, মুম্বাই এক্সপ্রেস, দায়মাসু রেস্টুরেন্ট, ফ্যাসিনো, হান্ডি, লাভা রেস্টুরেন্ট, দ্য ডার্ক ক্যাফে অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট, বাফেট প্যারাডাইস, অ্যালাউস গোর্মেট ও সাকিব রেস্তোরাঁ।
রোববার (৩ মার্চ) সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, এই ভবনের রেস্টুরেন্টগুলোতে আসা ভোজনরসিকরা চলাচলে শুধু লিফট ব্যবহার করেন। যদিও এখানে দুটি সিঁড়ি রয়েছে। সাধারণ সিঁড়িটির বিভিন্ন জায়গায় ময়লা-আবর্জনা ফেলে রাখা রয়েছে। কোনো কোনো রেস্টুরেন্ট সিঁড়ির জায়গায় সোফাসেট দিয়ে গ্রাহকদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। ফলে সিঁড়ি দিয়ে হাঁটাচলার পথ কিছুটা সরু হয়ে এসেছে। আর যেটিকে ইমার্জেন্সি সিঁড়ি বলা হয় সেটি সাধারণ মানুষের পক্ষে খুঁজে বেরা করা খুবই কষ্টদায়ক। কারণ, এই সিঁড়িটি ভবনের পেছনের দিকে। যার পাশে রয়েছে অধিকাংশ রেস্টুরেন্টের কিচেন। সাধারণত রেস্টুরেন্টে যাওয়া অতিথিরা কিচেনে যান না, আবার অনেক রেস্টুরেন্টের কিচেনে প্রবেশ সংরক্ষিত।
আরও পড়ুন
রেস্টুরেন্টগুলোর কিচেনে বাইরে থেকে আলো-বাতাস আসা-যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। কিচেনগুলো এসি এবং এগজস্ট ফ্যানের ওপর নির্ভর করে চলছে। আবার এক ভবনে অনেক রেস্টুরেন্ট হওয়ায় এবং প্রতিটি রেস্টুরেন্টে উপস্থিত খাবার তৈরি করে পরিবেশনের কারণে প্রায় ২৪ ঘণ্টা চুলা চালু রাখতে হচ্ছে। প্রতিটি রেস্টুরেন্টের কিচেনে রাখা হয়েছে একাধিক সিলিন্ডার। ফলে, অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটলে মুহূর্তের মধ্যে আগুন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ভবনের গ্রাউন্ড ফ্লোরে রয়েছে ধানমন্ডি কাবাব অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট। এটির কিচেন গ্রাউন্ড ফ্লোরে। সাধারণ মানুষের এই কিচেনে যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই।
ঢাকা পোস্টের প্রতিবেদক গোপনে সেই কিচেনে গিয়ে দেখতে পান অত্যন্ত নোংরা পরিবেশে খাবার রান্নার কাজ করছেন কয়েকজন কর্মী। পাশে একজন নারীকে দেখা গেছে— কাঁচা-পচা সবজির মধ্যে কিছু একটা খুঁজে বের করতে। আর ভবনের ৫ তলার হান্ডি রেস্টুরেন্ট সংযুক্ত রয়েছে লিফটের সঙ্গে। সেখানে ইমার্জেন্সি সিঁড়ির সামনে রাখা হয়েছে বেশ কয়েকটি পানির জার ও বালতি। ফলে, মানুষের বোঝার কোনো উপায় নেই— এদিকে ইমার্জেন্সি সিঁড়ি রয়েছে। শুধু এই দুটি নয়, ভবনের প্রতিটি রেস্টুরেন্টকে সিঁড়ির জায়গায় ময়লা-আবর্জনা ফেলে রাখতে দেখা গেছে।
এসব বিষয়ে প্রকাশ্যে কোনো কথা বলতে রাজি হননি রেস্টুরেন্টগুলোর কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী। তবে, নাম প্রকাশ না করার শর্তে হান্ডি রেস্টুরেন্টের এক কর্মকর্তা জানান, তাদের এখানে একসঙ্গে ২৫০ জন মানুষের বসে খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। যেহেতু এসব রেস্টুরেন্ট অনেকটা লাইভ খাবার সরবরাহ করে থাকে, ফলে ২৪ ঘণ্টাই কিচেনের চুলা জ্বালানো থাকে। তাই কিচেনে গ্যাস সিলেন্ডার মজুদ রাখতে হয়। বেইলি রোডে আগুন লাগার পর কিচেন থেকে সিলিন্ডার সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
রূপায়ন জেড আর প্লাজার ঠিক বিপরীত পাশে রয়েছে ইম্পেরিয়াল আমিন আহমেদ সেন্টার। এই ভবনে নামিদামি ১৫টি রেস্টুরেন্ট ও লাউঞ্জ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে-- দ্য ফরেস্ট লাউঞ্জ বাফেট এক্সপ্রেস, দ্য ক্যাফে রিও, অ্যামব্রোসিয়া ইনফিনিটি লাউঞ্জ, দ্য গ্রেট কাবাব ফ্যাক্টরি, দ্য বুফেট স্টোরিজ, গ্র্যান্ড লাউঞ্জ, ধাবা, গার্লিক ইন জিঞ্জার এবং হান্ডি। এ ছাড়া এই ভবনের নিচতলায় রয়েছে ইলেকট্রনিক্স সামগ্রির শোরুম। কয়েকটি ফ্লোরে রয়েছে ফ্যাশন হাউজের শোরুমও।
অবশ্য আজ রোববার এই ভবনটিতে কোনো মানুষের আনাগোনা দেখা যায়নি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়— বেইলি রোডের আগুনের ঘটনার পর ভবনের বিদ্যুৎ, গ্যাস ও অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থার কাজ নতুন করে করা হচ্ছে। ফলে ভবনটির সবগুলো রেস্টুরেন্ট আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে। নিচতলায় ইলেকট্রিক পণ্যের শোরুম ও দুই-তিন তলার ফ্যাশন হাউজগুলো খোলা রয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন নিরাপত্তাকর্মী বলেন, বেইলি রোডে আগুনের পরে অনেক মালিক অভিযানের ভয়ে রেস্টুরেন্ট বন্ধ করে রেখেছেন। অনেকে কিচেন থেকে গ্যাস সিলিন্ডার সরিয়ে নিয়েছেন। আরও নানা তৎপরতা চলছে।
এএইচআর/এমজে