গুলশান-বনানীও আরেক ‘বেইলি রোড’, অপেক্ষায় আছে পোড়া মৃত্যুরা
অভিজাত এলাকা হিসেবে খ্যাতি আছে রাজধানীর গুলশান ও বনানী এলাকার। সেইসঙ্গে রয়েছে প্রচুর মানুষের আনাগোনা। এ দুই অভিজাত এলাকায় গড়ে উঠেছে অসংখ্য রেস্টুরেন্ট। যেগুলোর বেশিরভাগই করা হয়েছে বহুতল ভবনের বিভিন্ন ফ্লোরে। এসব রেস্টুরেন্টে প্রবেশের প্রধান মাধ্যম ছোট ছোট লিফট। কখনো যদি অগ্নিকাণ্ড ঘটে তাহলে এসব এলাকায় বেইলি রোডের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয় বাসিন্দা ও রেস্টুরেন্টগুলোতে খেতে আসা মানুষেরা।
অভিজাত এই দুটি এলাকার আবাসিক ভবনগুলোতে যত্রতত্র গড়ে উঠেছে রেস্টুরেন্ট। অর্থাৎ এলাকার আবাসিক ভবনগুলো বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এলাকার বাসিন্দা এবং রেস্টুরেন্টগুলোতে খেতে আসা অনেকেই বলছেন, অগ্নিকাণ্ড ঘটলে গুলশান-বনানী এলাকাও আরেক ‘বেইলি রোড’ হবে— এমন শঙ্কা রয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর বেইল রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে লাগা আগুনে এখন পর্যন্ত ৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন ২০ জনের বেশি।
জানা গেছে, সেই ভবনের প্রথম তলায় ‘চায়ের চুমুক’ নামে একটি রেস্টুরেন্ট ছিল। সেখান থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। যা পরে পুরো ভবনে ছড়িয়ে পড়ে।
গুলশান-বনানীর বিভিন্ন এলাকায়ও যত্রতত্র গড়ে উঠেছে এমন বহু রেস্টুরেন্ট। ফায়ার সেফটি লাইসেন্স কিংবা সরকারি কাগজপত্র ছাড়া বছরের পর বছর চলছে এসব রেস্টুরেন্ট। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, আবাসিক এলাকায় গড়ে ওঠা রেস্টুরেন্টগুলোতে কখনো আগুন লাগলে আবাসিক ভবনের বাসিন্দাদেরও এর খেসারত দিতে হবে। এছাড়া যেসব সুউচ্চ ভবনের বিভিন্ন ফ্লোরে রেস্টুরেন্টগুলো আছে সেগুলো সরাসরি লিফট ব্যবহার করে ওঠা নামা ছাড়া উপায় নেই।
এসব ভবনে ছোট পরিসরে সিঁড়ি রয়েছে। ওই সিঁড়ি দিয়ে জরুরি বহির্গমনের সুযোগ খুব কম। কারণ সিঁড়িগুলোতে হয় বিভিন্ন মালামাল রাখা, নয়তো রেস্টুরেন্টগুলোর ভেতর থেকে সিঁড়িতে যাওয়ার গেট বন্ধ থাকে। সেক্ষেত্রে রেস্টুরেন্টগুলোতে কখনো আগুনের ঘটনা ঘটলে রেস্টুরেন্টে খেতে আসা মানুষ বুঝতেই পারবে না সিঁড়ি কোনদিকে আছে।
গুলশান-২ নম্বর গোল চত্বরের কাছাকাছি একটি ভবনের ৭ তলায় অবস্থিত ‘বিয়ন্ড বাফেট’ নামের একটি রেস্টুরেন্ট। লিফট দিয়ে সরাসরি রেস্টুরেন্টটির অভ্যর্থনালয়ে প্রবেশ করতে হয়। আশপাশে দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই জরুরি বহির্গমন সিঁড়িটি কোনদিকে আছে। ফলে এখানে অগ্নিকাণ্ড ঘটলে সমস্যায় পড়ে যাবেন রেস্তোরাঁয় আগত অতিথিরা।
এ বিষয়ে এই রেস্টুরেন্টটিতে দায়িত্বরত এক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা কাস্টমারদের সুবিধার কথা বিবেচনা করে লিফটেই প্রবেশের ব্যবস্থা রেখেছি। দুর্ঘটনা তো বলে কয়ে আসে না। তারপরও সিঁড়ি বেয়ে নামার জন্য, মানুষের দৃষ্টি সিঁড়ির দিকে নিয়ে যেতে আমরা পোস্টারসহ দিক-নির্দেশনা দিয়ে দেব।
এই রেস্টুরেন্টটির পাশের সড়কে একটি বাসায় থাকেন অনিক চৌধুরী নামে এক ব্যক্তি। তিনি বলেন, এই রেস্টুরেন্টসহ আশেপাশে অনেক রেস্টুরেন্ট আছে। যেগুলোতে সবই লিফটের মাধ্যমে ওঠানামা করেন আগতরা। বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আমরা খুব ভয় পেয়েছি। এখানকার রেস্টুরেন্টে প্রতিদিন অনেক মানুষ পরিবারসহ খেতে আসে, তাই ভয় লাগে যদি অগ্নিকাণ্ড ঘটে তাহলে সেই মানুষগুলো কীভাবে বের হবে ভবন থেকে। তাই রেস্টুরেন্ট মালিকদের উচিত প্রতিটি ফ্লোরে তাদের রেস্টুরেন্ট থেকে সিঁড়ি দিয়ে নামার ব্যবস্থা দৃশ্যমান রাখা। পাশাপাশি একাধিক জায়গায় নির্দেশিকা লাগিয়ে রাখা।
বনানীর বিভিন্ন এলাকায় দেখা গেছে সুউচ্চ ভবনের ফ্লোরে ফ্লোরে গড়ে উঠেছে রেস্টুরেন্ট। যেগুলোতেও লিফটের মাধ্যমেই ওঠানামা করা হয়। সেগুলোতেও এক্সিট সিঁড়ি কোনদিকে তা দৃশ্যমান নয়। বনানীর ডি ব্লকেও এমন একটি রেস্টুরেন্ট ‘অ্যাগান’। সেখানে খেতে আসা শরিফ আহমেদ নামে একজন বলেন, বেইলি রোডের নির্মম অগ্নিকাণ্ডের পর আমরা এখন যেকোনো রেস্টুরেন্টে খেতে যেতে ভয় পাই।
তিনি বলেন, আজ এখানে এসেছিলাম কিন্তু দেখি লিফট ব্যবহার ছাড়া কীভাবে রেস্টুরেন্ট থেকে সিঁড়ি বেয়ে নামতে হবে এমন ব্যবস্থা দৃশ্যমান নয়। তাই আরও বেশি ভয় লাগছে। প্রতিটি রেস্টুরেন্টেরই উচিত সিঁড়ি কোনদিকে সেগুলোর চিহ্ন, নির্দেশিকা লাগিয়ে দেওয়া। আর অনেক ভবনের সিঁড়িতে গ্যাসের সিলিন্ডারসহ নানান মালামাল রেখে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়ে থাকে। এই বিষয়গুলোতে রেস্টুরেন্ট মালিকদের নজর দেওয়ার সময় হয়েছে। পাশাপাশি অগ্নিনির্বাপণের প্রয়োজনীয় নিজস্ব ব্যবস্থা সব রেস্টুরেন্টেই থাকা উচিত।
আরও পড়ুন
বনানীর ই ব্লকের ৪৬ নম্বর রোডের বাসিন্দা ইব্রাহিম খলিল নামে এক বাসিন্দা বলেন, আমরা এখানে আবাসিক বাসিন্দা হিসেবে বসবাস করি। কিন্তু বনানীর বিভিন্ন আবাসিক ভবনে বাণিজ্যিকভাবে রেস্টুরেন্টগুলোকে ভাড়া দিয়ে রাখা হয়েছে। রেস্টুরেন্টে ব্যাপকভাবে কিচেন কার্যক্রম চলে, গ্যাসের ব্যবহার হয়, প্রচুর পরিমাণে সিলিন্ডার ব্যবহার করা হয়, মজুত রাখা হয়। তাই এখানে অগ্নিঝুঁকি বেশি থাকে। আমরা আশা করব গুলশান-বনানীসহ সব এলাকায় আবাসিক ভবনের বাণিজ্যিক ব্যবহার বন্ধ করবে সরকার।
বনানী এলাকার ই ব্লকে একটি ভবনের দুটি ফ্ল্যাটের মালিক তার একটি ফ্ল্যাটে রেস্টুরেন্ট করার জন্য ভাড়া দিয়েছেন। এ বিষয়ে ফ্ল্যাটটির মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আসলে আশেপাশে সব ভবনেই দু-একটি করে রেস্টুরেন্টসহ দোকান ভাড়া দেওয়া হয়েছে। আর আমার ফ্ল্যাটটিও বেশ কিছু সময় ভাড়া না হয়ে পড়েছিল। যখন ছোট একটি রেস্টুরেন্ট করার জন্য আমার কাছে এসে ভাড়া চাইল, তখন আমি এটাকে ভাড়া দিয়েছি। সব আবাসিক ভবন থেকে যদি এসব রেস্টুরেন্ট তুলে দেওয়া হয়, আমিও আমার ফ্ল্যাট থেকে রেস্টুরেন্ট তুলে দিয়ে আবাসিক ভাড়া দেব। আমি স্বীকার করে নিচ্ছি, আবাসিক এলাকায় বা ভবনে বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করা উচিত নয়।
আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক রেস্টুরেন্টসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের রাজস্ব কর্মকর্তা ইমদাদুল হক বলেন, আমরা সাধারণত আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক কার্যক্রমের বাণিজ্যিক অনুমোদন দিই না। সেক্ষেত্রে আবাসিক ভবনে থাকা বেশিরভাগ রেস্টুরেন্টেরই হয়তো ট্রেড লাইসেন্স নেই। অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
আবাসিক এলাকায় বা আবাসিক ভবনে বাণিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধে পদক্ষেপ নিয়ে থাকে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)।
এ বিষয়ে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম বলেন, অনেক আবাসিক ভবনে বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে, যা সম্পূর্ণ বেআইনি। আবাসিক ভবনের নামে অনুমোদন নিয়ে সেখানে রেস্টুরেন্ট গড়ে তোলা হয়েছে, অথচ তাদের বাণিজ্যিক অনুমোদন নেই। এ বিষয়ে আমরা কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করার উদ্যোগ নিয়েছি। একটি কমিটির মাধ্যমে এসব কার্যক্রম আমরা পরিচালনা করব।
রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য মোজাম্মেল হক বলেন, যারা রাজধানীতে রেস্টুরেন্ট করেছে, তারা প্রথমে রেস্টুরেন্টটি করার জন্য জায়গা খোঁজে। সবকিছু মিলিয়ে জায়গা খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন কাজ। তাই যখন কোনো ভালো লোকেশনের ভবনে ফাঁকা জায়গা থাকে সেখানেই রেস্টুরেন্ট মালিকরা বা তরুণ উদ্যোক্তারা রেস্টুরেন্ট গড়ে তোলেন। ভবন মালিক যখন রেস্টুরেন্টের জন্য তার ফ্লোর ভাড়া দিচ্ছেন, এই অনুমোদন নেওয়ার দায়িত্ব ভবন মালিকেরই। সেখানে রেস্টুরেন্ট মালিকের কোনো দোষ থাকে না। তবে ভালো হয় যদি সবাই বিচার-বিশ্লেষণ করে ভবনের বাণিজ্যিক অনুমোদন আছে কি না সেগুলো দেখে রেস্টুরেন্টের জন্য ফ্লোর ভাড়া নেন। কিন্তু জায়গার সংকট থাকার কারণে ভালো লোকেশনে দোকান পাওয়ার বিষয়ে দোকান মালিকদের অত কিছু বিবেচনা করার সুযোগ থাকে না।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীতে রাজউকের আওতায় ৫ লাখ ১৭ হাজার ভবন রয়েছে। এর মধ্যে অনুমোদন রয়েছে ২ লাখের। অনুমোদিত ভবনের মধ্যে ৯০ শতাংশ নকশার বিচ্যুতি ঘটিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। রাজউক এসব ভবনের বিচ্যুতি নিয়ন্ত্রণে বছরে গড়ে ৫ হাজার নোটিশ দিয়ে থাকে। গত বছর রাজউকের পক্ষ থেকে বিচ্যুতি প্রতিরোধে ১ হাজার ৮৯০টি ভবনে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হয়।
এএসএস/পিএইচ/এমজে