লাল নীল মেকআপে ‘রেস্তোরাঁ হোম’ হয় পুরোনো বসতবাড়ি
রাজধানীর খিলগাঁও এখন অনেকটা চাইনিজ রেস্টুরেন্ট ও ফাস্টফুড দোকানের ‘বিশেষায়িত জোন’ হয়ে উঠেছে। খিলগাঁও তালতলা মার্কেট থেকে মালিবাগ আবুল হোটেলের মোড় পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে আবাসিক ভবনে করা হয়েছে শত শত রেস্তোরাঁ ও নানারকম খাবারের দোকান। বহু পুরোনা আবাসিক বাড়িকে নানা রঙে সাজিয়ে দৃষ্টিনন্দন করা হয়েছে।
তালতলা সি ব্লকের ৫৬৮ নম্বর ভবনে গিয়ে দেখা যায়, পাঁচ তলা ভবনে অলিভার, ক্যাফে অ্যাপেলিয়ানো, পিৎজাবার, সানসেট লাউন্স রেস্তোরাঁ রয়েছে। ভবনটির খোলা ছাদেও চেয়ার টেবিল বসিয়ে খাবারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। রেস্টুরেন্টগুলোতে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত শত শত মানুষের ভিড় থাকে। ভবনে ওঠানামার জন্য চারজন ধারণ ক্ষমতার একটি মাত্র ছোট লিফট। দেখলেই বোঝা যায় পুরাতন কাঠামোতে অনেকটা জোর করে লিফট বসানো হয়েছে। লিফট আপনাকে নিয়ে যাবে সরাসরি রেস্তোরাঁর ভেতরে। অর্থাৎ লিফটের চারপাশে কোনো জায়গা নেই। ভবনের পেছনে ছোট একটি সিঁড়ি থাকলেও তা রেস্তোরাঁর রান্নাঘর সংলগ্ন হওয়ায় ব্যবহার হয় না কিংবা অনেকেই তা জানেন না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেস্তোরাঁর কয়েকজন কর্মচারী ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ বিষয়ে কথা বলতে হলে মালিকদের সঙ্গে কথা বলেন। আমরা তো চাকরি করি। যতটুকু জানি আবাসিক ভবন সংস্কার করে রেস্তোরাঁ করা হয়েছে। আপনি দেখলেই তো বুঝতে পারেন। বেইলি রোডের ঘটনায় আমাদের মধ্যেও ভয় কাজ করে। দুর্ঘটনা তো বলে-কয়ে আসে না। ঝুঁকির মধ্যেই আমাদের কাজ করতে হয়।
ওই ভবনের পাশেই নাইট এঙ্গেল স্কাইভিউ হাইটসের ৬ তলা আরও একটি ভবন রয়েছে। ওই ভবনের চিত্রও প্রায় একইরকম। সেখানেও পাস্তা ক্লাব, শরমা কিং, ক্যাফে আইপ্যানিমা, থ্রি ডোরস ও ক্যাফে সুইট অ্যান্ড সেভরি রেস্তোরাঁ রয়েছে। এ ভবনে ছোট লিফট ও সিঁড়ি পাশাপাশি পাওয়া গেলেও ভোজন রসিকদের অনেককে সরু গেট পেরিয়ে রেস্তোরাঁগুলোতে প্রবেশ করতে হয়। এই ভবনেও ফায়ার সেফটির জন্য আধুনিক ব্যবস্থা পাওয়া যায়নি। এক সময়ের আবাসিক ভবন এখন পুরো মাত্রায় বাণিজ্যিক ভবনে রূপান্তরিত হয়েছে। সামনের দিকে রেস্তোরাঁ হলেও পেছনের অংশ এখনো আবাসিক হিসেবেই ব্যবহার করা হচ্ছে।
এ ভবনের ঝুঁকির বিষয়ে কথা বলার চেষ্টা করা হলেও কারো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে রেস্তোরাঁগুলোতে কাজ করা কর্মচারীরা বলেন, ভাই এটা ভবন মালিক ও আমাদের রেস্তোরাঁ মালিকদের বিষয়। তাছাড়া এটা দেখার জন্য রাজউক ও সিটি করপোরেশন রয়েছে। তাদের কোনো পদক্ষেপ আমরা দেখতে পাইনি। মাঝে মাঝে দুই একজন আসে, ম্যানেজ হয়ে চলে যায়। এ বিষয়ে আপনি মালিকদের সমিতি আছে, সেখানে যোগাযোগ করতে পারেন।
শুধু এই দুটো ভবনই নয় খিলগাঁও এলাকায় এ রকম অনেক ভবনই রয়েছে যেখানে ইচ্ছা মতো সংস্কার করে রেস্তোরাঁ ও চাইনিজ রেস্টুরেন্ট দিয়েছেন মালিকরা। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা এসব খাবারের দোকানে ছোট দুর্ঘটনাই বেইলি রোডের মতো ভয়াবহ ঘটনা সৃষ্টি করতে পারে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্টরা।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে খিলগাঁও তালতলা বিসনেস ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি মুশফিকুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের সমিতির আওতায় ১০০টির বেশি রেস্তোরাঁ ও খাবারের প্রতিষ্ঠান রয়েছে। আমাদের সদস্যদের নিয়ে আমরা নিয়মিত সভা করে থাকি। ভবন ব্যবস্থাপনার বিষয়টি জমি বা ভবনের মালিকের। তবে রেস্তোরাঁ মালিকদের দায়িত্ব রয়েছে। সমিতির পক্ষ থেকেও এ বিষয়ে বলা হয়েছে। শিগগিরই আমরা সভা ডেকেছি। সেখানে ভবনের ফায়ার সেফটি ও রেস্তোরাঁর পরিবেশ নিয়ে আলোচনা হবে। আমাদের পক্ষ থেকে যতটুকু সম্ভব করব। কারণ আমরা অবশ্যই ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের বিরুদ্ধে।
তিনি বলেন, বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডে বিপুল সংখ্যক মানুষের মারা যাওয়ার জন্য ওই ভবনের ফায়ার এক্সিট না থাকাকে দায়ী করছেন অনেকে। রেস্তোরাঁয় ধারণ ক্ষমতার বেশি লোক থাকা এবং দোকানের সিলিন্ডার সিঁড়িতে ফেলে রাখার কারণে এমনটি হয়েছে। আগামী সভায় আমাদের সদস্যদের সামনে এসব বিষয় উপস্থাপন করা হবে।
বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি)-২০২০ এবং ইমারত নির্মাণ বিধিমালা-২০০৮ অনুযায়ী, ভবন ব্যবহারের জন্য অকুপেন্সি সার্টিফিকেট (বসবাস বা ব্যবহার সনদ) নেওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে। এসব রেস্টুরেন্টের অকুপেন্সি সার্টিফিকেট নেওয়া হয় না।
আরও পড়ুন
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব দেখার দায়িত্বে আছে রাজউক, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর, কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশন, পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ, বিস্ফোরক অধিদপ্তর। সংস্থাগুলোর কর্মকর্তারা এগুলো দেখেন না বলেই ব্যাঙের ছাতার মতো রেস্টুরেন্ট গড়ে উঠছে।
এ বিষয়ে স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, যে কার্যক্রম চালানো হবে, সে অনুযায়ী ভবনের নির্মাণ-কাঠামো ও নকশা করতে হয়। ইচ্ছা করলেই বাণিজ্যিক বা আবাসিক ভবনে রেস্তোরাঁ করার কোনো সুযোগ নেই। রেস্তোরাঁর জন্য যে ধরনের রান্নাঘর দরকার হয়, তা সাধারণ বাণিজ্যিক কার্যক্রমের জন্য তৈরি করা ভবনে থাকে না। রেস্তোরাঁর রান্নাঘরের জন্য বিশেষ ব্যবস্থার দরকার হয়। রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় অনেক বহুতল ভবনের বিভিন্ন তলায় রেস্তোরাঁ তৈরি করা হয়েছে। সেসব ভবনের অগ্নিনিরাপত্তা কতটুকু মেনে চলা হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
আরএম/এসকেডি/এমজে