চার বছর পর আসা এই রাত আর ভোলা যাবে না
অধিবর্ষ বা লিপ ইয়ার। গতকাল ছিল সেই ২৯ ফেব্রুয়ারি, যা চার বছরে ফিরে আসে একবার। চার বছর পর পর আসা এই একদিন মানুষ নানাভাবে স্মরণীয় করে রাখতে চান, কিন্তু তা যে এমন নিষ্ঠুরতার ছাপ রেখে যাবে তা হয়তো ভাবতে পারেনি কেউ। যার সাক্ষী রাজধানীর জাঁকজমক এলাকাখ্যাত বেইলি রোড। রাতে আলো ঝলমলে রেস্টুরেন্ট পাড়ায় মুহূর্তেই দেখা দেয় আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠা। মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ভস্মীভূত হয় পুরো সাত তলা ভবন। যার অধিকাংশ তলায় ছিল রেস্টুরেন্ট। সাধারণত কিছুটা বাড়তি আনন্দের আশায় পরিবার-পরিজন নিয়ে এখানে ভিড় জমান অনেকেই। কিন্তু তা যে বিভীষিকার রাতে পরিণত হবে তা কেউ আঁচ করতে পারেনি।
ছবির ভবনটির দুই রূপই বলে দিচ্ছে কতটা বিষাদের ছায়া রেখে গেছে এই লিপ ইয়ার। আর এ ঘটনায় নিমিষেই ঝরে গেছে প্রায় ৪৬ তাজা প্রাণ। লিপ ইয়ারের রাতে আগুনের এ পোড়া গন্ধের স্মৃতি হয়তো বয়ে বেড়াবেন হতাহতের পরিবার আর বেইলি রোডের বাসিন্দারা। কারণ, মুহূর্তেই এতো মৃত্যু আর কখনো দেখেননি বাসিন্দারা।
আরও পড়ুন
রাত ৯টা ৪৫ মিনিটের দিকে ভয়াবহ এ আগুনের সূত্রপাত হয়। কিন্তু এর পাঁচ মিনিট আগেও ভবনটিতে উৎসবমুখর পরিবেশ ছিল। ভবনটির নিচে মানুষের উপচে পড়া ভিড় ছিল। উপস্থিত সবার মুখে ছিল একই কথা— এমন বিভীষিকাময় দৃশ্য আগে কোনোদিন দেখিনি।
এরপর আগুন নিয়ন্ত্রণে এলে রাত ১টার পর থেকেই নামানো হচ্ছিল একের পর এক মরদেহ। আলো ঝলমলে বেইলি রোড যেন তখন শোকে স্তব্ধ। উপস্থিত জনতা, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ-প্রশাসন থেকে শুরু করে জড় ইট-কাঠও যেন নড়েচড়ে বসে। আর পরিবার-পরিজনদের মধ্যে চলছিল আহাজারি। অথচ মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগেও লিপ ইয়ারকেন্দ্রিক উৎসব ছিল এখানে।
এদিকে রাতেই নিখোঁজদের খোঁজে ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন আত্মীয়-স্বজনরা। এ সময় ভিড় করেন উৎসুক জনতাও। হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ছোটাছুটি খোঁজ-খবর নিতেও দেখা যায় স্বজনদের।
জানা যায়, রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকার সেই ভবনটির অধিকাংশ ফ্লোরে ছিল খাবারের দোকান। সাততলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় ‘কাচ্চি ভাই’ নামের খাবারের দোকান ছিল। এছাড়া তৃতীয় তলায় একটি পোশাকের দোকান ছাড়া ওপরের তলাগুলোতেও ছিল খাবারের দোকান। ভবনটিতে পিৎজা ইন, স্ট্রিট ওভেন, খানাসসহ বেশকিছু নামি রেস্টুরেন্টও রয়েছে। এ ছাড়া ইলিয়েন, ক্লোজেস্ট ক্লাউডসহ জনপ্রিয় বিপণিবিতানও রয়েছে।
প্রতিদিন সন্ধ্যার পর থেকে খাবারের দোকানগুলোতে ক্রেতাদের ভিড় হতো সেখানে। অনেকেই পরিবার নিয়ে সেখানে খেতে যেতেন। আর গতকাল (বৃহস্পতিবার) লিপ ইয়ারের দিন হওয়ায় দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে অনেকেই ভবনটির বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে পরিবার নিয়ে জড়ো হয়েছিলেন। যার মধ্যে অসংখ্য নারী ও শিশু ছিল।
ভয়াবহ এ আগুনে প্রাণ গেছে শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে শিক্ষক, পুলিশ, চাকরিজীবী-ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জানা যাচ্ছে নিহতের পরিচয়। নিহতদের মধ্যে এখন পর্যন্ত বুয়েটের দুই শিক্ষার্থী, ভিকারুননিসার শিক্ষক, রেস্টুরেন্টের ক্যাশিয়ার-ওয়েটারসহ একাধিক মানুষের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে।
বেইলি রোডের এক বাসিন্দা সাইদুল আজিমুল হক বলেন, টিভিতে অনেক আগুনের দৃশ্য দেখেছি। কিন্তু আজ নিজেদের চোখে এমন ধ্বংসযজ্ঞ দেখলাম। ভয়াবহ এক ট্রমা কাজ করছে। জানি না এই রাত ভুলতে পারব কি না।
আরেক বাসিন্দা হাসান ফেরদৌস বলেন, আগুনের খবরে দৌড়ে এসে দেখি— দাউ দাউ করে আমাদের সবার পরিচিত বিল্ডিংটি আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। কেউ দোতলার কাচ ভেঙে মই বেয়ে নামছে, কেউ আবার তিনতলা থেকে লাফ দিচ্ছে। এমন বিভীষিকাময় দৃশ্য কোনোদিন দেখিনি।
ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা গেছে, রেস্টুরেন্টগুলোর প্রতিটিতে ছিল গ্যাস সিলিন্ডার। যে কারণে আগুনের তীব্রতা আরও ভয়াবহ হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন জানান, কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্ট ভবনের দ্বিতীয় তলায় কাপড়ের দোকান ছিল। আমাদের দেখা মতে ভবনের অন্যান্য ফ্লোরে রেস্টুরেন্ট ছিল। যেগুলোতে আমরা গ্যাস সিলিন্ডার দেখেছি। যে কারণে আগুনটা দ্রুত ছড়িয়েছে এবং দাউদাউ করে জ্বলেছে।
আগুনে দগ্ধ হওয়ার চেয়ে বেশিরভাগ মানুষ শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা গেছেন বলে জানান তিনি।
তিনি আরও বলেন, ‘দ্বিতীয় তলা ছাড়া ভবনটার প্রতিটি ফ্লোরের সিঁড়িতে ছিল সিলিন্ডার। যেটা খুবই বিপজ্জনক ব্যাপার। কারণ, আগুন লাগলে সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়, যা ভয়ংকর ও বিপজ্জনক। ভবনটা মনে হয়েছে অনেকটা আগুনের চুল্লির মতো।’
আগুনের ঘটনায় ভবনটির ভেতরে আটকা পড়েন অনেক মানুষ। অনেকেই আশ্রয় নেন ছাদে। বিভিন্ন মাধ্যমে জানান দেন তাদের জীবিত থাকার কথা আর উদ্ধারের আকুতি জানান।
আরও পড়ুন
এদিকে ভোর ৫টা ৪১ মিনিটে নিহতদের মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর শুরু হয়। এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত রয়েছেন জেলা প্রশাসন, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। এখন পর্যন্ত ঢাকা জেলা প্রশাসনের কাছে নিহত ১৬ জনের তথ্য রয়েছে। রাতেই ঢাকা মেডিকেলে কলেজ হাসপাতালে নিহতদের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে পুলিশ। এরপর মরদেহগুলো স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
এ বিষয়ে কলাবাগান থানার উপপরিদর্শক (এএসআই) গোলাম হোসেন বলেন, নিহতদের স্বজনেরা যাদের শনাক্ত করেছেন, আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের মরদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে।
শেষ খবর পাওয়া অনুযায়ী— আগুনে মোট নিহত হয়েছেন ৪৬ জন। এছাড়া, গুরুতর আহত হয়েছেন অন্তত ২২ জন। এ ঘটনায় নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ভয়াবহ এই আগুনের ঘটনার নেপথ্যের কারণ, ভবনের অগ্নি নিরাপত্তা ও ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণসহ হতাহত বেশি হওয়ার কারণ অনুসন্ধানে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর।
এমজে