‘ডাবল অ্যানেস্থেসিয়া দিয়ে আমার ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে’
সুন্নতে খৎনা করানোর জন্য জেএস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল চেকআপ সেন্টারের চিকিৎসকরা ২০-২৫ মিনিট সময় চেয়েছিলেন শিশু আহনাফ তাহমিদ আয়হামের বাবার মোহাম্মদ ফখরুল আলমের কাছে। অপারেশন থিয়েটারে (ওটি) নেওয়ার আধ ঘণ্টা পার হয়ে গেলে কোনো আপডেট না পেয়ে জোর করে ভেতরে প্রবেশ করেন ফখরুল। ভেতরে গিয়ে দেখেন ছেলের নিথর দেহ পড়ে আছে, আর মুখ ও নাগ দিয়ে রক্ত পড়ছে। পরে ওটি রুম থেকে এক পর্যায়ে জোর করে ফখরুল আলমকে বের করে দেয় চিকিৎসকরা। এরপর কেটে যায় আরো দুই ঘণ্টা। দুই ঘণ্টা পরও ছেলের খোঁজ না পেয়ে আবার ওটিতে জোর করে প্রবেশ করেন ফখরুল। ভেতরে গিয়ে ছেলের অবস্থা জানতে চাইলে চিকিৎসকরা বলেন আয়হাম মারা গেছে।
রাজধানীর মালিবাগের জেএস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল চেকআপ সেন্টারে সুন্নতে খৎনা করাতে গিয়ে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী আয়হামের মৃত্যুর ঘটনায় নিহতের বাবা মোহাম্মদ ফখরুল আলম বুধবার (২১ ফেব্রুয়ারি) বাদী হয়ে হাতিরঝিল থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন। মামলার এজাহারে তিনি ছেলের মৃত্যুর ঘটনার এসব তথ্য উল্লেখ্য করেছেন।
চিকিৎসায় অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগ এনে মামলায় জেএস হাসপাতালের তিন চিকিৎসককে আসামি করা হয়েছে।
মামলার আসামিরা হলেন, জেএস হাসপাতালের পরিচালক ডা. এস এম মুক্তাদির, চিকিৎসক ডা. মাহাবুব মোরশেদ (৩৯) ও ডা. ইশতিয়াক আজাদ (৪৫)। ইতোমধ্যে এ ঘটনায় জেএস হাসপাতালের পরিচালক ডা. এস এম মুক্তাদির ও চিকিৎসক ডা. মাহাবুব মোরশেদকে গ্রেপ্তার করেছে হাতিরঝিল থানা পুলিশ।
হাতিরঝিল থানা সূত্রে জানা যায়, গ্রেপ্তার দুই চিকিৎসক রিমান্ড আবেদন করে আদালতে তোলা হয়। পরে আদালত তাদের জেল গেটে দুই দিন জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য আদেশ দিয়েছেন।
আরও পড়ুন
মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, গত ১৯ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ৮টায় মোহাম্মদ ফখরুল আলম তার ছেলে আহনাফ তামহিদ আয়হামের (১০) সুন্নতে খৎনা করার জন্য রাজধানীর মালিবাগে অবস্থিত জেএস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল চেকআপ সেন্টারে নিয়ে যান। হাসপাতালে গিয়ে তিনি তার ছেলেকে ডা. এস এম মুক্তাদিরের কাছে নিয়ে যান। তখন ডা. মুক্তাদির আয়হামের কিছু টেস্ট লিখে দেন। টেস্টগুলো করিয়ে ফখরুল আলম ছেলেকে নিয়ে খিলগাঁওয়ের বাসায় চলে আসেন। পরে ওইদিন রাত ১১টার দিকে ডা. মুক্তাদির ফোন করে ফখরুল আলমকে জানান তার ছেলের সবগুলো টেস্টের রিপোর্ট ভালো এসেছে। এখন তার সুন্নতে খৎনা করাতে কোনো সমস্যা নেই। পরের দিন অর্থাৎ ২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা ৭টা ৪৫ মিনিটের দিকে ছেলের সুন্নতে খৎনা করানোর জন্য আবার জেএস হাসপাতালে ছেলে নিয়ে যান ফখরুল ইসলাম। হাসপাতালে নেওয়ার পর আয়হামকে ওটি রুমে নিয়ে যাওয়া হয়।
এ সময় ডা. এস এম মুক্তাদির ও বাকি আসামিরা ফখরুল আলমকে জানায় আয়হামের সুন্নতে খৎনা করাতে ২০-২৫ মিনিট সময় লাগবে। আয়হাম ওটিতে যাওয়ার পর, ফখরুল আলম স্ত্রীকে নিয়ে ওটির দরজার বাইরে অপেক্ষা করছিলেন। যখন ২৫ মিনিট পার হয়ে যায়, তখন ফখরুল আলম ওটির দরজায় নক করলে চিকিৎসকরা জানায় তাদের আরও সময় লাগবে। এর পর প্রায় ১ ঘণ্টা পার হয়ে গেলে ফখরুল আলম ওটিতে প্রবেশ করতে চাইলে তাকে প্রবেশ করতে দেয়নি। ভেতরে থাকা চিকিৎসকরা ফখরুল আলমকে আরো অপেক্ষা করতে বলেন।
এজাহারে আরো উল্লেখ করা হয়, চিকিৎসকদের এমন আচরণে ফখরুল আলমের মনে সন্দেহ জাগে। পরে তিনি এক প্রকার জোর করে ওটিতে প্রবেশ করেন। ওটিতে প্রবেশ করে দেখেন তার ছেলে আয়হাম অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে। ফখরুল আলম ওটিতে আরো দেখেন তার ছেলের বুকে আসামিরা চাপাচাপি করছে। এছাড়া তিনি দেখতে পান তার ছেলের নাকে ও মুখে লাগানো নল দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। এ বিষয়ে তিনি ডা. মুক্তাদিরকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি কোনো সঠিক উত্তর দেয়নি। এসময় ডা. মাহাবুব মোরশেদ আয়হামকে বেশ কয়েকটি ইনজেকশন দেয়। ছেলেকে কীসের ইনজেকশন দেওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে এ বিষয়ে কোনো উত্তর দেয়নি আসামিরা। ছেলের এই অবস্থা দেখে অন্য হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে উন্নত চিকিৎসা করাতে চান ফখরুল আলম। কিন্তু ফখরুল আলমের কথা কর্ণপাত না করে আসামিরা আয়হামের বুকে চাপাচাপি ও হাত-পায়ে মালিশ করতে থাকেন। ছেলেকে নিথর অবস্থায় দেখে এসময় অস্থির হয়ে পড়েন ফখরুল আলম। তার অস্থিরতা দেখে আসামিরা তাকে ওটি থেকে বের হয়ে যেতে বলেন।
আয়হামকে ওটিতে নেওয়ার প্রায় ২ ঘণ্টা পর ছেলের শারীরিক অবস্থা জানতে চান ফখরুল ইসলাম। কিন্তু আয়হামকে শারীরিক অবস্থার কথা না বলে আসামিরা কালক্ষেপণ করতে থাকেন। পরে ফখরুল আলম জোর করে ওটিতে প্রবেশ করে আয়হামের অবস্থা জানতে চাইলে আসামিরা জানায় আপনার ছেলে মারা গেছে।
ছেলের মৃত্যুর বিষয়ে বৃহস্পতিবার (২২ ফেব্রুয়ারি) মোহাম্মদ ফখরুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে। ডাবল অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়া হয়েছে তাকে। ওটিতে নেওয়ার ২০ মিনিট পরেই আমার ছেলে মারা যায়। আমি বার বার ভেতরে যেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তারা যেতে দেয়নি। এখন আমি বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে পেরেছি, ডা. এস এম মুক্তাদির ও ডা. মাহাবুব মোরশেদ চিকিৎসক নয়। তাদের কোনো ডিগ্রি নাকি নেই। তারা আসলে প্রতারক। আমি আমার ছেলের হত্যাকারীদের ফাঁসি চাই।
এদিকে জেএস ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ও চিকিৎসকদের সনদ রয়েছে কি না, এ বিষয়ে তদন্ত নেমেছে হাতিরঝিল থানা পুলিশ। এরই মধ্যে এ সংক্রান্ত বিভিন্ন কাগজপত্র যাচাই শুরু করেছে তদন্তকারী কর্মকর্তা।
এ বিষয়ে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও হাতিরঝিল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) রুহুল আমিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা ইতোমধ্যে অভিযুক্ত দুই চিকিৎসককে গ্রেপ্তার করেছি। তাদের দুই দিনের রিমান্ড আবেদন করে আদালতে তোলা হলে আদালত তাদের জেল গেটে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি দিয়েছেন। আমরা আগামীকাল থেকে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করব। এছাড়া চিকিৎসকদের সনদ আছে কিনা এবং হাসপাতালের রেজিস্ট্রেশন আছে কিনা এ বিষয়েও আমাদের তদন্ত চলছে।
এদিকে রাজধানীর মালিবাগের জে এস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল চেকআপ সেন্টারে খতনা করাতে গিয়ে শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় ওই হাসপাতালের সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া নোটিশে বলা হয়েছে, ‘আহনাফ তামহিদ নামের শিশুর সুন্নতে খতনা অপারেশনের সময়ে মৃত্যু সংক্রান্ত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত জে এস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল চেকআপ সেন্টারে ও জে এস হাসপাতালের সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ রাখার জন্য নির্দেশ দেওয়া হলো।
এমএসি/এসএম