বোবা প্রাণীদের জীবন কাটছে খেয়ে না খেয়ে
করোনাভাইরাসের দাপটে দুঃসময় চলছে বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্বে। সংক্রমণ থেকে জনসাধারণকে বাঁচাতে সরকার ঘোষিত ‘সর্বাত্মক বিধিনিষেধ’ চলছে সারাদেশে। এ সময়ে একবেলার খাবার দু'বেলা খেয়ে বেঁচে আছে পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী বাহন ঘোড়া গাড়ির ঘোড়াগুলো।
উপার্জন না থাকায় ঘোড়ার চাহিদা মতো খাবার দিতে পারছেন না এসব ঘোড়ার মালিকরা। এভাবে চলতে থাকলে বোবা এই প্রাণীগুলো হয়তো মৃত্যুর দিকে ধাবিত হবে বলে আশঙ্কা করছেন তারা। তাদের প্রত্যাশা, সরকার যদি এই বোবা প্রাণীদের জন্য সামান্য সহযোগিতাও করে তবে তাদের বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হবে। বাঁচবে পুরান ঢাকার ঐতিহ্যও।
অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের লেখা ‘ঢাকা: স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী-১’ বই থেকে জানা যায়, ১৮ শতকের প্রথম দিকে ঢাকায় বসবাসকারীদের মধ্যে আর্মেনীয়রা ছিল অন্যতম প্রভাবশালী ও বণিক সম্প্রদায়। ১৮৫৬ সালে সিরকো নামীয় একজন আর্মেনীয়ই প্রথম ঢাকায় ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন করেন। ১৮৪৪ সালে প্রকাশিত 'ক্যালকাটা রিভিউতে' নানা ধরনের ঘোড়ার গাড়ির কথা উল্লেখ রয়েছে। যাতে ঢাকায় চলাচলকারী গাড়িগুলোকে 'ক্রাহাঞ্চি' বা 'ক্রাঞ্চি' গাড়ি ('কারাচি গাড়ি') বলা হয়েছে। ওই সময় রাজকীয় এক বাহন ছিল ঘোড়ার গাড়ি। যা স্থানীয়ভাবে টমটম নামেও পরিচিত। আর ওইসব গাড়ির চালিকা শক্তিই হচ্ছে এ ঘোড়া।
মঙ্গলবার (২০ এপ্রিল) রাজধানীর ফুলবাড়িয়া ঘুরে দেখা যায়, সেখানে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের নিচে সারিবদ্ধভাবে বেঁধে রাখা হয়েছে ঘোড়াগুলোকে। কোনো ঘোড়া খাচ্ছে আবার বা কোনটি দাঁড়িয়েই ঝিমাচ্ছে। কাজ না থাকায় যেন অলস সময় পার করছে ঘোড়াগুলো। পাশের রাস্তায় রাখা আছে ঘোড়ার গাড়িগুলো। ঠিক করা হচ্ছে গাড়ির চাকাসহ অন্যান্য অংশ। আবার অনেক গাড়িতে মালিক ও কচুয়ানরা (চালক) চিন্তায় বিভোর সময় পার করছে। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, লকডাউনে বন্ধ রয়েছে গুলিস্থান-সদরঘাট রোডের বর্তমান এ রাজকীয় যানবাহনগুলো। বন্ধ হয়েছে আয়। তাতেই একবেলার খাবার দু'বেলা ভাগ করে খাওয়াতে হচ্ছে ঘোড়াগুলোকে।
ঘোড়া মালিকদের তথ্য মতে, ফুলবাড়িয়া, বঙ্গবাজার, ধোলাইখাল এবং কামরাঙ্গীরচর এলাকা মিলে রাজধানীতে মোট ঘোড়ার গাড়ি আছে ৩৫টির মতো। আর এসব মালিকদের কাছে মোট ৭০টির মতো ঘোড়া রয়েছে। এসব গাড়ির প্রধান রোড হচ্ছে গুলিস্থান-সদরঘাট। এছাড়া চাহিদা মতো বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ভাড়ায় গিয়ে থাকে এ গাড়িগুলো। বর্তমান করোনাকালীন পরিস্থিতিতে সব ধরনের আয়ের পথ বন্ধ রয়েছে এ মালিকদের।
১৯৮০ সাল থেকে গুলিস্থান-সদরঘাট রোডে ঘোড়া গাড়ির কচুয়ান হিসেবে কাজ করছেন রুহুল আমিন। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, 'বর্তমানে আমরা বহুত অভাবে চলতেছি। আমাদের তো অত বেশি ইনকাম নাই। সাধারণ সময় সারাদিন ঘোড়ার গাড়ি চালিয়ে ১৫শ থেকে ২২শ টাকার মতো ইনকাম হয়। তাতে ঘোড়ার খাবারসহ সব খরচ বাদে ৪/৫শ টাকা পকেটে থাকে। এখন ঘোড়াদের তো দুইবেলা করে খাবার দিতে পারছি না। এক বেলার খাবার ভাগ করে দুই বেলা খাওয়াচ্ছি।'
তিনি আরও বলেন, 'বর্তমানে ঢাকায় একটা সংসারের খরচপাতি সম্পর্কে সবারই জানা। নিজেরা অন্তত এক বেলা না খেয়ে থাকতে পারি। কিন্তু এ বোবা প্রাণীদের তো না খাইয়া রাখতে পারি না।'
ঘোড়ার গাড়ি চালক ইমরান বলেন, 'আমাদের আর কোনো ইনকাম নাই। এই গাড়ি চললেই আমরা খেতে পারি। গত সপ্তাহে কঠোর নির্দেশনার মধ্যে আমার একটি গাড়ি সার্জেন্ট ডাম্পিংয়ে পাঠিয়েছিল। সেখান থেকে ৩ হাজার টাকায় ছাড়িয়ে নিয়ে এসেছি। এছাড়া রাস্তায় যখন তখন আমাদের ৩০০, ৪০০ বা ৭০০ টাকা জরিমানা করে তারা। ওই সময় গাড়ি চালিয়ে যা ইনকাম করেছি তা জরিমানা দিতেই হাত খালি হয়ে গেছে। এখন পাঁচ-সাত দিন যাবৎ আমাদের কোনো আয় নেই। ঘোড়াদেরও খাওয়াতে পারি না ঠিকমত।’
ঘোড়া গাড়ির মালিক কালু মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, দুটি ঘোড়ার জন্য সকালে ২০ কেজি এবং রাতে ২০ কেজি করে দিনে মোট ৪০ কেজি খাবার লাগে। যার দাম ১৪শ টাকা। আয় না থাকায় এখন ৪০ কেজি খাবার ওদের আমরা দিতে পারছি না। ২০ কেজি খাবার দুইবেলা ভাগ করে দিচ্ছি। আমাদের নিজেদেরই চলতে কষ্ট হচ্ছে। এই বোবা প্রাণীদের জন্য আরও বেশি কষ্ট হয়। যদি দুইটা ঘোড়ার পিছে দিনে ১৪শ টাকা খরচ থাকে, তাহলে কোনো ইনকাম না থাকলে কি করে চলবো?'
তিনি আরও বলেন, ‘গতবছর লকডাউনে আমরা সব ঘোড়ার মালিকরা অনেক টাকা ঋণগ্রস্ত হয়েছি। সেগুলো পরিশোধ করতে না করতে আবারও করোনা এসেছে। গতবছর লকডাউনে প্রত্যেক ঘোড়ার মালিক অন্ততপক্ষে দুই থেকে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ হয়েছে। এখন আবার লকডাউন হয়েছে। এখন ঘোড়াকে কিভাবে খাওয়াবো, নিজেরা কিভাবে খাব আর সংসার কিভাবে চালাবো সেই চিন্তায় কুল পাচ্ছিনা।’
প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানিয়ে এ ঘোড়ার মালিক বলেন, ‘আমরা সব ঘোড়ার মালিকরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে সাহায্যের আবেদন জানাচ্ছি। আপনি আমাদের একটু সহযোগিতা করলে পুরান ঢাকার ঐতিহ্য বাঁচবে, আমরাও বাঁচবো। গত বছরও আমরা কোনো সাহায্য সহযোগিতা পাইনি। এভাবে একবেলা খেয়ে থাকলে ঘোড়াগুলো মারাও যেতে পারে। অন্তত এবার আমাদের দিকে একটু তাকান।’
ঘোড়া গাড়ি মালিকদের সমিতি, একতা মালিক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ আলী আজগর শেখ ঢাকা পোস্টকে বলেন, 'আমরা চাই একটু আরাম, একটু শান্তি। এই ঘোড়াগুলোকে রাখার একটি স্থায়ী জায়গা। এই ফুলবাড়িয়াতে আজ থেকে ১০০ বছর আগে ঘোড়ার গাড়ি রাখা হতো। এই জায়গাটার নাম ছিল ফুলবাড়ীয়া স্টেশন। এখান থেকে আগে শুধুমাত্র রেলগাড়ি এবং ঘোড়ার গাড়ি চলাচল করেছে। আমরা চাই জায়গাটা স্থায়ীভাবে ঘোড়া রাখার জায়গা হিসেবে সিটি করপোরেশন আমাদের দিক।’
তিনি আরও বলেন, ‘সরকারের কাছে আমাদের চাওয়া আমরা যেন দুইটা ডাল-ভাত খেয়ে বাঁচতে পারে। এখন লকডাউনে সবকিছুই বন্ধ। আমরা যদি একটা গাড়ি এখনই বের করি, তবে সার্জেন্ট রেকার লাগিয়ে রেখে দেবে। তখন বাসা থেকে ১২শ টাকা এনে সেটি ছাড়িয়ে আনতে হবে। এখন যদি আমরা ঘোড়াকে না-ই খাওয়াতে পারি, তাহলে চলবো কী করে? আর ওরাই বাঁচবে কী করে? আমরা এক বেলা না খেয়ে থাকলেও ঘোড়াকে না খাইয়া রাখিনি। কেউ ঘোড়া বেঁচে ঘোড়ার খাবার কিনছেন, আবার কেউ ঋণ করে ঘোড়ার খাবার কিনছেন। গতবছরের ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় এখন আমাদের নতুন করে ঋণ দিচ্ছে না। এমনকি সুধেও কেউ টাকা দিচ্ছে না। আমরা চাই, সরকার অন্তত ঘোড়ার খাবারের ব্যবস্থাটুকু করুক।’
এমএইচএন/এসএম