শীতে জবুথবু গণ্ডার-হরিণ-বাঘ, চোখ মুদে রোদ পোহাচ্ছে কুমির
শীতকালের দুটি মাসের মধ্যে পৌষ মাস বিদায় নিয়েছে। আজ মাঘ মাসের পঞ্চম দিন। পৌষের বিদায় আর মাঘের শুরুতে গত কয়েকদিন সূর্যের দেখা মিলেনি রাজধানী ঢাকায়। তাপমাত্রা নেমেছিল ১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। ঠান্ডায় কষ্ট পেয়েছে অন্য প্রাণীরাও। তাই ঠান্ডা থেকে প্রাণীদের রক্ষায় বরাবরের মতো নানা ব্যবস্থা নিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ। বাড়িয়েছে কর্মীদের তদারকিও।
শুক্রবার (১৯ জানুয়ারি) সকাল থেকে সূর্যের দেখা মেলেছে রাজধানীতে। এমন সকালে জাতীয় চিড়িয়াখানা ঘুরে দেখা গেছে, গাছগাছালিতে পরিপূর্ণ চিড়িয়াখানা প্রাঙ্গণে পাতা ও ডালের ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে সূর্যের আলো। শীতে আলোর তাপ পেয়ে অনেকটা আড়মোড় ভেঙেছে প্রাণীদের। কোনো কোনো প্রাণীকে দেখা গেছে সরাসরি রোদ পোহাতে। আবার কোনো কোনো প্রাণীকে দেখা গেছে গাছের নিচে আয়েশি ভঙ্গিতে বসে বিশ্রাম নিতে। কেউ কেউ আবার রোদে বসে একে অপরের উকুন মারছে।
শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় দর্শনার্থীও ছিল চোখে পড়ার মতো। দর্শনার্থীদের মধ্যে শিশুরা মেতে উঠেছিল প্রাণীদের সানিধ্যে।
চিড়িয়াখানার কিউরেটর ভবনের সামনে থাকা সেডে দেখা গেছে, বৃহৎ আকৃতির সর্বভূক পাখি হাড়গিলা বা মদনটাককে উষ্ণতা দিতে দেওয়া হয়েছে খড়ের গদি। গদি থাকলেও পাখিগুলো রোদে এসে দাঁড়িয়েছে। সারস ক্রেন পাখিরও একই অবস্থা।
আরও পড়ুন
কিউরেটর অফিসের উত্তর পাশে থাকা সেডে হরিণদের উষ্ণতা নিতে দেখা গেছে। কেউ রোদে দাঁড়িয়ে আছে। আবার কেউ গাছের ছায়ায় বসে আছে। উত্তরদিকে আরও একটি হরিণের সেড রয়েছে। সেখানে হরিণের একটি দলকে রোদে শুয়ে থাকতে দেখা গেছে। তাদের সঙ্গে হরিণের শাবকরাও ছিল। আরেকটি দলকে গাছের নিচে ঠান্ডায় শুয়ে থাকতে দেখা যায়।
রয়েল বেঙ্গল টাইগার মঠে থাকা বাঘ-বাঘিনীদের সন্তান নিয়ে রোদ পোহাতে দেখা গেছে। সেখানে বাচ্চাসহ মোট পাঁচটি বাঘকে দেখা গেছে খেলা করতে। অন্যদিকে সিংহকে একা একা রোদ পোহাতে দেখা গেছে।
রোদের তাপ পেয়ে লোনা পানির কুমিরও জল ছেড়েছে, সিঁড়িতে শুয়ে রোদ পোহাচ্ছে। ওই সেডে থাকা আরও দুটি কুমিরকে বালুর ওপর রোদে শুয়ে থাকতে দেখা গেছে।
এদিকে মিঠা পানির কুমিরকে দেখা গেছে হাউজের পানির ওপরে একটি গাছের গুঁড়িতে হা করে শুয়ে থাকতে। ওই সেডের অন্যটিকে দেখা গেছে দেয়ালের ওপর শুয়ে রোদ পোহাতে।
এদিকে বানরের দল যেন গ্রামীণ পরিবারের প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তুলেছে। রোদে বসে একে অপরের উকুন বেছে দিতে দেখা গেছে রেসাস বানরদের। অন্য বানররা আনমনে খেলাধুলায় মেতেছে। তবে ঠান্ডার রাতে তাদের জন্য পাটের চটের ব্যবস্থা করেছে কর্তৃপক্ষ।
এরই ফাঁকে কাঠবিড়ালির দুষ্টু চক্রের দুষ্টুমিতে মুগ্ধ হয়েছে দর্শনার্থীরা। তারা হঠাৎ দর্শনার্থীদের পায়ের কাছে আসে, আবার ধরতে গেলেই এক লাফে গাছে উঠে যায়।
এদিকে উল্লুকের ডাকে একত্রিত হয়েছে দর্শনার্থীরা। নানাভাবে চেঁচিয়ে, খেলা দেখিয়ে তারা দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করছিল। অন্তত গোটা ৫০ দর্শনার্থী উল্লুকের খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে তা উপভোগ করছিলেন। পাশের সেডে অলিভ বেবুনকে দেখা গেছে নিঃশব্দে ঘরের ছাদে বসে রোদ তাপাতে। এদের জন্যও শীতকাল হিসেবে পাটের চটের ব্যবস্থা করেছে কর্তৃপক্ষ।
সাপের সেডে শুধু রয়েছে ছোট-বড় অজগর। তাদের ঠান্ডার হাত থেকে রক্ষার জন্য বেশ উঁচু করে খড়ের গদি তৈরি করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। তাদের খাঁচার বাইরে লিখে দেওয়া হয়েছে, শীতকালে সাপ সাধারণত কোনো খাদ্য গ্রহণ করে না। এসময় সাপ নিরাপদ আড়ালে থাকতে পছন্দ করে।
এদিকে জলহস্তী পার্কে প্রথমে কোনো জলহস্তীকে পানির ওপরে থাকতে দেখা যায়নি। সবগুলো জলহস্তী পানিতে ডুবে নাক ভাসিয়ে বসেছিল। কিছু সময় পরপর জলহস্তীগুলো পানি ছিটাচ্ছিল। তা দেখে মুগ্ধ হচ্ছিলেন দর্শনার্থীরা। তবে পরে দেখা যায়, খাবার খেতে সব জলহস্তী ডাঙায় চলে এসেছে। তখন রোদে তাদের দেহ চকচক করছিল।
ইম্পালার দলকে রোদে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। রাজধনেশও রোদে বসে আছে রাজার বেশে। ইমু পাখির দলকেও দেখা গেছে দুপুরের মিষ্টি রোদে ফুরফুরে মেজাজে ঘুরে বেড়াতে। রাতে ঠান্ডা বাতাস যেন তাদের কষ্ট দিতে না পারে, সেজন্য পাটের চট দিয়ে বাসস্থানের চারদিকে ছাউনি দেওয়া হয়েছে।
ময়ূরের সেডে পুরো বেষ্টনী দেওয়া হয়েছে পাটের চট দিয়ে। এগুলো দিনের বেলায় দর্শনার্থীদের দেখার সুবিধার জন্য উঠিয়ে রাখা হয়। আর রাতের বেলা নামিয়ে দেওয়া হয়, যেন বাতাস ঢুকতে না পারে। ঝলমলে রোদে কয়েকটি ময়ূরকে পাখনা মেলে বসে থাকতে দেখা গেছে।
জাতীয় চিড়িয়াখানার তথ্য বলছে, চিড়িয়াখানায় মোট খাঁচা আছে ১৩৭টি। এসব খাঁচার প্রকোষ্ঠ আছে ২৩৭টি। চিড়িয়াখানায় মোট প্রাণী রয়েছে ৩ হাজার ৩৪২টি। এর মধ্যে বৃহৎ প্রাণী (তৃণভোজী) ১৮টি প্রজাতির ৪০১টি, মাংসাশী ১১টি প্রজাতির ৪০টি, ক্ষুদ্র স্তন্যপায়ী ১১টি প্রজাতির ১১৬টি, সরীসৃপ ৯টি প্রজাতির ৭৫টি, পাখি ৫০টি প্রজাতির ১ হাজার ৬৫৯টি, অ্যাকুরিয়াম ফিশ ২৫টি প্রজাতির এক হাজার ৫১টি রয়েছে।
শীতকালে ঠান্ডা থেকে রক্ষায় প্রাণীর জন্য কি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে— জানতে চাইলে বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানার কিউরেটর ডা. মুজিবুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের চিড়িয়াখানায় নানা ধরনের প্রাণী আছে। শীতকাল বিবেচনায় যেসব প্রাণীর জন্য যে ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত, আমরা সে ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছি। পাখিদের ক্ষেত্রে খাঁচার চারদিকে চটের বেড়া দিয়েছি। ঠান্ডার মধ্যেও তারা যেন নিরাপদে থাকতে পারে, সেজন্য ছোট ছোট বক্স এবং মাটির হাঁড়িও দেওয়া হয়েছে। বানরের খাঁচাসহ যেসব প্রাণী বাতাসে ঠান্ডা বাতাসে আক্রান্ত হতে পারে, সেখানে পাটের চটের ব্যবস্থা করা হয়েছে। দর্শনার্থীদের জন্য সকালের দিকে চটগুলো খুলে ফেলা হয় এবং সন্ধ্যার দিকে আবার চটগুলো লাগিয়ে দেওয়া হয়। যেসব প্রাণী মাটিতে থাকে তাদের জন্য খড়ের গদি তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। যেমন আপনি সাপের খাঁচায় গেলেই দেখতে পাবেন সেখানে উঁচু করে গদি তৈরি করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, প্রাণীদের বাসস্থান ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি আমরা পুষ্টির বিষয়টিতেও নজর দিয়েছি। যেসব ফল খেলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে, সেসব তাদের খাওয়ানো হচ্ছে। বিভিন্ন খাদ্যের সঙ্গে তাদের ভিটামিন ও মিনারেল দেওয়া হচ্ছে। এ কাজগুলো আমরা করছি। এতে করে প্রাণীদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়বে।
সাপের সেডে শুধু অজগর সাপ কেন— জানতে চাইলে এই কিউরেটর ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা অন্য সাপগুলো সংগ্রহ করার চেষ্টা করছি। বন্যপ্রাণী আইন অনুযায়ী আমরা লোকাল থেকে কোনো কিছু সংগ্রহ করতে পারি না। এগুলো টেন্ডারের মাধ্যমে কিনে তারপর আনতে হয়। একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পুরো কাজটা করতে হয়। আমরা বন থেকে সরাসরি কোনো কিছু ধরে আনতে পারি না।
সাপ্তাহিক ছুটির দিনে শিশুরা প্রাণীদের কাছে
এদিকে সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবার হওয়ায় চিড়িয়াখানায় মানুষের ঢল নেমেছে। তবে যত না প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ আছেন, তার চেয়ে বেশি রয়েছে শিশুরা। কেউ এসেছে বাবা-মায়ের কোলে চড়ে আবার কেউ এসেছে বাবা-মায়ের হাত ধরে ছোট ছোট পায়ে হেঁটে। অনেকে আবার চিড়িয়াখানায় শিশুদের এনে খালি পায়ে নামিয়ে দিয়েছেন, যেন শহরের পিচঢালা পথের বাইরে একটু মাটি খুঁজে পায় শিশুরা।
শুক্রবার সকালে চিড়িয়াখানা ছিল যেন শিশুদের মুক্তমঞ্চ। শিশুদের মধ্যে যারা হাঁটতে পারে, তারা মা-বাবার আঙ্গুল ধরে হেঁটে বিভিন্ন প্রাণী পর্যবেক্ষণ করছিল। প্রাণীদের সান্নিধ্যে এসে তারা অনেক উচ্ছ্বসিত। কোনো প্রাণী তারা ছুঁয়ে দেখছিল, আবার কোনো প্রাণী দূর থেকে দেখছিল। যেখানে তারা আনন্দ পাচ্ছিল, সেখানে দীর্ঘসময় অবস্থান করছিল।
এমএইচএন/এসএসএইচ