নির্বাচনে ৬ গুণ বেশি ব্যয় করেছে প্রার্থীরা, আ.লীগ ১১.৪৫ গুণ
নির্বাচন কমিশনের নির্ধারিত ২৫ লাখ টাকার চেয়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীরা ৬ গুণ বেশি ব্যয় করেছে। যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১১.৪৫ গুণ বেশি ব্যয় করেছে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। তফসিল ঘোষণার আগে থেকে নির্বাচন পর্যন্ত প্রার্থীদের মধ্যে সর্বোচ্চ ৩৮ কোটি ৭৭ লাখ ১০ হাজার ১৪৪ টাকা থেকে সর্বনিম্ন ৭০ হাজার টাকা ব্যয় করেছেন।
‘দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রক্রিয়া ট্রাকিং’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উপস্থাপন করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
বুধবার (১৭ জানুয়ারি) রাজধানীর ধানমন্ডিতে নিজেদের কার্যালয়ে এই গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন টিআইবির গবেষক মাহফুজুর হক, নেওয়াজুল মওলা ও সাজেদুল ইসলাম। মিশ্র পদ্ধতির এই গবেষণায় দৈবচয়নের ভিত্তিতে ৫০টি নির্বাচনী আসন নির্বাচন করে জুন-২০২৩ থেকে জানুয়ারি-২০২৪ পর্যন্ত মাঠ পর্যায়ের তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণপূর্বক প্রতিবেদনটি প্রণয়ন করা হয়।
প্রার্থীদের নির্বাচনী ব্যয় সম্পর্কে টিআইবির গবেষণা বলছে, নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নির্ধারিত ব্যয়সীমার চেয়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীরা ৬ গুণ বেশি করেছে। যা একাদশ নির্বাচনে ছিল ৩ গুণ বেশি। আর এবারের নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ১১.৪৫ গুণ বেশি ব্যয় করেছে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা।
তফসিল ঘোষণার পূর্ব থেকে নির্বাচন পর্যন্ত প্রার্থীদের গড় ব্যয় হয়েছে ১ কোটি ৫৬ লাখ ৮৩ হাজার ৭৭৭ টাকা। যার মধ্যে সর্বোচ্চ ৩৮ কোটি ৭৭ লাখ ১০ হাজার ১৪৪ টাকা থেকে সর্বনিম্ন ৭০ হাজার টাকা ব্যয় করেছেন প্রার্থীরা। যেখানে একাদশ নির্বাচনে গড় ব্যয় ছিল ৭৭ লাখ ৬৫ হাজার টাকা।
আরও পড়ুন
টিআইবির গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ৫০ আসনের ৬৫.৭৭ শতাংশ প্রার্থী নির্ধারিত ব্যয়সীমার বেশি ব্যয় করেছেন। মনোনয়ন চূড়ান্ত হওয়ার পর নির্বাচন পর্যন্ত ১৪৯ জন প্রার্থীর গড়ে ১ কোটি ২ লাখ ৭৭ হাজার ২৬৫ টাকা ব্যয় করেছেন। নির্বাচনে ব্যয়ের উল্লেখযোগ্য খাতগুলো হলো- পোস্টার, নির্বাচনী ক্যাম্প, জনসভা ও কর্মীদের জন্য ব্যয়।
গবেষণায় নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়েও নানাবিধ প্রশ্ন রয়েছে। আগের নির্বাচনের তুলনায় ভোটার বৃদ্ধির হার দ্বিগুণ হওয়া, সংসদীয় আসন পুনর্বিন্যাস, নতুন দলের নিবন্ধন, কমিশনের প্রতি আস্থা সৃষ্টি, সংলাপের প্রাপ্ত সুপারিশ আমলে নিতে নির্লিপ্ততাসহ নানাবিধ বিতর্ক রয়েছে। নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু করতে সংবিধানে প্রদত্ত ১২৬ নম্বর অনুচ্ছেদের ক্ষমতা বা ম্যান্ডেট রাজনৈতিক সংকট সমাধানে ব্যবহার করেনি কমিশন। আবার, নির্বাচনের বাজেট ১৪৪৫ কোটি টাকা হলেও ব্যয় বেড়ে ২২৭৬ কোটি টাকা, যা একাদশ নির্বাচনের তুলনায় তিনগুণ।
অন্যদিকে নির্বাচনে সারা দেশে অধিকাংশ কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী ছাড়া অন্য দলের প্রার্থীদের পোলিং এজেন্ট না থাকা; প্রতিপক্ষ প্রার্থীর এজেন্টদের হুমকির মাধ্যমে কেন্দ্রে প্রবেশ করা থেকে বিরত রাখা, ভোটার স্বল্পতা, ডামি লাইন তৈরি, অন্য প্রার্থীর এজেন্ট বের করে দেওয়া, ভোটের আগেই ব্যালটে সিল মারা, ভোট চলাকালে প্রকাশ্য সিল মারাসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে।
নির্বাচন নিয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের পরস্পর বিপরীতমুখী ও অনড় অবস্থানের কারণে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হয়নি। যা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের জিম্মিদশা প্রকট করে তুলেছে। এ নির্বাচন বাংলাদেশের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার চেতনা ও স্বপ্নের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের নির্বাচনী অঙ্গীকার আরো বেশি অবাস্তব ও কাগুজে দলিলে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। সরকারের টানা চতুর্থ মেয়াদের সম্ভাব্য সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে যতটুকু আগ্রহ থাকবে, তার চেয়ে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক হবে শুদ্ধাচার ও নৈতিকতার মানদণ্ডে সরকারের প্রতি জনআস্থা এবং গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্ন ও তার প্রভাব। একইসঙ্গে, ক্রমাগত গভীরতর হবে দেশের গণতান্ত্রিক ও নির্বাচনী ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ।’
টিআইবির গবেষণায় নমুনা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ৫০টি আসনে শতভাগ ক্ষেত্রেই কোনো না কোনো নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। আওয়ামী লীগ মনোনীত শতভাগ প্রার্থী কর্তৃক ন্যূনতম একবার হলেও কোনো না কোনো নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গ করেছেন। স্বতন্ত্র (আওয়ামী লীগ) প্রার্থীর ৯৭.৩ শতাংশ, অন্যান্য স্বতন্ত্র প্রার্থীর ৮৭.৫ শতাংশ, জাতীয় পার্টির প্রার্থীর ৮৪.৯ শতাংশ, অন্যান্য দলের প্রার্থীর ৮০ শতাংশ ও তৃণমূল বিএনপির প্রার্থীরা ৭৫ শতাংশ নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গ করেছেন।
গবেষণায় উঠে এসেছে, মোবাইলে এসএমএস দেওয়া, ফেসবুকে প্রচারণামূলক বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে সরকারের বিবিধ উন্নয়নমূলক কাজের প্রচারণার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যম বিটিভিকে একচেটিয়া ব্যবহার করে ক্ষমতাসীন দলের প্রচার-প্রচারণা ও সভা-সমাবেশের খবর প্রচার করা হয়েছে। আবার বেসরকারি সংবাদ মাধ্যমগুলোতে হরতাল-অবরোধ-অগ্নিকাণ্ড ও নির্বাচন বর্জনের খবরসহ বিএনপি গণতন্ত্রের জন্য হুমকি এই বিষয়ক সরকার দলীয় নেতাদের বক্তব্য অধিক প্রচার করা হয়েছে। ৫ ডিসেম্বর ২০২৩ থেকে ৫ জানুয়ারি ২০২৪ পর্যন্ত বিটিভির রাত ৮টার খবরে নির্বাচন সম্পর্কিত সংবাদে মোট ব্যয়িত সময় ৪৯৩ মিনিট ২৭ সেকেন্ড এবং এ বাবদ প্রাক্কলিত মোট আর্থিক মূল্য ৪ কোটি ৪২ লাখ ১৫ হাজার ৫০০ টাকা। এর মধ্যে সর্বোচ্চ সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী বিষয়ক সংবাদ ১১৫ মিনিট ৫১ সেকেন্ড, যার অর্থমূল্য ১ কোটি ৪ লাখ ২৬ হাজার ৫০০ টাকা।
টিআইবি আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মুহাম্মদ বদিউজ্জামান প্রমুখ।
আরএম/এসএম